হালিমা : খাওয়া মাটিতে বসেই ভালো, না একটু উঁচুতে হলে ভালো হয়?
কুলসুম : একখানা লম্বা বড় তক্তপোষের উপর বসে খাওয়া যেতে পারে। একখানা উঁচু মাচা ও টেবিলের উপর খেলেও দোষ হয় না। এজন্য ছোট ছোট হাতবিহীন কয়েকখানি চেয়ার অথবা দুখানা লম্বা বেঞ্জ তৈরি করে নিলে ভালো হয়। খাবার জন্য টেবিল চেয়ার ব্যবহার করাও ভালো, তবে এতে অনেক অপদার্থ লোক গর্ব ও গৌরব অনুভব করে! এতে গর্ববোধ করার কিছুই নেই।
হালিমা : দাসীরা কি মাটিতে বসে খাবে?
কুলসুম : দাসীরা যদি বাড়ির প্রভুকীর আসনে বসে ভাত খায় তা হলে কীর সম্মান কমবে না। একটু থেমে কুলসুম আবার বললেন-তরকারি, মাংস পেয়ালায় আগেই তুলে রাখা মন্দ নয়। অনেক সময় বাড়ির সকলকে খাওয়াতে কিছুই বাকি থাকে না। এ ভারি অন্যায়। হাঁড়িতে কিছু রেখে–যে কজন মানুষ সেই কটা পেয়ালা তৈরি করা ভালো। কেউ যদি আবদার ধরে, তা হলে হাঁড়ি হতে সম্ভব হলে তাকে কিছু দেবে। বাড়ীর বৃদ্ধ বা কর্তাকে হিসেব করে কোন কিছু দেবে না। শাশুড়ী বা বাড়ির মেয়ে মুরুব্বী সম্বন্ধেও সেই কথা। এদের আলাদা করে পরিতোষপূর্বক আহার করাবে। যে সব জিনিস রান্না হবে তার পরিমাণ অল্প হলেও সকলকে দেবে। ভালো জিনিস সবশেষে খেতে দিতে হয়। আগে ভালো জিনিস খেতে দিলে মন্দ জিনিস কেউ খেতে চায় না। কোনো জিনিস বেশি পরিমাণে দেওয়া উচিত নয়, এতে রান্না ভালো হয় নি, এই কুৎসা শুনতে হয়।
হালিমা : কতকগুলি অসহিষ্ণু লোভী ছেলে আছে, যারা রান্নাঘরে যেয়ে পাখীর মতো চুপ করে থাকে।
কুলসুম : ছেলেদের রান্নাঘরে বসতে নেই–এইকথা বলে দেবে। ছোট শিশুর স্বতন্ত্র কথা। খাবার লোভ না করে যদি শুধু মায়ের সঙ্গ-সুখের জন্য ছেলেরা রান্নাঘরে বসে থাকে। তবে দোষ নেই।
হালিমা : রান্নাঘরে অনেক সময় কলিকা হাতে করে অনেকে উপস্থিত হয়।
কুলসুম : তাদের উপর বিরক্ত প্রকাশ না করাই উচিত। কোনো মুরুব্বী যদি আসেন, তা হলে সম্ভ্রমের সঙ্গে তার হাত থেকে কলিকাটি নিয়ে দাসীকে আগুন তুলে দিতে বলবে-দাসী না থাকলে নিজ হাতেই আগুন তুলে, সময় থাকলে ফুঁ দিয়ে দেবে–দূরে আগুন ফেলে দেবে না। কলকেতে অনেক আগুন দেবে, অল্প আগুনে তামাক খাওয়া হয় না। মুরুব্বী ছাড়া অন্য লোক সম্বন্ধে অন্য কথা।
হালি : রান্নাঘরের জিনিসপত্রগুলি সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা উচিত নয় কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই–সুন্দর করে সার বেঁধে জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখবে। এলোমেলো কোনো জিনিস থাকলে দাসী চাকরের উপর বিরক্তি প্রকাশ করবে। যে চাকর বা দাসী তোমার ইচ্ছামতো কাজ করবে না, তাকে প্রথমে সাবধান করবে, সংশোধন না হলে বরখাস্ত করবে। গোলাম হারামজাদা বলে গালি দেওয়া ভালো নয়। জিরে, গোলমরিচ প্রভৃতি মসলা রাখবার জন্যে ছোট ছোট বয়েম অভাবে হাঁড়ি ব্যবহার করা ভালো। রান্নাঘরে কোনো জিনিসপত্র যেন আলগা না থাকে। খাবার পানির কলস সব সময় ঢাকা থাকা চাই। কোনো ঢাকনি ব্যবহার না করে পরিষ্কৃত গামছা দিয়ে ভরা কলসী ঢেকে রাখতে পার,সে গামছা মাথা মোছবার জন্যে ব্যবহৃত হবে না।
হালিমা : পুকুরে কিংবা কুপের পানি ফিলটার বা গরম না করে খাওয়া উচিত কি?
কুলসুম : লোকের পবিত্রতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ নেই, এটা দুঃখের বিষয়।পানির প্রতি লোকে যে কত অত্যাচার করে, তার ইয়ত্তা নেই। পানি ফিলটার করে খাওয়া উচিত।
হালিমা : বাড়িতে মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র পায়খানা থাকা উচিত কি?
কুলসুম : নিশ্চয়ই।
হালিমা : এঁটো ঝুটো সম্বন্ধে খুব সাবধান হতে হবে, নয় কি?
কুলসুম : এক কণা এঁটো কোথাও যাতে পড়ে না থাকে, সে সম্বন্ধে সাবধান হতে হবে। জায়গা বাড়ি নষ্ট করে ছেলেরা বেশি। তাদের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই পরিষ্কৃত করে ফেলতে হবে।
.
পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম : বাল্যকালে বাপের বাড়িতে যখন মেয়েরা থাকবে তখন যেন তারা শুধু হেসে-খেলে না বেড়ায়।
হালিমা : বাপের বাড়ি তো হাসবার খেলবারই জায়গা।
কুলসুম : স্বামীর বাড়িও হাসবার খেলবার জায়গা। জীবনের সঙ্গে সব অবস্থায় হাসি খেলা জড়িয়ে থাকবে। শুধু হাসি-খেলাকে প্রশ্রয় দিলে চলবে না। স্বামীর ঘরে যেয়ে যাতে আদর্শ পত্নী হয়ে স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়-বন্ধুকে তুষ্ট করা যায়, তার বন্দোবস্ত বাপের বাড়ি হতেই করে নিতে হবে। কোনো মুরব্বী বলে থাকেন–দুদিন পরে যখন মেয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে, তখন তাকে দিয়ে কোনো কাজ করান উচিত নয়। সে শুধু হেঁটে বেড়াবে, আর বসে খবে। এরূপ মুরুব্বী মেয়ের উপকার না করে বরং অপকার করেন।
হালিমা : মেয়ের দ্বারা তা হলে খুব কাজ করিয়ে নেওয়া উচিত?
কুলসুম : হ্যাঁ, দাসী থাকলেও মেয়েদের সংসারের সব কাজ করা উচিত। মেয়ে বড় মানুষের ঘরে পড়তে পারে, হয়ত শ্বশুরবাড়িতে মেয়েকে মোটেই কাম কাজ করতে হবে না–তবু বাপের বাড়িতে তাকে সব কাজ শিখিয়ে দেওয়া উচিত। কাজ করলে অসম্মান হয় না, এটা মেয়েকে শেখাতে হবে। মেয়ে কলেজ বা হাইস্কুলে পড়েছে বলে সে রান্না করতে শিখবে না এ হতে পারে না। বাবু মেয়ে জামায় ময়লা লাগে এই ভয়ে বাসন মাজবে
এও হতে পারে না। যেমন ঘরের হোক না, বাল্যকালে তাকে পরিশ্রমী জীবনের সঙ্গে অভ্যস্ত করে দিতে হবে। কুঁড়ে মেয়েরা মানুষের বেদনা বোঝে না-তারা বড় হলে নির্বোধ নিষ্ঠুর সংকীর্ণ হৃদয় এবং কটুভাষী হয়।