হালিমা : আতর মাখা ভালো, না এসেন্স মাখা ভালো? সুগন্ধি মাখা কি বিলাসিতা?
কুলসুম : মাঝে মাঝে একটু আধটু মাখতে পার। আতরই আমাদের জন্য প্রশস্ত। আতর মাখার সম্মুখে যে থাকে তার মুখে বা কাপড়ে একটু লাগিয়ে দেবে। সামান্য দরিদ্র। হলেও তাকে একটু সুগন্ধি দেবে। একা একা গন্ধ-দ্রব্য মাখতে নেই।
হালিমা : কদিন পরে সাবান মাখা উচিত?
কুলসুম : আজকাল অনেক মেয়ে নিত্য সাবান ব্যবহার করেন। নিত্য সাবান ব্যবহারে বিশেষ আবশ্যকতা নেই। যারা সৌন্দর্য বাড়াবার জন্যে সাবান ব্যবহার করেন তারা ভুল করেন। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য সাবান ব্যবহার করা উচিত। নিত্য সাবান মাখলে গায়ের চামড়া শিথিল হয়ে যেতে পারে। সাতদিন বা পনের দিনে ব্যবহার করা উচিত।
হালিমা : যে সে সাবান ব্যবহার করা য় কি?
কুলসুম : না, যে সে সাবান ব্যবহার করলে চর্মের অনিষ্ট হতে পারে। কোনো ভালো। বিশ্বাসযোগ্য কোম্পানীর নিকট থেকে সাবান খরিদ করা উচিত।
হালিমা : মাথায় সব সময় সুগন্ধি তেল দেওয়া সকলের পক্ষে কি সম্ভব?
কুলসুম : অসম্ভব নিশ্চয়ই, দেশের লোক ভয়ঙ্কর গরিব, কোনো রকমে শাক পাতা খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। ছোট ছোট সুগন্ধি তেলের শিশি রীতিমতো মাখলে ২/৩ দিনে শেষ হয়। নারিকেল তেল মাখলেও মাথাগরম হয়। অনেক লোক আছে তারা যেমন দরিদ্র তেমনি জোচ্চোর। ভেজাল দিয়ে জিনিসপত্র একদম নষ্ট করে ফেলে। এই জুয়াচুরি ও চুরির কারণ হয়তো দারিদ্র ও অভাব। যাই হোক, তেল না মাখ সেও ভালো, ভেজাল দেওয়া নারিকেল তেল ব্যবহার করবে না–মাথায় টাক পড়বে, মাথা গরম হবে। সুগন্ধি তেলেও অনেক জোচ্চোরি আছে। তেল সংগ্রহ করতে খুব সাবধানতা অবলম্বন করা চাই। যদি ভালো খাঁটি তেল সংগ্রহ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, তা হলে খাঁটি সরষের তেল ব্যবহার করতে পারা যায়। যে সরষের তেল বাজারে বিক্রি হয় তারও বিশ্বাস নেই। কেবল ভেজাল। কেবল ভেজাল! ভেজালে বাঙালি জীবন রসাতলে যাচ্ছে।
হালিমা : দেশের এই দরিদ্র দূর করবার উপায় কী?
কুলসুম : বিলাসী পুরুষগুলির কোনো কাণ্ডজ্ঞান নেই। পাছে স্ত্রী অসন্তুষ্ট হন এই ভয়ে তারা অসঙ্কোচে সংসারে বিলাসিতার প্রশ্রয় দিচ্ছেন। ছেলে-বুড়ো, ধনী-মজুর যদি প্রতিজ্ঞা করে যে, তারা দেশীয় জিনিস ছাড়া বিদেশী জিনিস কিনবে না, তা হলেই আমাদের দুঃখ দারিদ্র ঘুচতে পারে-নইলে রক্ষা নেই, বাঙালির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
হালিমা : আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আজ হতে দেশী দ্রব্য ছাড়া বিদেশী দ্রব্য ব্যবহার করবো। মোটা কাপড় পরতে পারি কিন্তু আমার ভাই-ভগ্নীকে মরে যেতে দেখতে পারি না।
কুলসুম : আবেগে হালিমাকে বুকের সহিত চাপিয়া ধরিয়া কহিলেন, হে আমার। পরদুঃখকাতরা প্রিয়তমা। আশীর্বাদ করি যেন তুমি তোমার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পার। দেশের আর্ত দুঃখী মানুষকে ফেলে প্রাণহীনের মতো শুধু নামাজ পড়লে কী লাভ হয়? খোদা হৃদয়হীনের নামাজ দিয়ে কী করবেন? খোদা দরিদ্রের বেশে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ান-ইসলামই তার খবর রাখে।
.
নবম পরিচ্ছেদ
পাহাড়ের পার্শ্বদিয়া দুইটি হাতি যাইতেছিল। একটার পিঠে হালিমা ও কুলসুম বসিয়াছিলেন। দুইজনের হাতে দুইটি বন্দুক ছিল। অন্যটির পৃষ্ঠে আবদুল গণি, তাহার মা ও চাচি। আবদুল গণির হাতেও, একটা বন্দুক ছিল।
চারিজন বরকন্দাজ দীর্ঘ লাঠি ও ছড়ি লইয়া হাতির পশ্চাৎ হাঁটিতেছিল।
আজ আবদুল গণি, রহিমা, হাফিজা, কুলসুম ও হালিমা সখ করিয়া শিকারে বাহির হইয়াছেন। হাতি দুইটির মধ্যে একটি ভট্টাচার্যদের। বরকন্দাজেরা কাহাকেও হাতির খুব। নিকটে আসিতে দিতেছিল না। হালিমার ব্যবহারে কোনো অসুবিধা হইতেছিল না।
তখন বেলা এক প্রহর হইবে। বাড়ি হইতে সকলে নাস্তা করিয়া আসিয়া ছিলেন। সঙ্গেও কিছু খাবার ছিল। সারাদিন শিকার অন্বেষণে পাহাড়ে কাটাইবেন–দুপুর বেলা ‘ওসমান ঝরনার নিকটবর্তী বড় পাহাড়ী গাছটার নিচে আহার করিবেন। ঘি, ডাল, চাল, মুরগী হাতির পিঠের উপর বাঁধিয়া দেওয়া হইয়াছিল। মুরগীর ডাকে হাতি ভয় পাইতেছিল বলিয়া সেগুলি আলী আহমেদের হাতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। আহমদ বালক ভূত্য।
হঠাৎ ঝোঁপের আড়াল হইতে একটি মুরগী বাহির হইল। আবদুল গণি ইশারা করিয়া জানাইলেন, যে যেখানে আছ সেইখানে থাক। মুরগী কক্ কক্ করিয়া মাটি খুঁড়িতেছিল–এতগুলি শিকারী তাহার চারিপার্শ্বে দাঁড়াইয়া তাহা সে আদৌ লক্ষ্য করিতেছিল না।
তাহার ডাক শুনিয়া আর একটা কালো মোরগ আসিল। আবদুল গণি ইঙ্গিত করিয়া কুলসুমকে লক্ষ্য করিতে অনুরোধ করিলেন–হয়তো তিনি হালিমাকেই শিকার মারিবার আনন্দ দিতে ইচ্ছা করিতেছিলেন।
কুলসুম হালিমাকে কহিলেন–হালিমা, তুমি মোরগটার উপর সন্ধান কর–আমি মুরগীটিকে সন্ধান করি।
দেখিতে না দেখিতে কয়েকটি ছানা লইয়া আর একটি মুরগী সেখানে আসিল। কুলসুম বলিলেন-এতগুলি শিশুর মাকে হত্যা করে কাজ নেই।
হালিমা বলিলেন–কিন্তু তিনটি যেরূপভাবে একস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, গুলি ছুঁড়লে যে কার গায়ে লাগবে বলা যায় না। একটু অপেক্ষা করা যাক।
হঠাৎ মোরগটি উড়িয়া উপরের ডালে বসিল। হয়তো সে শিকারীর গন্ধ পাইয়াছিল। বিলম্ব না করিয়া হালিমা গুলি ছুঁড়িলেন, সঙ্গে সঙ্গে শিকার পড়িল। উৎসব কোলাহলে বনভূমি মুখরিত হইল। আহমদ উৎসাহে দৌড়িয়ে গিয়ে ধরিল।