সকলেই হাতি হইতে নামিলেন, মোরগটাকে নাড়িয়া চাড়িয়া আনন্দ লাভ করিতে লাগিলেন।
প্রায় অর্ধ ঘণ্টা পর তাঁহারা পুনরায় হাতির পিঠে উঠিলেন।
তোফেল কহিল–মিঞা, বাম ধারে আর একটু অগ্রসর হলে সেই হরিণের আড্ডায় পৌঁছবে। তোফেল ভৃত্য। আবদুল গণি কহিলেন–চল, সেই দিকে যাই।
তাঁহারা পুনরায় অগ্রসর হইতে লাগিলেন বনভূমির শ্যাম শোভার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া কুলসুম কহিলেন এই পাহাড়ের মাঝে একখানা কুটির তৈরি করলে হয়।
হালিমা : সত্যি, সংসারের কর্মকোলাহল হতে যদি নির্জন পাহাড়ের মাঝে কিছুক্ষণ থাকা যায়; তা হলে মনের সঙ্কীর্ণতা দূর হয়।
কুলসুম : এইজন্য হয়তো ফকির দরবেশরা এবাদত সাধনার জন্য পাহাড়কে ভালো স্থান মনে করেন।
হালিমা : শুনেছি কবির নির্জন শ্যাম-লতা পত্রাচ্ছাদিত পাহাড় প্রান্তরে হ্রদের পার্শ্বে বাস করেন। সেখানে তার গভীর ও সূক্ষ্ম ভাবের সন্ধান পান।
কুলসুম : হ্যাঁ তাই। মাঝে মাঝ সংসারের কাজ থেকে বিদায় নিয়ে দূরে যাওয়া উচিত–তাতে মনকে নূতন দৃষ্টি দেওয়া হয়। অতি আপনার জন যারা, তাদের সঙ্গ ছেড়ে মাঝে মাঝে দূরে যাওয়া ভালো। এতে নূতন নূতন জ্ঞান ও ভাবের সঙ্গে পরিচয় হয়।
হালিমা : স্ত্রীলোকের পক্ষে পাহাড়ে বাস করা সম্ভব নয়।
কুলসুম : স্ত্রীলোকের পক্ষে নির্জন আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন একটু অসুবিধা জনক বটে।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে ঘর তুলে আবাস প্রস্তুত কি সম্ভব? বাঘ এসে ঘাড় মটকে দিতে পারে। বাঘের ভয়ে চিন্তা ও ভাব পালিয়ে যায়।
কুলসুম : এখানে আবাস প্রস্তুত সম্ভব নয়। এমন এক স্থান ঠিক করা চাই, যেখানে বাঘের ভয় নাই, জিনিসপত্র পাওয়া যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য ভাবময় করুণাভরা। কিছু কিছু বসতি থাকে। কিন্তু কোনো বিবাদ নেই।
হালিমা : আমাদের এই পাহাড়ে দিনরাত থাকবার সুবিধা না হতে পারে। খুব প্রাতকালে এলাম আবার সন্ধ্যাবেলা চলে গেলাম-এমন হলে কেমন হয়।
কুলসুম : বেশ হয়। রাতে থাকলেও যে ক্ষতি হবে তা নয়, তবে একটু কেমন কেমন লাগে। হালিমা : ভাইকে একখানা কুটির তুলতে বলুন। কোন জায়গাটা ভালো?
কুলসুম : যে জায়গাটার শোভা খুব মনোহর এবং যেখানে মানুষের যাতায়াত আছে।
হালিমা : একটু উঁচুস্থানে হওয়া চাই।
কুলসুম : যেখান হতে বহু দূর পর্যন্ত নজর চলে।
হালিমা : ঘরের চারদিকে প্রাচীর থাকবে কি?
কুলসুম : না, তাতে পাহাড়ে থাকার আমোদ নষ্ট হবে।
হালিমা : চারদিকে রেলিং থাকবে?
কুলসুম : হ্যাঁ।
হালিমা : একটা রান্নাঘরও থাকবে। কুলসুম। তা থাকলে মন্দ হয় না, প্রয়োজন হলে রান্না পর্যন্ত হতে পারে।
হালিমা : ঘরের মধ্যে একটা ছোট লাইব্রেরি থাকবে, কেমন?
কুলসুম : পাহাড় ঘুরে বেড়াবে, না পড়বে? পাহাড়ের শ্যাম মাধুরী, গল্প চিন্তা এই সবই যথেষ্ট। যদি দিন-রাত্রে সমানভাবে থাকবার সুবিধা হয়, তা হলে কিছু পুস্তক রাখা ভালো। একটা টেবিল বসবার জন্যে একটা ফরাস বা খান কতক চেয়ার থাকলেই যথেষ্ট। কাগজ কলম সব সময়েই দরকার। একটি ছোট বাক্স বা আলমারীতে কাগজ-কলম রেখে দিতে হয়। পাহাড়ের মধ্যে মনে যে সব চিন্তা উদয় হয়, সে সব কাগজে লিখে রাখা উচিত। পণ্ডিত ও কবিরা পাহাড়ে বা নির্জন মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যেই নাকি ভালো ভালো উপকরণ সংগ্রহ করেন।
হালিমা : মৃদু সতর্ক-কণ্ঠে কুলসুমের গায়ে ঠেলা দিয়া বলিলেন-হরিণ! হরিণ।
কুলসুম : আবদুল গণিকে ইশারা করিয়া জানাইলেন সম্মুখে হরিণ দেখা গিয়াছে। সকলেই নিশ্চল পাষাণ মূর্তির মতো স্থির হইয়া গেলেন।
রাইফেল বন্দুক–দূর হইতেই শিকার লক্ষ করা যায়। হাতির পৃষ্ঠ হইতেই আবদুল গণি বন্দুক তুলিলেন। মুহূর্তের মধ্যে একটা বিরাট হরিণ পাহাড়ের সবুজ ঢালুর উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া গেল।
আবার আনন্দ কোলাহল।
আহমদ দৌড়াইয়া গিয়া অর্ধমৃত হরিণের গলা ঠিক করিয়া ধরিল, কাঁটায় বাঁধিয়া তাহার কাপড় ছিঁড়িয়া গিয়াছিল, কিন্তু সেদিকে তাহার ভ্রুক্ষেপ ছিল না।
হাতি হইতে সকলেই নামিলেন। হালিমা, কুলসুম ও আবদুল গণির উৎসাহের সীমা রহিল না। তোফেল তাড়াতাড়ি হরিণটাকে জবেহ করিয়া দিল।
মুখ টান দিবার পূর্বে রক্তধারা আহমদের মুখে ও মাথায় যাইয়া লাগিল। অতঃপর একটা গাছের ছায়ায় বসিয়া তাহারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিলেন।
ঠিক হইল, এত বড় হরিণ যখন সামান্য এই কয়জনের পক্ষে বেশি হইয়া পড়িবে, তখন আপতত সেটাকে রান্না করিয়া কাজ নাই। শিকার আরও কিছু পাওয়া দরকার, আরও দুই একটা মুরগী বা ছোট এক-আধটা হরিণ পাইলে সুবিধা হয়।
বাম ধারে সহসা একটা মিহিন উচ্চ ভয়াবহ চীৎকার শোনা গেল। তাহা কোনো বিপন্নার আর্তনাদ বা ব্যধের আস্ফালন নহে। হরিণ যখন নির্জন পাহাড়ের শীর্ষে দাঁড়াইয়া ডাকে তখন সমস্ত বনভূমি প্রতিধ্বনিত হইতে থাকে।
আবদুল গণি সকলকে সেখানে অপেক্ষা করিতে বলিয়া তোফেলকে সঙ্গে লইয়া চীৎকার লক্ষ্য করিয়া বনে প্রবেশ করিলেন। তোফেল হালিমা বিবির বন্দুক লইল।
উদ্বেগে সকলে অপেক্ষা করিতে লাগিলেন। পনের মিনিট কটিল। অদূরে প্রতিধ্বনি করিয়া শব্দের পর শব্দ হইল। তোফেলের আনন্দসূচক চীৎকার শুনিয়া জানা গেল গুলি ব্যর্থ হয় নাই।
তোফেল এরফান ও কাজেমকে ডাকিল।