হাফিজ, রহিমা, কুলসুম ও হালিমা লতাপাতার ভিতর দিয়া মাথা নোয়াইয়া দেখিতে লাগিলেন।
হালিমার মুখোনি তখন প্রসন্ন ও ঈষৎ হাসিমাখা। উল্লাস চাঞ্চল্যে চোখে-মুখে-রক্ত লাবণ্য বিন্দু বিন্দু মুক্ত সদৃশ ফুটিয়া উঠিয়াছিল।
বনান্তের ফাঁক দিয়া কপাল ও চিবুকে সূর্যরশ্মি পড়িয়া তাহাকে অভিনব করিয়াছিল। তোফেল শিকার টানিয়া আনিল। ছোট একটা হরিণ-সেটা ছাগলের মতো। অতপর তাঁহারা হরিণ দুইটি ও মুরগী লইয়া নির্ধারিত স্থান অভিমুখে যাত্রা করিলেন। ঝরনাটির নাম ‘ওসমান ঝরনা’–নির্জন স্থান ছায়াময় ও পুচ্ছাদিত। সেখানে যাইয়া তাহারা আহারের আয়োজন করিলেন।
বালক ভৃত্যের সাহায্যে কুলসুম ও হালিমা নানা প্রকার খাদ্য প্রস্তুত করিলেন। বেলা যখন দুইটা তখন রান্না শেষ হইল। ছোট স্নানের তাবুটি তুলিয়া কুলসুম ও হালিমা স্নান করিলেন।
আহারাদি শেষ করিতে করিতে বেলা চারটা বাজিয়া গেল।
তোফেল ও আহমদ কহিল–আপনাদের হাতে আজ এমন তৃপ্তিসহ আহার করলাম, এরূপ তৃপ্তি সহকারে জীবনে কখনও আহার করি নি।
.
দশম পরিচ্ছেদ
হালিমা : ভাবি, ছালাম-আলায়কুম।–বাহির হইতে হালিমা ঘরের মধ্য প্রবশ করিলেন।
হালিমা কুলসুমের পার্শ্বে বসিয়া কহিলেন–ভাবি, বিয়ের পর স্বামীর প্রতি অনুরাগ জন্মে তা কি বেশি দিন স্থায়ী হয় না?
কুলসুম : স্বামী যেমন বিয়ের পর বৎসরখানেক পর স্ত্রীর জন্য তত পাগল হন না-রমণীরাও তেমনি স্বামীর প্রতি অনুরাগ হারান।
হালিমা : বড় কষ্টের কথা।
কুলসুম : অনুরাগ বা প্রবল আকর্ষণের জ্বালা অনুভব না করলেও কথা ও ব্যবহারে তা বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যে দম্পতিতে তা না হয় তাদের মধ্যে নিত্য কলহ হয়। শান্তির পরিবর্তে অশান্তি এসে দেখা দেয়।
হালিমা : পুরুষের কথা শুনেছি, স্ত্রীলোকের কীভাবে মতিচ্ছন্ন হয় তা জানতে চাই।
কুলসুম : কারো প্রতি যদি আকর্ষণ অনুভব না করা যায়, তবে আর তার কথা মনে থাকে না। বয়সের গুণে স্ত্রীলোকের মনে এক সময় পুরুষের জন্য ব্যাকুলতা জন্মে–যখন এই ব্যাকুলতা দূর হয়, তখন তারা স্বামীকে দায়ে পড়ে জিজ্ঞেস করে প্রাণের আবেগে নয় কিংবা প্রেমেও নয়। বিবাহ হয়েছে করা কী? স্বামীর ভাত রাঁধতে হবেই।
হালিমা : আশ্বর্য! মেয়ে মানুষের মনে এত শোচনীয় পরিবর্তন হয়!
কুলসুম : খুবই বিস্ময়ের কথা। সকল ক্ষেত্রেই কি এরূপ হয়? প্রাণের জ্বালাময় আকর্ষণে আগুন না থাকুক–একটা স্নিগ্ধ-শান্ত কর্তব্য গন্ধ মাখা অনুরাগ ধারা বইতে থাকবে তো। দিবারাত্রি স্বামীকে চোখে চোখে রাখবারে আকাক্ষা না থাক, স্বামীর জন্য বেদনা বোধ থাকা চাই। যখন কাপড় নেই, যখন ছেলেদের জন্য খেলনা দরকার, যখন চাল ফুরিয়ে গিয়েছে তখনই স্বামীর আবশ্যকতা অনুভব করা আর অন্য সময় গম্ভীর হয়ে বসে থাকা বা
নীরস কর্কশ কথা বলা–নারীরজীবনের বড় খারাপ কথা। স্বামীর মৃত্যুতে অনেক রমণী ভাত কোথায় পাবে এই ভাবনায় কাঁদে-মমতায় নয়। তার জীবনের প্রিয় বন্ধু মরে গেলো, এজন্য সে কাঁদে না। যখন বিয়ে হয় তখন মুখে হাসি ধরে না–পুরানো হলে রমণীর মুখ স্বামীর সম্মুখে আর তত প্রফুল্ল হয় না। কারণ, তখন তার মনে আসক্তি থাকে না।
হালিমা কানে হাত দিয়া কহিলেন, ওমা, আর শুনতে চাই নে। ভাবি এসব আমি বিশ্বাস করি নে।
কুলসুম : খোদার কাছে প্রার্থনা করি, তুমি যেন এইসব বিশ্বাস না কর। ছিঃ ছিঃ! যে মেয়ে মানুষ এত নীচতার পরিচয় দেয়, সে বড়ই হতভাগিনী। শিক্ষা না হলে মনের অবনতি ঘটে, যে স্ত্রীলোকের শিক্ষা নেই মনও তাদের ছোট। সর্বদা স্বামীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে। কোনো কোনো রমণী সদ্ব্যবহার কাকে বলে তা বোঝে না। স্বামী যাতে সন্তুষ্ট থাকেন তাই করলেই তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা হলো। স্ত্রীলোকেরা স্বামীর বাড়িতে যখন একটু আসন করে নেন–তখন স্বামীকে বাজে জিনিস বলে মনে করেন, তখন আর স্বামীর কোনো উপদেশ গ্রাহ্য করেন না। মনে করেন আমি তো একজন হয়েছি। ছেলেপেলে হলে কোনো কোনো নারীর মনে বিলক্ষণ অহঙ্কার জন্মে। এসব কথা বলতে কষ্ট হয় কিন্তু তবুও না বলে পারছি না। তারা মনে করেন যখন ছেলেপেলে হয়েছে তখন আর আমাদের পায় কে? স্বামী কোনো কারণে স্ত্রীর উপর অসন্তুষ্ট হলে তারা মনে মনে হাসতে থাকেন। স্বামী হয়তো দুঃখে মরে যান, স্ত্রী মজার সঙ্গে পালঙ্কে বসে কৌতুক করেন। ভাবেন এই আপদটার যদি বিশেষ অসুবিধে হয়ে থাকে তা হলে দেখুক না। এইসব স্ত্রীলোক নারী জাতির কলঙ্ক। যাদের মধ্যে বিদ্যা নাই, বুদ্ধি নাই, জ্ঞান নাই, যারা একটা পয়সা উপায় করতে পারে না, তাদের আবার
অহঙ্কার কীসের? স্বামীর গৌরবেই স্ত্রীলোকের গৌরব। স্বামীকে বাদ দিয়ে মেয়ে মানুষের। কীসের গৌরব? বি, এ, পাস বা বিত্তশালিনী বউ হলে না হয় আলাদা কথা। টাকা সম্মানের লোভে স্বামী-স্ত্রীর কোনো দোষ ধরে না। আবার লেখাপড়া জানা মেয়ে, বউ বেহায়া বা। প্রাণহীন হন না, স্বামীকে বাতাস করতে তার গা টিপে দিতে, স্বামীর আদর-যতে করতে। লজ্জা, কষ্ট বা অপমান বোধ হয় না। তিনি স্বামীর পা ধুয়ে দিতে আনন্দ বোধ করেন, দাসীরূপে নয়-বন্ধুরূপে। তিনি ভাবেন, পুরুষ পত্নী ও পুত্রের জন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রাণ দেয়, অতএব,স্বামীকে খেদমত করলে তার অপমান হবে না। পরীর সুখের কথা মনে করে পুরুষ কামানের সম্মুখে যেয়ে দাঁড়ায়–সেই পুরুষের কাছে নারীর শুধু কৃতজ্ঞতা নয়–সহৃদয়তা দেখান একান্ত আবশ্যক। এতে অপমান কী? এইতো আনন্দ! সহৃদয়তা ও সেবার দ্বারাই প্রেম প্রণয় হয়। নেশা কয়দিন থাকে? স্বামীর হাতে গামছাখানি এগিয়ে দেওয়া, তাড়াতাড়ি জুতো, ছাতি ঠিক করে দেওয়া, স্বামী কোনো জিনিস খুঁজতে থাকলে নিজে খুঁজতে আরম্ভ করা, স্বামীর জন্যে এক বদনা পানি ভরে রাখা, এসব হৃদয়তা ছাড়া আর কিছু না। এতে স্বামী সন্তুষ্ট হন। এসব কাজে অসম্মান নেই–এসব বন্ধুত্বের প্রীতি অবদান।