হালিমা : ভাবি, দয়া করে আমাকে শিখিয়ে দিন কী উপায়ে স্বামীর শ্রদ্ধা চিরকাল সমভাবে লাভ করা যায়। এত প্রেম ও প্রণয় সবই কি ফাঁকি?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে অনেক কথা বলা দরকার। এখন সন্ধ্যা হয়েছে, চল নিচে যেয়ে নামাজ পড়ি।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
রাত্রি এগারটার সময় আকাশে দু-একটা তারা দেখা যাইতেছিল। হালিমার মা আপন মনে মধুর কন্ঠে কোরান পাঠ করিতেছিলেন।
হালিমা তার ভাবির কাছে তখন শুইয়াছিল। জানালা দিয়ে মন্দ মন্দ সমীরণ, বহিতেছিল। হালিমা জিজ্ঞাসা করিল–ভাবি, যুবক-যুবতীর মধ্যে এই যে প্রেম প্রণয় এসব কি মিথ্যা?
কুলসুম : মিথ্যা নয়, প্রেমের মধ্যে যেটুকু শান্ত ও স্নিগ্ধ সেইটুকুই খাঁটি। প্রথম বয়সের মোহটুকু সাধারণ প্রেম নামে যুবক যুবতীর কাছে সমাদৃত। এই মোহ বেশিদিন টেকসই হয় না, তবে এই মোহকে আমি অশ্রদ্ধার চোখে দেখি না। মোহকে প্রেমে পরিণত করতে হবে, এই জন্য সাধনা চাই।
হালিমা : মোহ কি একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিন।
কুলসুম : মোহ একটা উদ্দাম আবেগ-মনের মিথ্যা চাঞ্চল্য। ”তোমাকে না দেখলে থাকতে পারি না, তুমি আমার চোখের তারা তোমাকে আলতা পরিয়ে রানীর বেশে দেখতে চাই”–এসব মোহের কথা। আর প্রেম সে তত বাচাল নয়, প্রিয়তমের মঙ্গল, সুখ ও শান্তিই প্রেমের আকাক্ষিত বস্তু।
হালিমা : মোহ তাহলে ভালো জিনিস নয়?
কুলসুম : ভালো নয় সত্য, খারাপ বলেও মনে করতে নেই। স্বামী যদি এই মোহের মদিরা দিয়ে স্ত্রীকে পূজা করতে আরম্ভ করেন তো খুব সরল মনে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। স্বামীমোহ শেষকালে অবহেলায় পরিণত না হয়ে যাতে শ্রদ্ধায় পরিণত হতে পারে।
হালিমা : কোনো পুরুষই বিবাহের সময় ইচ্ছা করেন তা তাঁরা স্ত্রীকে শেষে ঘৃণা করবেন, বরং ইচ্ছা করেন তার স্ত্রীকে রত্নসিংহাসনে বসিয়ে নিজে দাস হয়ে স্ত্রীর চরণ পূজা। করবেন। মনের নেশা চাঞ্চল্য যখন কেটে যায়, তখন তিনি স্ত্রীর ব্যবহার অজ্ঞাতসারে লক্ষ। করতে থাকেন। যেমন স্ত্রীলোক ভাগ্যহীনা তারাই স্বামীর মনের এই পূজার ভাবকে না বুঝে দলিয়ে দেন। যারা চালাক তারা সদ্ব্যবহারের দ্বারা স্বামীর নাকে রসি লাগিয়ে রাখেন। স্বামীর নেশা কেটে গেলেও ক্ষতি হয় না। স্বামী স্ত্রীকে প্রতি শ্রদ্ধার অর্ঘ্য দিয়ে পূজা আরম্ভ করেন। পুরুষের নেশা যখন কেটে যায়, উদ্দাম আবেগের আগুন যখন নিবে যায়, তখন। তিনি সুবিধা পেলে অর্থাৎ স্ত্রীর উপর রিবক্ত হবার পথ পেলে স্ত্রীকে অবহেলা করেন। বুদ্ধিমতী, সৎস্বভাব স্ত্রী স্বামীকে সদ্ব্যবহারে মুগ্ধ করে রাখেন। স্বামী স্ত্রীকে অশ্রদ্ধা করতে বা কঠিন কথা বলতে সাহস পান না। তাঁর ভালবাসা অক্ষুণ্ণ থাকে স্বামীর মনের মত্তা মন্দীভূত হলেও স্ত্রীর কৌশলে না নূতন করে জেগে উঠে।
হালিমা কহিল : ভাবি, ঘোমটা জিনিসটা কী? নববধূরা স্বামীর সম্মুখে মুখ খোলেন–এতে কি কোনো লাভ আছে?
কুলসুম : ঘোমটা টেনে স্বামীর মনের ক্ষুধা বা পিপাসা বাঁচিয়ে রাখা আমি পছন্দ করি। নে। ছেলে-মেয়ে না হওয়া পর্যন্ত অনেক মেয়েরা স্বামীর কাছে ধরা দেয় না, এইভাবে মুখ ঢেকে রাখলে স্বামী মনে করেন, ওখানে যেন কি আছে।
হালিমা : ঘোমটা টানাটানি এক ভয়ানক ব্যাপার–যেমন বিরক্তিকর, তেমনি অসুবিধাজনক।
কুলসুম : অভ্যাসে সব ঠিক হয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে হলেও কি স্বামী-স্ত্রীর বিরক্ত হতে পারেন না? যে সমস্ত স্ত্রীলোক স্বামীর ভালবাসার অপেক্ষা না করে ভাত-কাপড়ের জন্য। স্বামী গ্রহণ করে তারাই ছেলে-মেয়ে হওয়া পর্যন্ত স্বামী বশে রাখবার জন্য এই কৌশল করে। ছেলে হলে কিন্তু স্বামী মনে মনে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট থাকলেন, দায়ে পড়ে স্ত্রীর ভাত কাপড় যোগালেন, এতে স্বামী স্ত্রী সুখ পান না। ছেলে হওয়া পর্যন্ত ঘোমটা টানাটানি, তারপর আবার স্বামীর ভালবাসার তোয়াক্কা না করা বুদ্ধিহীন রমণীদের কাজ।
হালিমা : স্ত্রীলোক স্বামীর প্রেমকে গ্রাহ্য করে না, এও কী সম্ভব?
কুলসুম : এমা! বার আনা স্ত্রীলোকই এইরূপ। স্ত্রীলোকের অমনোযোগ ও বেপরোয়া ভাবের ফলে অনেক স্বামী বিরক্ত হন, এমন কি অনেকে চরিত্রহীন হয়ে যান। নিজের নিবুদ্ধিতার দোষে রমণীদের কপাল যখন পুড়ে যায়, তখন তারা কাঁদতে থাকেন, তখন কাদলে কোনো লাভ হয় না। স্বামী যে স্ত্রীকে কটু কথা বলেন না স্ত্রীকে অবহেলা করেন, এর জন্য স্ত্রীলোকেরাই সাধারণত বেশি দোষী। অবশ্য সব জায়গায় একথা খাটে না।
হালিমা : তাহলে আপনি স্বামীর সম্মুখে মুখ ঢেকে রাখবার পক্ষপাতী নন?
কুলসুম : মোটেই না, স্বামীর সম্মুখে মুখ মাথা সবই খুলে রাখতে হবে। লোকের সামনে কিন্তু মাথা খুলতে নেই। একাকিনী যখন স্বামীর কাছে থাকবে, তখন গা মাথা কাপড় দিয়া মুড়ে একটা পোটলা বিশেষ হয়ে থেকো না। রমণীর সাজসজ্জা, রূপ, গহনা সব স্বামীর মনস্তুষ্টির জন্য। এতএব স্বামীর চোখ থেকে নিজেকে ঢেকে রেখে পাড়ার। মেয়েদের সামনে রূপ আগলা করে বেরিয়ে লাভ কী? ঘোমটা টেনে স্বামীর মনকে জয় করার কাজ নেই।
হালিমা : আচ্ছা বিয়ে তো হয়ে গেল, তারপর বাসরঘরে আমাকে সবাই নিয়ে যাবে, তখন কী করবো?
কুলসুম : ধীরে ধীরে যাবে। কোনো কোনো মেয়ে বাসর ঘরে কিছুতেই যেতে চায়। স্বামী যদি বুঝতে পারেন যে তার স্ত্রী তার কাছে আসতে খুবই বিরক্তি প্রকাশ করছে তাহলে তিনি মনে মনে বিরক্ত হবেন। ধীরভাবে, ঘরে ঢুকে স্বামীর পার্শ্বে বসে পড়াই বিধি।