হালিমা : রান্না স্টোভে করলে কেমন হয়?
কুলসুম : কোনো ক্ষতি নেই। দুই-একজনের রান্না স্টোভে চলতে পারে। যে স্টোভে কালি জমে তাতে রান্না চলে না। ভাত তরকারির জন্য না হোক দুধ ও চা তৈরির জন্য স্টোভ ব্যবহার করা সুবিধা।
.
এয়োদশ পরিচ্ছদ
হালিমা : ছোঁকরাদের দ্বারা সব কাজ কি সম্ভব? মেয়ে মানুষের চাকরাণী মেয়ে মানুষ হলেই তো সুবিধে হয়।
কুলসুম : দাসীদের দ্বারা পরিবারের মধ্যে অনেক কেলেঙ্কারি হয়। তা ছাড়া বড় নোংরা–তারা যে মানুষ এ জ্ঞানও তাদের নেই।
হালিমা : দেশে অনেক মেয়ে মানুষ আছে, পরের বাড়ি চাকরি পেলে তাদের অনেক উপকার হতে পারে।
কুলসুম : অনেক দরিদ্র মেয়ে মানুষ আছে সত্যি, কিন্তু তাই বলে নোংরা চোর মেয়ে মানুষকে কী করে বাড়িতে স্থান দেওয়া যায়? ভালো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মেয়ে পেলে আপত্তি নেই।
হালিমা : দাসীদের মাইনে অনেক জায়গায় মাত্র ৩ টাকা। শুনলে হাসি পায়।
কুলসুম : দরিদ্র দেশে সবই আশ্চর্য। অভাবে মানুষ হীন ও দুর্মতি হয়ে ওঠে। সকলেরই অভাব, দয়া মায়া ও মনুষ্যত্ব একদম দেশ থেকে উঠে যাচ্ছে। সমবেত জাতির কম আয়, কারণ দেশে শিল্প বাণিজ্যের অভাব। একমাত্র ধান ও পাটের টাকা থেকে জীবনের শত অভাব ও বিশাল উপকরণ সংগৃহীত হচ্ছে বলে দেশের দারিদ্র বাড়ছে বৈ কমছে না। ভালো দাসীর মাইনে অন্তত ৪০/৫০ টাকা হওয়া উচিত। দাসী কথাটা না বলাই ভালো, তাদের জন্য কোনো সম্মানসূচক আখ্যা দেওয়া উচিত। দাসীদের সম্মান যদি বাড়ে, তা হলে দরিদ্র ভদ্র লোকের মেয়েরাও পরিচারিকারূপে পরের বাড়িতে চাকরি গ্রহণ করতে পারে।
হালিমা : কুল-কন্যারা পরের বাড়িতে পর-পুরুষের সম্মুখে কী করে বের হয়ে কাজ করবে?
কুলসুম : মেয়েদের জন্য স্বতন্ত্র অন্তঃপুর থাকাই নিয়ম। তা ছাড়া অত অবরোধের কথা ভাবলে কাজ চলবে না। প্রয়োজন হলে ভাত না থাকলে পরদা টানিয়ে লাভ কি? কৃষক মেয়েরা কাজের খাতিরে বাইরে বের হলে দোষ কি? পেটের দায়ে কাজ করে পয়সা উপায় করবার সুবিধে না করতে পেরে, বহু রমণী পতিতা হতভাগিনীর জীবন গ্রহণ করে। আহ! তাদের কথা ভাবলে চোখে পনি আসে! পরদার অর্থ বাক্সের মধ্যে বন্দি হয়ে থাকা নয়, পদার অর্থ শরম–গা ঢাকা ও পুরুষ হতে একটু দূরে থাকা। প্রয়োজন হলে মেয়েমানুষের পুরুষের মতো মাঠে কাজ করা উচিত–পথে পথে দোকান খোলা উচিত। কলকাতায় দেখেছি–ফেরিওয়ালা যে-সব মেয়েমানুষ তরিতরকারি নিয়ে বাসায় আসতে, তারা কি সব অসতী? সেদিন পাহাড়ে যে সব জুমিয়া যুবতী দেখলাম ওরা কি সব অসতী? অনেক মেয়েমানুষ ভয়ে অনিচ্ছায় বাধা দেবার শক্তি নেই বলে পাপ করে-তা জান? দেবর ভাজকে আক্রমণ করে–অন্তঃপুরে পরদার ভিতর! ভাই ভগ্নিকে কলঙ্কিত করে–সেও অন্তঃপুরে, পরদার ভিতর। অবিশ্বাস করো না এ সত্য। মেয়েমানুষকে শক্তি দেওয়া চাই–তাকে স্বাধীনতা দেওয়ার দরকার-তার মুখে ভাষা তুলে দেওয়া কর্তব্য–সে নিজের মর্যাদা নিজে বাঁচিয়ে রাখবে। কেউ খারাপ হয়-হোক-পুরুষও তো খারাপ হয়।
হালিমা : যারা পরিচারিকা হয়ে কাজ গ্রহণ করবে, তাদের সঙ্গে কিরূপ ব্যবহার করা উচিত?
কুলসুম : কোনো কোনো ভদ্রলোক চাকর-বাকরকে কুকুর অপেক্ষাও অধম মনে করেন। চাকর-বাকরেরা অমানুষ হতে পারে–কিন্তু এর কারণ হয়তো প্রভুর দুর্ব্যবহার। অনেক অসভ্যও সভ্য মনুষ্যত্ব সম্পন্ন হতে সক্ষম হয়েছে। চাকর বাকর যদি বিছানায় বসে তাতে রাগ করো না। চাকর ছাড়া বাইরের কোনো দরিদ্র কোনো ভদ্রলোকের বাড়িতে এসে চেয়ারে বসলে ভদ্রলোক তাতে অপমান কতো লজ্জা বোধ করেন। যারা হীন তারাই মানুষকে অপমান করেন। এইসব দরিদ্রের কর্তব্য এই প্রকৃতির ভদ্রলোকদের দাঁড় করে রেখে নিজেরা চেয়ারে বসে। আঘাত ছাড়া কোনো কালে কারো চৈতন্য হয় না–এটা সত্য কথা। চাকরের সাথে সদ্ব্যবহার করলে জাত যায় না। ঘৃণা করে ছোট বলে গালি দিয়ে মানুষকে সত্যকার ভালো করা যায় না। মানুষের মধ্যে যে সুবুদ্ধি আছে সব সময় তার দোহাই দিয়ে কাজ করতে হবে। চাকর যদি চেয়ারে বসে তাতে কি ক্ষতি হয়? চাকরাণী। যদি তোমার মখমলের বিছানায় শোয় তাতে মনে মনে কষ্ট বোধ করো না। চাকর-বাকর তাদের কাজ বা সেবার মূল্য নেই-সেবা করে বলেই সে ছোট হতে পারে না। জ্ঞান, বুদ্ধি ও ব্যবহারে সে ছোট হতে পারে-চাকর বলে সে ছোট নয়। যার জ্ঞান নেই, যার ব্যবহার অমার্জিত তার সঙ্গে ভালো কথা বলে তাকে সম্মান করলে দিন দিন তার মনের উন্নতি হয়। চরিত্র ও বুদ্ধিতে সে ছোট; এ কথা ঢেকে ফেলতে সে সচেষ্ট হবে দেশের শ্রেষ্ঠ লোকেরা যদি দেশের ছোট ও দীন-দরিদ্রের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন–যদি তাদের সুবুদ্ধির দোহাই দিয়ে কাজ করতে চেষ্টা করেন তা হলে জাতির উন্নতি অল্প সময়ে হওয়া সম্ভব।
হালিমা : দাস-দাসীদের পোশাক-পরিচ্ছেদ কীভাবে দিতে হবে? ছোঁকরা চাকর কাপড় পেলেই পালিয়ে যায়।
কুলসুম : দাস-দাসী শব্দ দুটি ব্যবহার না করাই ভালো। অপেক্ষাকৃত সম্মানসূচক দুটি শব্দ বেছে বের করতে পারলে ভালো হয়। খাদেম-খাদেমা বলা যেতে পারে। পরিচারক, সহচর, লাড়কা সহচরী, মেয়ে বাবুর্চী এইরূপ ধরনের নামও মন্দ নয়! কাপড়-চোপড় দাস দাসীকে না দেওয়াই উচিত। মাইনে কিছু বেশি ধরে দিলেই হয়, কাপড়, দেওয়ার দায় হতে মুক্তি পাওয়া যায়। পরের কাছ থেকে কাপড় পেলে দাস-দাসীদের মনের অবনতি ঘটে। ফলে তারা নীচ প্রবৃত্তি হয়ে পড়ে।