হালিমা : নিশ্চয়ই।
কুলসুম : অনেক বাড়িতে পান, চুন ও সুপারির কী অবস্থা হয় জান?
হালিমা : না।
কুলসুম : গৃহিণীর সম্মুখে পান পচে, চুন শুকিয়ে যায় ও সুপারি গড়িয়ে বাইরে পড়তে থাকে, কেউ দেখে না।
হালিমা : গৃহিণী বুঝি পান খান না।
কুলসুম : ফরমাইস করলেই যখন নতুন আসে, তখন আর এতে চিন্তার কারণ কী?
হালিমা : আশ্চর্য কথা!
কুলসুম : আরো শোন–অনেক বাড়িতে সারারাত্রি বাতি জ্বলতে থাকে, গৃহিণী তা গ্রাহ্য করেন না। বৃথা তেল পোড়ান কী ভালো?
হালিমা : না, তাতে খরচ বাড়ে।
কুলসুম : নির্জন কামরায়–স্বামী-স্ত্রী ছাড়া যেখানে আর কেউ থাকে না–সেখানে রাত্রিকালে একটি ক্ষীণ প্রদীপ জ্বলতে থাকলে বিশেষ ক্ষতি নেই।
হালিমা : গ্রামে সেইরূপ হওয়া উচিত নয়।
কুলসুম : যে পরিবারে স্বামী স্ত্রীর সম্মানের প্রতি কারো বিশেষ লক্ষ্য নেই–সেখানে ভয় করেই চলতে হবে।
হালিমা : এটা বড় বিরক্তিকর।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–মেয়েদের আর একটা অভ্যাস আছে তারা স্বামীকে সর্বদা পুরানো গয়না ভেঙ্গে নতুন রকমে গড়ে দেবার জন্য অনুরোধ করেন। নাকের ফুল, গলার হার, কানের মাকড়ি, হাতের বালা, কটির মেখলা যেমন করেই গড়ে দেওয়া হোক না–কিছুদিন ব্যবহার করে গৃহিণী স্বামীকে অনুরোধ করেন–এইরূপ নয় ঐ যে আমির মিঞার বিবির গায়ে যেরূপ দেখলাম, অমনধারা করে গড়ে দিতে হবে। কিছুদিন পরে আবার নতুন ফরমাইস হবে। বেচারা স্বামীকে জব্দ করা ছাড়া এ আর কি?
হালিমা : দাদীর একটা গায়ের কাপড় আছে, সেটা নাকি পনর বৎসর আগে কেনা হয়েছিল–কোনো দিন সেটা তিনি ব্যবহার করেন না। ব্যবহার যদি করা না হবে, তবে এইভাবে জিনিসপত্র কিনে পয়সা নষ্ট করে লাভ কী?
কুলসুম : কোনো লাভ নাই। মেয়েদের অভ্যাস, তারা জিনিসপত্র কিনবে, গয়না পরবে, কিন্তু ব্যবহার করবে না। বছরে এক বা দুই দিন তোক দেখানোর জন্য শাড়ী-গয়না পরা নীচতা। বাইরে সাত লোকের কাছে যত সাদাসিদে হয়ে বের হওয়া যায় ততই ভালো। শুধু লোককে দেখাবার জন্য পয়সা ব্যয় করা ঠিক নয়। অনেক মানুষ বিলাস উপকরণ যোগাড়ে পথের ফরিক হন–সম্মান চটকে বাড়ে না–সম্মান হয় জ্ঞানে, পবিত্রতায় ও মনের শান্তিতে। এ হতে আবার মনে করো না, শুধু সম্মানের জন্য মানুষকে জ্ঞানী ও পবিত্র হতে হবে। জ্ঞানী, চরিত্রবান ও নীতি-শক্তিতে বলীয়ান হলে সম্মান আপনি এসে জোটে।
হালিমা : চটক দেখাতে গিয়ে অনেকে ফকির হয় নাকি?
কুলসুম : গয়না পরে চটক দেখানোতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই। গয়নার পয়সা নষ্ট হয় না–ঘরেই থাকে। অনেকে স্ত্রীর গয়নাকে সম্পত্তির মধ্যে ধরেন। এইভাবে সম্পত্তি করার কোনো অর্থই নেই। স্ত্রীকে গয়না দিতে হবে না–এ আমি বলছি না। গয়নাকে সম্পত্তিরূপে মনে করা বোকামি।
হালিমা : গয়না পরে চমক দেখানোতে বিশেষ ভয় নেই কেন?
কুলসুম : না এতে ভয় নেই,তবে হরদম নতুন নতুন অলঙ্কার তৈরি হচ্ছে কেবল বাক্সে তুলে রাখবার জন্যে! গয়না তৈরির টাকা ব্যাঙ্কে রাখা হয় তবে তা দেশের ও দশের কাজে লাগে।
হালিমা : সব কাজেরই একটা সীমা আছে। যেগুলি মানায় এবং পরিমিত বলে মনে হয় এমন কতকগুলি গয়না গড়ালেই চলতে পারে।-কেমন?
কুলসুম : হ্যাঁ তাই কিরূপে চটক দেখাতে গিয়ে মানুষ ফকির হয় বলছি, শোন–সংসারে খাবার পরার দরকারই বেশি এই কথা ভুলে-ভবিষ্যতে খোদার ঘাড়ে সোপর্দ করে বোকার মতো অনেক মানুষ বাহুল্য ব্যয় করে। কাপড়ে-চোপড়ে, নাচে তামাসায়,বন্ধু মহলে অনেক নরনারী অজস্র টাকা ব্যয় করে সর্বস্বান্ত হয়। অবশ্য পয়সা থাকলে হিসেব মতো কাপড়-চোপড় বা কোমা-কালিয়া খাওয়া, তামাসা-উৎসবে বা বন্ধুমহলে ব্যয় করা দোষাবহ নয়; বিশেষ করে খাদ্য সম্বন্ধে ব্যয় যত বেশি সম্ভব তা করা উচিত। বলছি আয় বুঝে ব্যয় করতে হবে। অনেক নারী পরিবারের খাবার পরবার টাকা। কোথা হতে আসে কোন খবর রাখেন না। স্বামী যোগাড় করতে না পারলে স্ত্রী ভাবেন এটা স্বামীর চালাকি। ছেলেদের ছাতা, জামা, জুতা, নিজের গয়না, ময়দা, চিনি, লুচি, হালুয়া এবং মুরগীর ফরমাইস দেবার আগে বধূ যেন ভবিষ্যতের কথা ভাবেন, স্বামীর আয় সম্বন্ধে একটু হিসেব করে দেখেন!
.
দ্বাদশ পরিচ্ছেদ
কুলসুম কহিলেন–কার বাড়িতে কেমন রান্না হয়, গৃহিণী কত রকম খাদ্য ও আচার প্রস্তুত করতে পারেন, এই দেখে অনেক লোক পরিবারের কদর সম্বন্ধে ধারণা করে, এটা কিছু নয়। রান্নার মধ্যে মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব খুঁজতে না যাওয়াই ভালো
হালিমা : তা ঠিক, রান্না করতে জানাই যদি মনুষ্যত্বের নিদর্শন হতো, তা হলে বাবুর্চির দলকে বেশি সম্মান করা কর্তব্য।
কুলসুম : কোনো কোনো মেয়ে অনেক রকম জিনিস তৈরি করতে জানে বলে লোকের কাছে গর্ব করেন। তাদের মন কত ছোট–তারা সংসার ও জ্ঞানের কোনো খবর রাখেন না, এজন্য লজ্জা বোধ করেন না। ভালো রান্না করতে পারা মেয়েদের এটা গুণ–তাই বলে এতে গৌরবের কিছু নেই।
হালিমা : আমার বোধ হয় অনেকে আজকাল কেবল খাবার চিন্তায় ব্যস্ত।
কুলসুম : কত রকম পেট ও জিহ্বার সেবা করা যায়, তার লিস্ট শুনলে হাসি পায়। জিহ্বা ও পেটের সেবা বেশি রকম আরম্ভ হয়–মানুষের যখন নৈতিক অধঃপতন হতে থাকে। মোটামুটি কয়েক রকম খাদ্য ব্যবহার করা যেতে পারে-তার বেশি একদম বাদ দেওয়া উচিত।