কুলসুম : এতে নিষ্ঠুরতার কিছুই নেই–ভিন্ন ভিন্ন হয়েও একজন অন্যজনের সহায়তা করতে পারেন। না করলে ভয়ানক অন্যায় হবে। কাজের সুবিধার জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র খাবার। ব্যবস্থা ছাড়া এ আর কি, ভাগ হয়ে গেলে মানুষের চৈতন্য হয়। কুঁড়েমি করে উদাসীনতা দ্বারা জীবনকে হীন করে দেবার লোভ দূর করে। পরের ঘাড়ে চড়ে খাওয়া আর একটু শুকিয়ে মরা নিজের কাছে বিরক্তিকর ও অন্যায়। বিলাতে ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই স্বতন্ত্র ব্যবস্থা বা পরিবারের সৃষ্টি হয়। আমরা অতদূর যেতেই পারি না। মা-বাপকে ছেড়ে নতুন ব্যবস্থা করা আমরা অধর্ম মনে করি। এদেশের মাতা-পিতা ছেলেপিলেকে লেখাপড়া শিখান, ভবিষ্যৎ জীবনে ছেলেদের সম্মান ও সুখের অংশী হবার জন্যে। উন্নত দেশে বাপেরা ছেলেকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত হলে তারা সুখী হন–অধিক চান না। তাঁরা খাবার বা সম্মানের লোভ করেন না। কারণ তারা বড় মানুষ।
হালিমা : তৈরি জিনিস কাকে কতটুকু দিতে হবে?
কুলসুম : তার একটা বাধাধরা নিয়ম নেই। ছেলেরা বারে বারে চায় সুতরাং তাদের অল্প অল্প করেই দিতে হবে। গৃহিণী যাকে যা দেওয়া ঠিক মনে করেন, তাই দেবেন, এ সম্বন্ধে কোনো বাঁধাধরা নিয়ম বলে দেওয়া যায় না। পরিবারের কর্তা যিনি, তিনি নিজে ইচ্ছা করে বেশি খেতে ন চাইলেও তার খাওয়া-দাওয়ার দিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখা উচিত। সব দিয়ে নিজে কিছু খাবে না তাও ভালো নয়। স্বামী অনিচ্ছা প্রকাশ করলে তাকে অনুরোধ করে খাওয়াবে। অন্তরের ভালবাসা কাজে প্রকাশ করে দেখাবে। অন্তরে-ভালবাসা। আছে–বাইরে কোনো কাজে তার প্রকাশ নেই-এরূপ ভালবাসার কোনোই মূল্য নেই। অকৃত্রিম বন্ধু যিনি, তাকে খাওয়াতে হবে–উপহার দিতে হবে। পরম অত্মীয় বা পরম বন্ধুকে, সামান্য হলেও উপহার দিয়ে এবং খাইয়ে মায়ার পরিচয় দিতে হবে।
হালিমা : অনেক বাড়ি দেখেছি-ভাত তরকারি পচে যাচ্ছে–বাইরে পড়ে থাকে–কাক-কুকুরে খেয়ে যায়।
কুলসুম : আহ, এ বড় অন্যায়-বড় গোনাহ্। ভাত তরকারি কখনও ফেলে দেবে না। নিজেরা না খেতে পার–যত্ন করে তুলে রেখে কোনো দরিদ্রকে দিয়ে দেবে। বস্তা বস্তা ভাত তরাকরি পচান-বড় অন্যায়। হিসাব করে রান্না করলে ভাত নষ্ট হতে পারে না। বাসি তরকারি ফেলে না দিয়ে গরম করে ব্যবহার করা যায়। শরীর খারাপ হবার সম্ভাবনা। হলে বাসি না খাওয়াই উচিত। ডাল, তরকারি পেয়ালা ছাড়া ভাতের উপর দিতে নেই, যাকে যতটুকু দেওয়া দরকার একবার দিয়ে বলে দেবে–এই শেষ। যে খায় তার মুখে অনবরত এ দাও, আর একটু চাই,-এ-সব ভালো নয়। যত পাওয়া যায় ততই খেতে ইচ্ছা হয়। প্রত্যেক কাজেই সীমা বা সংযম রক্ষা করতে হবে-সংযমই সুখ-শান্তির মূল।
হালিমা : ধান চালের বিনিময়ে জিনিসপত্র কেনা কি ভালো?
কুলসুম : সর্বনাশ, অমন কাজ করতে নেই! জুয়াচোর ফেরিওয়ালারা মূর্খ মেয়েদের কাছ থেকে চাল-ধান বা অন্যান্য দ্রব্য দিয়ে জিনিসের চতুগুণ দাম আদায় করে।
হালিমা : আবশ্যক না থাকলেও হাতে পয়সা থাকলে সস্তা পেলে কোনো জিনিস দেখলে, কোনো ভালো নয় কি?
কুলসুম : বড় খারাপ। মনে কর মাছ দরকার নেই, কেউ মাছ নিয়ে বাড়িতে হাজির হল। তুমি মাছ দেখে লোভ সংবরণ করতে না পেরে বললে মাছ দাও, নেবো। মিঠাইওয়ালা এসে হাজির হল–তুমি আর ঠিক থাকতে পারলে না–হাতে পয়সা আছে কিনা সে জ্ঞানও নেই, কিনে ফেললে দুই সের; এক চতুর মনোহরী দ্রব্য বিক্রেতা কতগুলি মনভুলানো জিনিসপত্র এনে তোমাকে সহজেই ভুলিয়ে ফেলতে পারে। সংসারের কত্রী হচ্ছেন গৃহিণী। যদি খরচপত্র সম্বন্ধে বেহিসাবী হন, তা হলে পরিবারের উন্নতি হয় না। বেহিসাবী গৃহিণীদের দোষে অনেক পরিবারের বড় শোচনীয় অবস্থা হয়।
হালিমা : ছেলেদের বা নিজের কখানা কাপড় থাকা দরকার?
কুলসুম : এ সম্বন্ধে ঠিক করে কিছু বলা কঠিন। অনেক কাপড় থাকা অন্যায়, এ আমি বলি না। অনেক মেয়ে আছে তারা প্রচুর কাপড় কেনে কিন্তু ব্যবহার করে না–নতুন নতুন কয়েকদিন ব্যবহার করে তারপর হয়ত শুধু শুধু বাক্সবন্দি করে রাখে! দরিদ্র স্বামীর পয়সা অপব্যবহারে তাদের একটুও কষ্ট হয় না। মূর্খ যেমন, তার মনে না আছে দয়া-না আছে তার হিসাব। ছেলের অনেক কাপড় আছে, তবুও গৃহিণী অনেক সময় হুকুম দেয়, আরো কাপড় চাই। কোনো কোনো মেয়েকে দেখেছি, তারা গায়ের জামা, সেমিজ এবং দামি শাড়ি দিয়ে থোকার বিছানা রচনা করেন। কখনও সেগুলি দিয়ে পা মুখ মোছা হয়। কী বিড়ম্বনা!
হালিমা : আশ্চর্য!
কুলসুম : লেখাপড়া না জানলে মানুষের কত যে মতিভ্রম হয় তার কি ইয়ত্তা আছে? জ্ঞান ব্যতীত মানুষ অসভ্য হয়। বাপ-মা মেয়েদের লেখাপড়া শিখান না, ফলে মেয়েরা পুরুষ সমাজের দুঃখ বাড়িয়ে দেয়। দুই-একটা মেয়ে আপনা-আপনি গুরুজনের মৌখিক শিক্ষা ও তাড়নার ফলে কিছু সভ্য হয় কিন্তু কয়েকটা মেয়ে তো আর বঙ্গের ঘরে ঘরে যেতে পারে না।
হালিমা : লেখাপড়া শিখলে প্রত্যেক কাজে বিবেচনা আসে–কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, ঠিক করে নেওয়া যায়।
কুলসুম : সব কাজে হিসাবের পরিচয় দিতে হবে যেমন আয় ঠিক তেমনি ব্যয় করা চাই। বিয়ে করে পুরুষ স্ত্রীর দাস হয় না, তার প্রতি স্ত্রীর সহানুভূতি থাকা আবশ্যক। নইলে স্ত্রীর জীবেনের সার্থকতা কী? পুরুষ গোল্লায় যাক, তাতে আমার কি-এরূপ চিন্তা করে রমণীর মনে স্থান দেওয়া ঠিক নয়! জিহ্বাকে প্রশ্রয় দাও, যখন যা মনে সে তাই কর, সংসারের ব্যয় সম্বন্ধে কোনো হিসাব রাখো না–এতে জীবনে দুঃখ বাড়বে বই কমবে না, সংসার রসাতলে যাবে। মাথায় কোনো ব্যারাম নেই তুবু শিশি শিশি গন্ধতেল কেনা কি দরকার? এত পয়সা আয়ের পথ কোথায়? অবশ্য সখ করে মাসের মধ্যে দু-একদিন ব্যবহার করা যেতে পারে স্ত্রীর বেহিসাবী চালচলনের জন্য স্বামীকে একজন আস্ত চোর হতে হয়। অনেক নারী আছেন যারা নিজের গয়না ও খরচের সুবিধের জন্যে প্রকারান্তরে স্বামীকে অত্যাচারী ও ঘুষখোর হতে উৎসাহ দেন। হিসেব মতো জিনিসপত্র করলে সংসারে দুঃখ প্রবেশ করে না। ঘরের জিনিস আছে-ফুরিয়ে গেলে ভারে ভারে আবার আসবে–অতএব ভয় কি-দেদার খরচ কর, ফেলে দাও-কাক-কুকুরে খেয়ে যাক–যে মেয়ে এইরূপ কাজ আরম্ভ করেন তিনি বড় অবোধ-অল্প দিনেই তিনি দুঃখে পড়েন।