হালিমা : অনেক লোকের বাড়িতে অনেক যুবতী দাসী দেখেছি-তার যেকোথা থেকে এসেছে তার ঠিকানা নেই; তারা প্রভুর কাছ থেকে বেতন পায় না। কোনো কোনো গৃহিণী তাদের দয়া করে রঙ্গিন শাড়ি, হাতের চুড়ি ইত্যাদি কিনে দিয়ে থাকেন। এদের জীবনের ঠিক উদ্দেশ্য যে কী তা ভেবে কিনারা করতে পারি নে।
কুলসুম : এ সব বড় দুঃখের কথা! নিজেদের সুবিধার জন্য একটা মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেবার নিষ্ঠুর চেষ্টা। নারী যে মানুষ, রক্ত-মাংসের শরীরে তার সুখ-দুঃখ বোধ আছে–এ অনেক মানুষই ভুলে যায়। মানুষ কেন? আমাদের দরিদ্র ভগিনীদের ব্যথা আমরা নারী হয়ে ভুলে যাই–মনে করি তারা কুকুরী অপেক্ষা ঘৃণিত। সংসারে তাদের কোনো স্থান নেই–আমাদের কাছেও না। যাক এই যে যুবতী দাসীর কথা বলছ, এরা নানা উপায়ে সংগৃহীত হয়ে থাকে। বড় লোকেরা অনেক সময় টাকা দিয়ে এদের সংগ্রহ করে। কোথাও মেয়েদের চুরি করা হয়–কোথাও দরিদ্র বাপের কাছ থেকে কিনে নেওয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে স্বামীও টাকা পেলে বউকে বড় লোকের কাছে দাসীরূপে বিক্রি করে। সেইসব মেয়ে প্রায় নিদোষ কুমারী হয় না জীবনের প্রথমে কোনো মেয়ে হয়তো ভুলে বিপথে গিয়েছিল, কত বিচিত্র ঘটনার ভিতর দিয়ে শেষকালে সে দাসীর জীবন গ্রহণ করে দাসী হতে বাধ্য হয়। পশুর মতো খাওয়া ও পরের সেবা করা ছাড়া আর যে দাসীদের কোনো কাজ আছে একথা ভুলে যায়। একটা মানুষের জীবনকে এইভাবে ব্যর্থ করে দেওয়া কি পাপ নয়? এইসব দাসী যদি কোনো কেলেঙ্কারি করে, তবে তাদের যে মারে সে পশু। তাদের কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সংসারী করে দেওয়া উচিত-কাজ নিজে করা ভালো তবুও মানুষের জীবনকে অর্থশূন্য করে দেওয়া ঠিক নয়। এই পাপে মানুষ জাতির পতন হয়েছে। অভিশাপে সুবর্ণ সিংহাসন ধুলোয় মিশেছে।
হালিমা : অনেকের বাড়িতে দাসী আছে বলে গৌরব করে।
কুলসুম : তারা বড় হীন। নিজেরাই নিজেদের কাজ করাতে গৌরব। কুঁড়ের মতো বসে থাকবে-দাসদাসীতে তোমার কাজ করবে এতে কি গৌরব? পরের কাছে হীনভাবে মাথা নত করতে দোষ-মূর্খের মতো পরকে বেদনা দেওয়া দোষ–ঘুষ খাওয়া, অন্যায়ের সমর্থন করা, দরিদ্রের পয়সা নিয়ে বাবুগিরি করাতে দোষ, কাপুরুষ যারা, যাদের সমান তালি দেওয়া, তারাই নিজের কাজ নিজে করতে লজ্জা বোধ করে। বাবু, তস্কর, অত্যাচারী দারোগার বউ-এর চেয়ে সৎস্বভাবা নামাজের সংসারে কর্ম ক্লিষ্টা দরজির বউ-এর সম্মান বেশি। মানুষ ছোট হয় নিজের অজ্ঞতায়, নীচ প্রবৃত্তিতে ও মনের সংকীর্ণতায়। যে নারী বুদ্ধিমতি, বাকপটু, চরিত্রবতী, শিক্ষিতা, সে যে কাজই করুক না, যে অবস্থায়ই থাকুক না, তার সম্মুখে স্বৰ্ণবরণ শোভিত সংকীর্ণ হৃদয়া; নিরক্ষরা, পরনিন্দা চর্চাকারিণী দাসদাসী পরিবৃতা নওয়াব বধূর কোনো মূল্য নেই।
হালিমা : শুনেছি দাসদাসীরা চুরি করে খায়।
কুলসুম : সেটা ঠিক কথা। তাদের খুব অল্প করে খেতে দেওয়া হয় বলে, তারা অনেক। সময় চোর হয়। মাঝে মাঝে তাদের ভালো জিনিস খেতে দেওয়া উচিত। মাঝে মাঝে কিছু কিছু করে পকেট খরচ দেওয়া উচিত–এতে তাদের মন ও প্রবৃত্তি উদার ও উন্নত হবে। হাটবাজার নিজে করা উচিত। অনেক অপদার্থ লোক আছে যারা হাট-বাজারে যায় না বলে গৌরব করে।
হালিমা : গ্রীষ্মকালে দাসীরা মশারির অভাবে অনেক সময় খালি গায়ে রাত্রি কাটায়। অন্ধকারের জানালাহীন মশা-ভরা রান্নাঘরে তাদের থাকতে দেওয়া হয়।
কুলসুম : অর্থাৎ তারা গরুর মতোই এক-প্রকার জীব, এইরূপ ধরে নেওয়া হয়। দাসীরা মানুষ তাদের রক্তমাংসের শরীর, এটা বিবেচনা করা উচিত। তাদের মশারি, পাখা, জানালাযুক্ত ঘরে থাকতে দিলে নিজেদের সম্মান বাড়ে বই কমে না। আমরা পরাধীন জাতি। শক্তিমান ও বিত্তশালী ব্যক্তির অত্যাচার ও অন্যায় ব্যবহার দরিদ্রকে সইতে নেই। নিজেদের মর্যাদা ও দাবি বুক ঠুকে আদায় করার শক্তি আমাদের সমাজের কোনো লোকের নেই। এখানে দরিদ্র মানুষ বড়কে ‘বাপ’ ‘মা’ বলেই মনে করতে বাধ্য হয়। শাস্ত্রে আছে–বাপ মায়ের অত্যাচার নীরবে সহ্য করলে পুণ্য হয়।
হালিমা : সত্যি গরিব লোকের মেয়েরা বড় ঘরের বউকে মা বলে ডেকে, পায়ে চুমো খেয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে একেবারে মুছে ফেলে। বোন বলে সাহসের সঙ্গে বলবার অধিকার কারো নেই।
কুলসুম : এই ‘মা-বাপ’ বলে ডাকা আর পা ছুঁয়ে ছালাম করার ভেতরে তাদের মনে। যে কতখানি গভীর ব্যথা কাঁদতে থাকে, তা দৃষ্টিমান ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ টের পায় না। দাসীকে কখনও মা বলে ডাকতে দেবে না বা পা ছুঁয়ে ছালাম করতেও দেবে না, এটা অনৈসলামিক। ইসলাম ব্যক্তিত্বকে চূর্ণ করে ফেলা পাপ মনে করে। আহা, মানুষ পরিশ্রম করে দুটি অন্ন মুখে দেবে, তাতেও সে যেন কত অপরাধী! দাসীদের জীবন কত দুঃখময়। সে যে কোনোরূপ আমাদের সামনে দাঁড়াবার দাবী রাখে একথা মানি না। এদেশে দরিদ্র নরনারীর সংখ্যা খুব বেশি, সেই জন্য হয়তো দাস-দাসীর কপালে এত অসম্মান।
হালিমা : দাসী রাখতে হলে কী বয়সের দাসী রাখা হবে? কোন, দাসীটি ভালো হবে, কোটি মন্দ–জানবার উপায় কী?
কুলসুম : বুড়ো দাসী না রাখাই ভালো–তাদের ভালোমন্দ অভ্যাসগুলি এমন দৃঢ় হয়ে গেছে যে, সেগুলির আর পরিবর্তন হয় না। আশা-আনন্দহীন জীবন তাদের বড় শক্ত এবং কঠিন-ভালোমন্দ কোনো কথাই তাদের কানে পৌঁছায় না। নোংরা ম্লেচ্ছ কোনো মানুষকেও বাড়িতে স্থান দেওয়া ঠিক নয়। দাসী নিযুক্ত করবার আগে তার চেহারাটা একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, সে কিরূপ লোক; একটু কথা বললেও তার বুদ্ধি ও স্বভাব সম্বন্ধে অনেকটা ধারণা করতে পারা যায়। দাসী নিযুক্ত করবার সময় লজ্জা ফেলে তার কাজের সব কথা বলে দেবে। অনেক সময় দাসীদের সঙ্গে তার আত্মীয়-স্বজন এসে বাড়িতে দিকদারী করে। সেটা যাতে না ঘটে তা পূর্ব হতেই দাসীকে বলে দিতে হবে-হরদম নানা বিশৃঙ্খল আদেশ ও সমালোচনায় মানুষের বুদ্ধি লোপ পায়।