হালিমা : যুবতী দাসী দেখে বাড়ির কর্তা ভুলে যান’?
কুলসুম : বাড়ির কর্তা বা স্বামী কি ভদ্রলোক নন? এমন জঘন্য নীচ প্রকৃতিবিশিষ্ট স্বামীর সঙ্গ অবিলম্বে পরিত্যাগ করা উচিত। স্ত্রীলোক নিঃসহায়, দরিদ্র ও অশিক্ষিত বলে অনেক সময় এরূপ ঘটনা ঘটে থাকে। দাসীগুলি যদি পশু না হয়, তারা যদি আত্মজ্ঞানসম্পন্ন হয়, তা হলে তারা বাড়ির কর্তার এই নীচ প্রকৃতি দেখে তৎক্ষণাৎ চাকরি ত্যাগ করবে। বাইরে সমাজকে ভয় করে, আমাদের দেশের অনেক লোক পবিত্র জীবন যাপন করে–যাদের সমাজের ভয় নেই, তারা অনেক সময় পাপ করতে লজ্জা বোধ করে না। মানুষ সমাজ অপেক্ষা নিজের বিবেককে বেশি শ্রদ্ধা-ভিতর হতে পাপের প্রতি একটা ভীষণ ঘৃণা পোষণ করে, তখনই সে যথার্থ ভদ্রলোক হয়। স্ত্রী যদি বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী ও শক্তিশালিনী হন, তা হলে স্বামীর এত বড় নীচ সাহস হয় না। দাসীদের কি ধর্ম জ্ঞান ও লোকলজ্জা নেই।
হালিমা : স্বামীর প্রতি ঘৃণা পোষণ করে স্ত্রীর কি স্বামীর বাড়ি ত্যাগ করা সম্ভব?
কুলসুম : আমাদের দেশে নারী পুরুষের কৃপার পাত্র। সকলেই নারীকে পথে ভাসাতে চেষ্টা করে। বাপের সম্পত্তি বোনকে বাদ দিয়ে ভাইয়েরাই ভাগ করে নেয়। নারীর কোথাও স্থান নেই। স্বামীর অত্যাচার অনেক সময় স্ত্রীকে দায়ে পড়ে সহ্য করতে হয়। স্বামী হয়তো এক বেশ্যাকে ভালবাসে, স্ত্রী সেই বেশ্যাকে আদর করে, ভালবাসে, স্বামীর কৃপা লাভ করতে চেষ্টা করে, এ আমি জানি। এর চেয়ে দুঃখ আপমানের জীবন নারীর পক্ষে আর কি। হতে পারে? নারীকে শক্তি দেওয়া চাই–বিপদে পড়লে কোনো কাজ করে নিজের অন্ন নিজে সংগ্রহ করে খেতে পারে, সংগ্রাম করে বিবাহের সময় এরূপ শর্ত করে নিতে হবে-যাতে স্বামী লম্পট হয়ে স্ত্রীকে অপমান করতে না পারে। যাতে নারী ইচ্ছা করলে পুরুষকে তালাক দিতে পারে। লম্পট বলে প্রমাণ করতে পারলে সাহেব মেমকে, অথবা সাহেবকে আদালতের সাহায্যে যে-কোনো সময় পরিত্যাগ করতে পারে। শক্তি, ব্যক্তিত্ব ও চরিত্রের স্বাধীনতা ব্যতীত নারীর রূপের কোনো মূল্য আছে বলে মনে হয় না। তার পক্ষে প্রেম প্রণয় একটি জাজ্বল্যমান মিথ্যা কথা।
.
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন, বোন, রান্নাঘরের পার্শ্বেই পানি ফেলা মেয়েদের একটা খারাপ অভ্যাস।
হালিমা : নিরুপায় হয়ে তারা এরূপ করে কি?
কুলসুম : যে সব মেয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তারা রান্নাঘরের চারপার্শ্বে নোংরা করে রাখতে ভালবাসে না।
হালিমা : ময়লা-ধধায়া পানি কোথায় রাখা হবে?
কুলসুম : বড় হাঁড়ি কিংবা বালতিতে ময়লা জমা করে রাখা উচিত, তারপর স্নানের আগে দূরে ফেলে দিতে হয়। হাত ধোয়া পানি, হাঁড়ি ধোয়া পানি, সব এক জায়গায় জমা করে রাখবে। ঘরের পার্শ্বে পুনঃ পুনঃ একটু একটু করে পানি ফেললেই সেই জায়গা নোংরা। এবং দুর্গন্ধ হয়ে ওঠে। ভাতের ফেনাও ময়লা পানির হাঁড়িতে রেখে দিতে হয়।
হালিমা : গোছলখানার পানিতে কি ঘরের পার্শ্ব নোংরা হয়ে ওঠে না?
কুলসুম : গোছলখানার পানিতে জায়গা বড় নোংরা হয় না। দিনে একবার মাত্র এক জায়গায় অনেক পানি ঢাললেও ক্ষতি নেই। অনবরত সারাদিন এক জায়গায় একটু একটু করে পানি ফেলা দোষ এবং জঘন্য রুচির পরিচায়ক। ঘরের বারান্দায় বসে, অনেকের মুখ। ধোয়ার অভ্যাস আছে এও বড় জঘন্য অভ্যাস। রান্নাঘর বা ঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলার মতোই এ কাজটা খারাপ। রান্নাঘরের পার্শ্বে ময়লা পানি ফেলা যেমন অন্যায়, তেমনি তরকারির খোসা, দস্তরখানার পরিত্যক্ত আবর্জনা, মাছের আঁইশ ফেলাও নোংরা কাজ। চাকর না থাকলেও নিজে সেই অপরিষ্কৃত পানি এবং আবর্জনা দূর করে ফেলে দিয়ে আসবে। রান্নাঘরের একেবারে পার্শ্বেই কাউকে হাতমুখ ধুতে দিবে না। কোনো কোনো কুড়ে চিলুমচীতে মুখ ধোয়, এতে হাত মুখ ধধায়া পানিতে জায়গা নষ্ট হয় না সত্য। এ কালেও অনেক কাপুরুষ মনে করে চিলুমচীর কাশ ও থুথু তাদের সামনে না ধরলে তাদের অপমান করা হলো।
হালিমা : খাওয়া-দাওয়া রান্নাঘরে হওয়া উচিত, না অন্য ঘরে হওয়া উচিত?
কুলসুম : অনেকে রান্নাঘরেই খেয়ে থাকেন। রান্নাঘরে খাওয়া ঠিক নয়, তাতে মেয়েদের কাজে অসুবিধা হয়। রান্নাঘরে কতকটা মেয়েদের ড্রইংরুম সুতরাং পুরুষ লোকের সেখানে না যাওয়াই ভালো। খাবার জন্য স্বতন্ত্র স্থান নির্দিষ্ট থাকা উচিত।
হালিমা : রান্না করা জিনিসপত্র কোথায় রাখবে? সেগুলি কি দাসী চাকরের হেফাজতে রান্নাঘরে রাখা উচিত?
কুলসুম : রান্নাকরা জিনিসপত্র সিকা, মিটসেফ বা আলমারিতে বন্ধ করে রাখাই ভালো। সবচেয়ে মিটসেফে রাখাই সুবিধা। চাকর-দাসীরা অনেক সময় চুরি করে খায়। ইঁদুর-বিড়াল-কুকুর সুযোগ পেলে ঘরে ঢুকে মাছ মাংসের সদ্ব্যবহার করতে পারে না।
হালিমা : মেয়েরা কোথায় খাবে?
কুলসুম : পুরুষের সঙ্গে একসঙ্গে বসে খেতে পারেন–তাতে লজ্জা কি? মেয়ে মানুষ যে ভাত খেয়ে থাকেন এ কথা পুরুষ বিলক্ষণ জানেন। যদি স্বতন্ত্র খাবার ঘর থাকে তবে সেখানে বাড়ির সকলেই পুরুষ মেয়ে গৃহিণী এক সঙ্গে বসে খেতে পারেন। খাবার ঘরে একটি রেফ্রিজারেটর রাখতে পারলে খুবই ভালো হয়, এটা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তৈরি। এতে খাবার জিনিস নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে না। নিজেদের খাওয়া হলে দাসীরা খাবে। গৃহিণী নিজে খেয়ে দাসীদের খাওয়াবেন। দাস-দাসীরা যখন খায়, তখন গৃহিণী যেন তাদের এটা ওটা চাই বলে আদর করতে না ভোলেন।