কুলসুম : অধিকাংশ পরিবারে দেখতে পাওয়া যায়, মেয়েকে মধুরস্বভাব, ভদ্র ও বুদ্ধিমতি করে তোলার বিশেষ কোনো প্রয়োজন নেই। আপনা-আপনি মেয়ে যে শিক্ষা পায়, তাই যথেষ্ট মনে করা হয়। রীতিমতোভাবে উপদেশ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কাজে-কর্মে উঠা-বসায় তাই বলে মেয়েকে অনবরত গালি দেওয়া অবশ্য কর্তব্য নয়। কাজ-কামে একটু আধটু সমালোচনা করা যেতে পারে তবে তাকে সর্বগুণালঙ্কৃতা করতে হলে রীতিমতো শিক্ষা দিতে হবে। মেয়েকে বড় করে তোলবার জন্য মা-বাপ দায়ী। কানো কৈানো অপদার্থ বাপ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘাড়ে সব কর্তব্য ফেলে দেন। মেয়ের প্রতি যে নিজেদের কতখানি কর্তব্য আছে, তা তাঁরা জানেন না। কোনো কোনো পিতা বিয়ের জন্য মেয়েকে এক আধখানা পুঁথি পড়িয়ে দেন। এক আধখানা পুঁথি পড়তে পারলে বা জঘন্য অক্ষরে দুই এক লাইন লিখতে পারলে মেয়ে দেবী হয়ে বসেন।
হালিমা : সে তো ঠিক। আচ্ছা, আজকাল বাপ মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে পথের ফকির হচ্ছে। বিয়ের সময় বাপ কি মেয়েকে কিছুই দেবে না?
কুলসুম : পণপ্রথার কথা বলছো? মেয়ের বাপের কাছ থেকে পণ গ্রহণ করা ভালো কাজ বলে মনে হয় না। বাপ মেয়েকে গয়না দিতে বাধ্য নন। প্রয়োজন হলে মেয়েকে বাপের বাড়িতে এসে অতিথি বা ভাই-বউদের যাতে কৃপার পাত্রী না হয়ে থাকতে হয় সে সম্বন্ধে পিতার পূর্ব হতেই বিবেচনা করা উচিত। ভাই-বউরা স্বামীর ভগ্নীকে যে ঘৃণা করেন–এ বলছি না, তবুও প্রত্যেকের দাবি স্বাধীনতা বজায় রাখা দরকার। কোনো স্বামী যদি স্ত্রীকে কাবিনের টাকা মাফ করে দিতে বলেন বা স্ত্রীর সম্পত্তি বেচে ফেলতে ইচ্ছুক হন তবে তিনি স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরের ন্যায় ব্যবহার করেন। বিশেষ ভালবাসা ও জুলুমের দ্বারা কাবিনের টাকা মাফ নিলেও আল্লাহর কাছে তা গৃহীত হয় না। স্বামী যদি বিবাহের আগে মনে করেন তিনি দেনমোহর আদায় করবেন না, মাফ লইবেন, তা হলে বিবাহ সিদ্ধ হয় না। স্ত্রী তার সম্পত্তি স্বামীকে ভোগ করতে দেবেন, কিন্তু নষ্ট করতে দেবেন না! বাপের বাড়ির সম্পত্তি যদি বিক্রয় করা দরকার হয়, তবে স্বামীর কর্তব্য সেই টাকা দিয়ে স্ত্রীর নামে নতুন সম্পত্তি ক্রয় করে দেওয়া। যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর সম্পত্তি নষ্ট করে ফেলেন তবে তার জন্য স্ত্রী যেন স্বামীর সঙ্গে কলহ-বিবাদ না করেন! নিজের মনের দুঃখ গোপন করে রাখবে। বাপ যেন কোনো সময় মেয়েকে ভাগ প্রাপ্য অংশ হতে বঞ্চিত না করেন।
হালিমা : মেয়ের সঙ্গে শ্বশুরবাড়িতে থালা, ঘটি অর্থাৎ নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র দেওয়া উচিত নয় কি?
কুলসুম : সেসব জিনিস স্বামী দিতে বাধ্য। যেদিন স্বামী বিয়ে করলেন সেদিন হতে স্ত্রীর সকল সুখের ব্যবস্থা স্বামীকেই করতে হবে। অনেকে ইচ্ছা করেন বধূ, খাট, চেয়ার, বাক্স, বদনা, ঘটি, এ-সব বাপের বাড়ি হতে নিয়ে আসবেন। পরের বাড়িতে যখন থাকা, তখন সঙ্গে কিছু কিছু জিনিস না নিয়ে গেলেও অপ্রস্তুত হতে হয়। এসব জিনিস মেয়ে যদি সঙ্গে না নেন, তবে তাকে কিছু বলবার অধিকার কারো নেই। যেসব জায়গায় মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দিতে হয়, সেখানে অনেক বিড়ম্বনা ভোগ করতে হয়। মেয়েকে খোশামোদ করে বিয়ে দেওয়া অত্মমর্যদা জ্ঞানসম্পন্ন লোক পারেন না। বড় মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ করে বড় হতে চেষ্টা করা ভালো কাজ বলে বোধ হয় না; জ্ঞান, বিদ্যা, ও চরিত্রের দ্বারা বড় হতে চেষ্টা করা উচিত।
হালিমা : বাপ জামাইকে টাকা অর্থাৎ পণ, গয়না কিছু দিতে বাধ্য নয় কি?
কুলসুম : না, বাপ শুধু মেয়েকে মানুষ করে দিতে বাধ্য। যিনি বিয়ে করবেন, তিনি গয়না দিয়ে সজ্জা দিয়ে বধূ নিয়ে যাবেন। তার নিকট হতেও জোর করে গহনা আদায় করবার কারো অধিকার নেই। যার বউ তিনি ইচ্ছা হয় গয়না দেবেন, নইলে না দেবেন। এ সম্বন্ধে বাজে লোকের কোনো কথা না বলা উচিত। বধূরও উচিত নয় স্বামীর কাছ থেকে কিছু জোর করে আদায় করা। রূপ স্বামী দেখবেন। স্বামী যদি স্ত্রীকে রূপসী করে না তুলতে চান, তবে স্ত্রীর কি? গয়না অপেক্ষা, জ্ঞান, চরিত্রশক্তি ও মানসিক বলের ভিতরই রূপ বেশি আছে।
বাপের সম্পত্তির টাকা এক পয়সা হলেও, বিবাহিত মেয়েদের কাছে অংশমতো মাসে মাসে আত্মীয় বা ভাইদের কর্তব্য পাঠিয়ে দেয়। মেয়ে যেন এই অংশ আদায় করতে কোনোও রকমে সঙ্কোচ বোধ না করেন। যে পিতা মেয়ের অংশ শুধু ছেলেদের দিয়ে যান–তিনি অপদার্থ পিতা। যে ভাই ভগ্নীকে-বোন ভিন্ন মায়ের পেটের বা এক মায়ের পেটের-সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করতে চান, তিনি বড় অন্যায় কাজ করেন। তিনি পাপ করেন।
হালিমা : অনেকে পড়ার খরচ পাবার আশায় বিয়ে করে, পরে বাপ টাকা না দিলে চিরকাল মেয়েকে আপমান সইতে হয়।
কুলসুম : অনেক শ্বশুর জামাইকে টাকা দেওয়া হবে বলে মেয়ে দেন; এর ফল শেষে খারাপ হয়। এরূপ কোনো বন্দোবস্ত জামাই-শ্বশুরে না হওয়াই ভালো। কোনো দান শ্বশুরের কাছ থেকে না নেওয়াই উচিত। আগে বলেছি শ্বশুরের মাঝে মাঝে জামাইকে উপহার দেওয়া ভালো, জামাইয়ের কিন্তু উচিত শ্বশুরের কোনো কিছু গ্রহণ না করা।
হালিমা : বিবাহের পর মেয়েকে জামাই এবং শ্বশুরের হাতে সঁপে দেয়া কেমন প্রথা?