হালিমা : স্বামীর জন্যেই যে গয়না পরতে হবে, এটা জানতাম না।
কুলসুম : অন্যায় কথা। রাস্তাঘাটে কিংবা কুটুম্বের বাড়ি যেতে হলে, পায়ে অলতা পরে ফ্যাশন করে বের হবার দরকার কী? তোমার অনেক গয়না আছে–তুমি বড় মানুষের বউ-এসব কাউকে জানিয়ে লাভ কী? লোকে তোমাকে গরিব মনে করে, করুক। যে সমস্ত অসভ্য মেয়ে মানুষ গয়না ও অর্থ দেখে সম্মান জানাতে আসে, তাদের সম্মান নিয়ে দরকার নেই। যারা সৎস্বভাব, জ্ঞান ও মানসিক সৌন্দর্যকে সম্মান জানাতে জানে না, সে অভাগীদের সঙ্গে না মেশাই ভালো। গয়না ও চিত্তের চটক দেখিয়ে কারো নিকট হতে সম্মান আদায় করতে যেয়ো না।
হালিমা; ভাবি, তুমি পাতলা ফিনফিনে শাড়ি পর না, কারণ কী?
কুলসুম : এসব বড্ড কাম-গন্ধ মাখান, বড় মোহ সৃষ্টি করে, স্বামী ছাড়া অন্য করো কারো সামনে এসব পরতে নাই। অশালীন পোশাক ছেড়ে আমাদের ভদ্র পোশাক পরাই উচিত।
হালিমা : আমরা যে অনেক দিন থেকে শাড়ি পরতে অভ্যস্ত হয়েছি। নূতন পোশাক পরলে আমাদের সঙ্গিনীরা হাসবেন না?
কুলসুম : মুসলমান নারীদের অতি চমৎকার পোশাক আছে–পরলে দিব্যি দেখায়। আসল কথা পোশাকের নিজের কোনো সৌন্দর্য নাই–সভ্য, শিক্ষিত, বীর-প্রসবিনী জননীরা যা পরেন তাই ভালো। যে জাতির ভিতর অধিকাংশ মানুষ কাপুরুষ, যারা জগতকে কিছু দিতে পারে না–যারা পরকে বাঁচাতে জানে না, অপরের অনুগ্রহে বেঁচে আছে, যাদের নৈতিক ও সামরিক শক্তি নেই, তারা ভালো পোশাক পরলেও কদর হয় না। মানুষই পোশাক পরিচ্ছদকে অনেকাংশে সৌন্দর্য দেয়। তুমি কি ইচ্ছা কর–আমরা আমাদের বিশিষ্টতা হারিয়ে জগতে কৃপার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকি?
হালিমা : না, কিছুতেই না!
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া হালিমা পুনরায় কহিল–গরমের ভিতর চুল নিয়ে বড় জ্বালা হয়-ইচ্ছা করে চুলগুলি কেটে ফেলে দেই। কেউ কেউ গরমের মধ্যে চুল তাড়াতাড়ি করে ঝুঁটি করে রেখে দেয়।
কুলসুম : ছিঃ ছিঃ, দেখলে ঘৃণা হয়!
হালিমা : সব সময় খোঁপা করে রাখা কি সম্ভব?
কুলসুম : কেন, বেণী করে রাখলেই হয়। একটা বেণীতে অশান্তি সৃষ্টি হবার কোন কথা নাই, দেখতেও পরিপাটি। লাল ফিতে দিয়ে মুখটা এঁটে রাখবে–দেখলে মনে হবে, একটা গোলাপ গাছ মাথায় একটা প্রস্ফুটিত কুসুম নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
হালিমা : বৌ কী করে মানুষকে তার মাথা দেখাবে?
কুলসুম : কেন স্বামী দেখবে। কুন্দ দন্তের মুক্তা শোভা, লোহিত ওষ্ঠের স্মিত হাসি, বিস্ফারিত নয়নের মোহন কটাক্ষ, চঞ্চল চরণের মাধুরী লীলা-এসব স্বামীকে দেখাবে। সতী-সাধুনীর কলহসি, বীণা বিন্দিত কণ্ঠ রাগিণী, সরল রসিকতা সবই স্বামীর হৃদয়রঞ্জনে ব্যয়িত, পথের মানুষের জন্য নয়।
হালিমা : কোনো কোনো নারী স্বামীর সম্মুখে পেত্নী–বাইরে বেরুতে হলে রানী হয়ে বের হন।
কুলসুম : তারা কি ধরনের স্ত্রী লোক তা আমি বুঝি না।
হালিমা : আঁচলে চাবি পরা কী রূপ? দেখতে মন্দ লাগে না।
কুলসুম : বাজারে আঁচলে পরবার জন্য এক রকম চাবির গোছা কিনতে পাওয়া যায়, তাই কিনে অনেক মেয়ে পরেন। বাক্স নাই অথচ চাবি আঁচলে গুঁজে লোককে দেখাতে হবে, এটা নীচতা। নিজের বাক্স থাকে সুবিধার জন্য তবে চাবি আঁচলে বেঁধে রাখতে পারে, নইলে নয়।
হালিমা : আলতা পরা কেমন?
কুলসুম : খুব ভালো। সুন্দর চরণপদ্মকে আলতা দিয়ে রাঙা করলে খায়ের সৌন্দর্য বড়ই বাড়ে। সুন্দরীরা আলতা পরা পায়ে যখন হাঁটতে থাকে, তখন মুগ্ধ মাটি কাঁপতে থাকে।-স্বামী অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। তবে আলতার চেয়ে মেহেদী পরা ভালো, তাতে পা ভালো থাকে।
হালিমা : রাস্তাঘাটে আলতা পরে বের হওয়া কি উচিত?
কুলসুম : নিতান্তই বেহায়ামি। স্বামীর সম্মুখ ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় নারী নিজেকে। শ্রীভূষিত করবে না। শ্রী অর্থ যা পুরুষের মনে মুহূর্তের মাঝে মাদকতা সৃষ্টি করে। যে পোশাক পরলে বা যে ভাবে বের হলে মানুষের তরলভাব আসা অসম্ভব বা সহজ নয় সেই পোশাক নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হবে। তরল ভাব-উদ্দীপক চরণ বিক্ষেপ, বিলাসময় অঙ্গভঙ্গি এসব স্বামী ছাড়া অন্য কেউ যেন না দেখে। এ সবেরই মধ্যে আবার নারীর নারীত্ব। অস্বীকার করে নিতান্ত পুরুষের মতো স্বামীর সম্মুখে গম্ভীর বদখত হয়ে দাঁড়াতে যেয়ো না। তা হলে স্বামী বিরক্ত হবেন। নারী স্বামীর কাছে হবে একখানা মূর্তিমতী কবিতা, সেখানে জ্ঞান-আনন্দ, দুই-ই পাওয়া যায়।
হালিমা : নারীদের পান তামাক খাওয়া কেমন?
কুলসুম : পান খাওয়া মন্দ নয়। পান খেয়ে লাল ঠোঁটে যুবতী যখন কথা বলেন, তখন বড়ই সুন্দর দেখায়। এতে শরীরের কোনো উপকার হয় না, আরামের একটা উপকরণ। তামাক কোনো কোনো মহিলা খেয়ে থাকেন, এতে মুখের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।
হালিমা : হাত মোছার জন্যে সর্বদা একখানা গামছা ব্যবহার করা উচিত। অনেকে আঁচলে হাত মোছেন, আমারও অভ্যাস ছিল।
কুলসুম : রান্নাঘরে সর্বদা একখানা গামছা কাঁধের উপর ফেলে রাখতে হয়। অনেক নোংরা মেয়ের পাছার কাপড় ও আঁচলে হাত মোছবার অভ্যাস আছে। কোমরে একখানা রুমাল গুঁজে রাখাও মন্দ নয়।
হালিমা : অনেক মানুষ হঠাৎ মাটিতে বসে পড়বার অভ্যাস আছে।
কুলসুম : ঐটি বড় মন্দ অভ্যাস। এতে যেমন কাপড় খারাপ হয় অন্য দিকে মনেরও তেমনি অবনতি হতে থাকে। মনের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। যে বাড়িতে চেয়ার আছে, মেয়েরা সেইসব চেয়ার ব্যবহার করবেন। চেয়ার না থাকলে লম্বা বেঞ্চ, টুল বা ফরাস পাতা তক্তপোষে বসবেন। মাটিতেও পাটির উপর বসা যায়। রান্না ঘরে মাটিতে বসে রান্না না করাই ভালো। চুলগুলি মাটি থেকে দুই হাত উঁচুতে হওয়া উচিত, এতে খাবার জিনিসে ধুলোমাটি বা ময়লা ছড়ানোর ভয় থাকে না।