হালিমা : সে গুলি কী কী?
কুলসুম : ভাত, মাংস, ভাজি, এ তো সাধারণভালো খাবার বললে পোলাও, কোর্মা ক্ষীর, দুই একরকম মিষ্টান্ন-এর বেশি নয়।
হালিমা : রান্নার কাজ কে করবে! রান্না করলে কি সম্মান হানি হয়?
কুলসুম : রান্না করলে সম্মান হানি হয় না। দাস-দাসীর উপর ভর দিয়ে রান্নার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা গৃহিণীর উচিত নয়। মন যাদের ছোট–যারা হীন স্বভাব, তাদের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার প্রতি বিশেষ নজর থাকে না। দাস-দাসীরা অশিক্ষিত নীচমনা–তাদের কাজ-কাম পরিষ্কার নয়। তাদের উপর যদি রান্নার ভার দেওয়া হয়, তা হলে অজ্ঞাতসারে তোমার পেটের ভিতর কত কি যাবে তা আর কি বলব। হীনা স্ত্রীলোক চাকরাণীকে মোটেই বিশ্বাস করতে নেই। পুরুষ খাসামাকেও বিশ্বাস করা উচিত নয়। শিক্ষিত বুদ্ধিমতী নারীর হাত ছাড়া অন্য কোনো রমণীর হাতের জিনিস খাওয়া ভালো নয়।
হালিমা : নওয়াব বাড়ির মেয়েরা কি নিজে রান্না করেন?
কুলসুম : অপদার্থ লোকেরা মনে করে, নওয়াব পরিবারের মতো মহাকুলীন আর কেউ নয়। আমি তাদের সঙ্গে মিশি নি–আমার মনে হয় নওয়াব পরিবারের কি পুরুষ, কি নারী, কারো মন উন্নত নয়। সেখানে মনুষ্যত্ব ও উচ্চচিন্তার বিশেষ আদর নেই। টাকার জোরে শান-শওকত রক্ষা করে তারা চলে–তাই দেখে মূর্খ লোকেরা ভয় পায়। নওয়াব বাড়ির মেয়েরা পান খায়, অলসের মতো পিকদানিতে থু থু ফেলে, বিছানায় বসেই হাত ধোয়। আমার বিশ্বাস তারা যেমন বোকা, তেমন সঙ্কীর্ণরূপে বেহিসেবী এবং অহঙ্কারী গাধার পিঠে জরির গদি যেমন, অশিক্ষিত নওয়াব নন্দিনী গায়ের গয়নাও তেমনি। নওয়াব বাড়ির মেয়েদের কথা বলো না, তারা সাধারণের কৃপার পাত্র।
হালিমা : রান্না মেটে হাঁড়িতে করা ভালো, না লোহা-তামার পাত্রে করা উচিত।
কুলসুম : মেটে হাঁড়ি আদৌ ব্যবহার করা উচিত নয়। গরিব লোক যারা তারা পয়সা জমিয়ে লোহা বা তামার দু-একখানা পাত্র ইচ্ছা করলে কিনতে পারে। যাদের হাতে দুপয়সা আছে, তাদের পক্ষে তো কথাই নেই। পানি ঠাণ্ডা রাখার জন্য কলসি রাখা যায়। পানি খাবার কলসি ছাড়া বাকি সব কলসিগুলি পিতলের হওয়া উচিত। মেটে হাঁড়ি-কলসি বছরে যে পয়সার কিনতে হয়, তার হিসেব রাখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। একটা পিলটার বোতল কিনলে খুব ভাল হয়, দাম বেশি নয়। একটা বোতল অনেক বছর চলে। ফিলটার বোতলে পানি ঠাণ্ডা ও পরিষ্কার দুই-ই হয়। পল্লী গ্রামের অপরিষ্কৃত পানিই অনেকের মৃত্যুর কারণ অথচ পল্লীবাসীরা একথা বিশ্বাস করে না। কলেরার সময় প্রত্যেক বাড়িতে এক একটা ফিলটারের বোতল থাকা চাইই-চাই। গরিবেরা অন্তত মেটে কলসির ফিলটার বানিয়ে নেবে।
হালিমা : শুনেছি মেড়োরা তেল খায় না, তেলের গন্ধ নাকি তারা সহ্য করতে পারে, কেবল ঘি খায়।
কুলসুম : ঘি যত ব্যবহার করা যায়, ততই ভালো। আজকালকার দিনে জিনিসপত্রে বড় ভেজাল আরম্ভ হয়েছে। কাউকে বিশ্বাস নেই; বাজারে ঘি. এর ভিতর মরা মানুষের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? সাপের চর্বি যে নেই, তা কে জানে? চর্বি তো আছেই-গোয়ালাকেও বিশ্বাস নেই। সেদিন উমাচরণ গোয়ালা খানিকটা ঘি দিয়ে গিয়েছিল-তাতে এত দুর্গন্ধ যে আমি একেবারে বিস্মিত হয়ে গেলাম। প্রত্যেক পরিবারের দু-চারটি গাই পোষা উচিত। দুধ ও ঘি ছাড়া মানুষের শরীর ধ্বংস হয়ে যায়। বাঙালি সব কথা ভাবে, কিন্তু শরীরের কথা ভাবে না। রাতদিন পড়ে টাকা উপায় কর-সম্পত্তি বাড়াও, অবসর মতো দেশসেবা কর–সকলেই শুধু এই কথা বলে। শরীর রক্ষা কর এ কেউ বলে না। ভালো খাবার বা শরীর রক্ষা করার যে আবশ্যকতা এ কেউ জানে না। বাল্যে ভালো খাবার না পেলে শরীর ধ্বংস হয়ে যায়, সারা জীবন ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে থাকতে হয়। মেড়োরা। তেল ব্যবহার করে না। তার কারণ তারা মাছ খায় না। আমরা তেল ব্যবহার না করে পারি নে–এই সরিষার তেলেও ভেজাল আরম্ভ হয়েছে! জমিনে বেশি করে সরষে বপন করা। উচিত। কলুর বাড়ি থেকে সরষে ভাঙ্গিয়ে আনলে চমৎকার তেল পাওয়া যায়! বাজারের তেলে কোনো বিশ্বাস নেই। গোয়ালাকে দূর করে তাড়িয়ে দিয়ে ভদ্রলোকের ঘি তেলের ব্যবসা আরম্ভ করা উচিত। জাতির জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়ে সকলেরই মনোযোগ দেওয়া উচিত। আমাদের খাবার উপকরণ, যা আমরা বাজার হতে সংগ্রহ করি–তা যদি শিক্ষিত ব্যবসায়ীর হাত থেকে পাবার সুবিধে পেতাম, তা হলে বড়ই ভালো হতো।
হালিমা : রান্না যাদি গৃহিণীকেই করতে হয়, তা হলে তাকে যে রাতদিনই ঐ কাজ করতে হবে, একটুও বিশ্রাম উপভোগ করবার উপায় থাকবে না। যে পরিবারে দশ-বারজন লোক, সে পরিবারের কাজের চাপ বড় বেশি, দাস-দাসী ছাড়া এক গৃহিণীর পক্ষে এতকাজ করা কি সম্ভব? কাজ করতে করতেই জান বেরিয়ে যাবে, স্বামীর সঙ্গে প্রণয় হবে কোন সময়? অবসন্ন ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা হয় কি?
কুলসুম : যাদের ভালবাসি, যারা আমার অতি প্রিয়তম, তাদের জন্য কাজ করতে কোনো কষ্ট হয় না। স্বামীর প্রণয় চুম্বন, তাঁর প্রগাঢ় ভালবাসা নারীর হৃদয়ের সর্বদা শক্তি দান করে, কোনো কাজে স্ত্রীর কষ্ট হয় না। স্বামীরও কর্তব্য স্ত্রীর সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা। নীচমনা দাসী না রাখাই ভালো, কিন্তু ছেলেপেলে হলে তাকে রাতদিন রাখার জন্যে-সামর্থে কুলায় এমন একটা চাকরাণী চাই। নইলে মায়ের জীবনে সুখ-শান্তি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়। রান্নার কাজে সাহায্য করবার জন্য একটা বালক ভৃত্য দরকার। জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া, পানি ঢেলে দেওয়া, আবর্জনা জমা হওয়ামাত্র সেগুলি ফেলে দেওয়া, দোকান থেকে জিনিস আনা, মরিচ পেষা–এইসব কাজ সে করবে। শুধু রান্নাবান্নার কাজে সে সাহায্য করবে। একজনের দ্বারা যদি কাজের সুবিধা না হয়, তা হলে আরও একটা ছেলে চাকর রাখতে হবে। নিজের কোনো দরিদ্র আত্মীয় থাকলে তার দ্বারাও রান্না চলতে পারে।