হালিমা : মা যদি মেয়ে দিয়ে বেশি কাজ করান, তা হলে মেয়ে মাকে নিষ্ঠুর মনে করতে পারে?
কুলসুম : মেয়েকে যদি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখান যায়, তা হলে বাল্যজীবনে যে মায়ের কাছ থেকে তালিম পেয়েছে, এজন্য সেয়ানা হয়ে সে কৃতজ্ঞ হবে।
হালিমা : মেয়েদের কী কী কাজ শিখতে হবে?
কুলসুম : সংসার চালানোর জন্যে যত কাজ শেখা দরকার–সব। ঘর ঝাঁট দেওয়া, জিনিসপত্র যথাস্থানে রাখা, মাজা, কাপড় কাঁচা, রান্না করা, একটু রিপু-সেলাইয়ের অভ্যাস, একটু ঔষধের জ্ঞান, চুল বাঁধতে জানা, পানি তোলা–এ সব শিখে রাখা উচিত। বাড়িতে যদি দুই তিনটি মেয়ে থাকে, তা হলে একটা ছোঁকরা চাকর ছাড়া মেয়ে দাসী না রাখাই ভালো। বাল্যকালে মেয়েরা যাতে অলস বা বিলাসী না হয়, সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
হালিমা : লেখাপড়া এবং সংসারের কাজ এক সঙ্গে চালানো কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন সম্ভব নয়? লেখাপড়া শেখার আজুহাতে কাজ করবার অভ্যাস ত্যাগ করা অন্যায়। কাজ করবে, সঙ্গে সঙ্গে লেখাপড়া শিখবে। পড়াশুনা বা কোনো শিল্প শেখার জন্যে বেশি সময় দরকার হয় তা হলে অল্প হলেও সংসারের কাজ একেবারে ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। বিদেশী মেয়েদের জীবন অনুকরণ করলে চলবে না, নিজের দেশে কিন্তু তারা যথেষ্ট কাজ করে।
হালিমা : বাল্যকালে মেয়েদের প্রথম কর্তব্য কী?
কুলসুম : প্রথম কর্তব্য ধর্ম শেখা। বিদ্যালয়ে পড়ার সঙ্গে ধর্ম-পুস্তক পড়তে হবে। অন্তত নামাজ পড়ার মতো শিখতে হবে।
হালিমা : ইংরেজি পড়া কি দোষের?
কুলসুম : কে বলল দোষের? ইংরেজি, বাংলা, ফারসি, আরবী যে কোনো ভাষা শেখা যায়, তাই ভালো। অনেক স্ত্রীলোক আছেন, যারা মনে করেন, আরবী ও উর্দু পড়লেই বেহেস্তের পথ পরিষ্কার হয়–এটা মিথ্যা কথা। লেখাপড়া শেখবার উদ্দেশ্য-মনের উন্নতি ও জ্ঞান লাভ করা,ধর্ম, মনুষ্যত্ব ও স্রষ্টাকে ভালোরূপে বুঝতে পারা। মনের উন্নতি লাভ করার জন্যে মানব-সমাজ, মানব-চরিত্র, শাসন ও মনের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় ভালো করে বুঝবার জন্যে, যতগুলি ভাষা শেখা দরকার, নারীকেও তা শিখতে হবে। শুধু আরবী ও উর্দু পড়লে বেহেস্তে যাওয়া যায়-এ বিশ্বাস করা বড়ই ভুল।
হালিমা : আরবী ফারসী পড়ে কি প্রভূত জ্ঞান হয় না।
কুলসুম : আরবীর সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও ইংরেজি পড়তে হবে, নইলে বর্তমান সময়ে অনেক কাজে বে-অকুফ হতে হয়। চতুর্দিকে বাংলা ইংরেজির ঢেউ বয়ে যাচ্ছে, আমি তুমি দেমাক করে বসে থাকলে চলবে না। কেউ কেউ বলেন, মেয়েদের জন্যে সামান্য একটু লেখাপড়াই যথেষ্ট। আমার মনে হয় পুরুষ ছেলের চেয়ে মেয়েছেলের লেখাপড়া বেশি দরকার! এতে জাতির মুক্তি অতি অল্প সময়ে হয়। রান্নাঘরে শিশু মায়ের কাছে যা শেখে–ভালো হোক, মন্দ হোক, মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সে তা মনে করে রাখে-মারলে, কাটলে, টাকা দিলে কিছুতেই মানুষ যেন সে শিক্ষা ভুলতে পারে না। মায়ের বিশ্বাস ও, কুসংস্কারকে অবহেলা করতে পারে–অল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত লোকে এরকম পারে না। মায়ের মহিমায় জগতে ইতরও শ্রেষ্ঠ পরিবারে প্রতিষ্ঠা হয়। নীচমনা লোকের ছেলে ছোট, ভদ্রঘরের ছেলে ভদ্র হয়। অবশ্য এই কথা অবিসংবাদী বলে মেনে নেওয়া কিন্তু নীচতা ও জাতির পক্ষে অকল্যাণকর। ছোটলোকের ছেলেও মহাপুরুষ হতে পারে। কাওকে ছোটলোক বলা পাপ।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় পড়বে? কে পড়াবে?
কুলসুম : শিক্ষিত পরিবার হলে মেয়ে বাড়িতে ভাই বা বাপের কাছে পড়তে পারে। স্কুল-কলেজে পড়লেই সুবিধে হয়। অনেক মানুষের সঙ্গে মেলামেশা না করলে মন ও মাথায় বুদ্ধি খেলে না। ঘরের মধ্যে একই রকমের মানুষের সঙ্গে নিত্য মিশলে মনের জাতি হয় না, বুদ্ধির বিকাশ হয় না এবং চরিত্র এবং বিনয় ভূষিত হয় না। মেয়েরা অনেক মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না বলে, সাধারণত তারা বোকা দাম্ভিক প্রকৃতির হয়ে থাকে। এ দেশে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান শিখার কোনো ভালো মেয়ে স্কুল বা কলেজ নেই–এটা বড়ই দুঃখের কথা। যে সমস্ত লোকের বহু অর্থ আছে তারা কি জন্য যে এত অর্থ জমা করে রাখে জানি। মানব মঙ্গলে যদি অর্থ ব্যয়িত না হয় তবে টাকাকড়ি উপায় করে বিশেষ লাভ কী?
হালিমা : শুনেছি বাংলাদেশে মেয়েদের জন্য বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাশ্রম খোলা হবে। মেয়েরা বোডিং-এ থাকবেন। কারো কিছু খরচ লাগবে না। বিদ্যালয়, কলেজ ও শিল্পাগারে দশ হাজার ছাত্রীর স্থান হবে। শিল্পাশ্রমে দরিদ্র, নিঃসহায়, যে-কোনো মেয়ে যে কোনো বয়সে শিল্প শিক্ষা করার সুবিধা পাবেন।
কুলসুম : এরূপ তো শুনেছি কত নরী খাবার অভাবে, পাপে চূর্ণ হচ্ছে। তাদের কথা ভাববার কারো অবসর নেই।
হালিমা : বিয়ে হবার আগে সাজসজ্জা করা কি ভালো?
কুলসুম : না, স্বামীর বাড়ি ছাড়া মেয়েমানুষের অন্য কোনো জায়গায় খুব সাজসজ্জা অকর্তব্য। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকাই যথেষ্ট। তেড়ী কেটে গয়না পরে, বাইরে বের হওয়া। ঠিক নয়। এদেশে অবাধে নারীদের বাইরে বের হবার অবস্থা নাই বলে, তাদের সাজসজ্জা দেখে পুরুষের মনে তরল ভাব আসতে পারে।
হালিমা : মেয়েকে বাল্যকাল হতে সচ্চরিত্রা, শিক্ষিতা, মার্জিত, রুচি, মধুরস্বভাব করে তুলবে কে? এর জন্য কি বিশেষ দৃষ্টি আবশ্যক? দায়িত্ব বেশি কার?