হালিমা : ভাবি!
কুলসুম : জি।-।
হালিমা : ভাবি, আপনাকে ডাকলে সব সময় ‘জি’ বলেন কেন–আমি তো ছোট। আপনি আমার ভাবি-ভাইয়ের বউ।
কুলসুম : ভদ্রতার পরিচয় দেওয়ায় দোষ কী?
হালিমা : পোশাক-পরিচ্ছদ কীরূপ হওয়া দরকার?
কুলসুম : যেমন পর, এমনি হবে।
হালিমা : মুসলমান মেয়েকে হিন্দুর মেয়ে হতে চিনে নেবার তো কোনো উপায় থাকবে না।
কুলসুম : যে পুরুষেরা নিজেদের বিশিষ্টতা ঠিক রাখে, তারাই জাতি গঠন করে। নারী যদি পোশাকের দ্বারা আমাদের বিশিষ্টতা রক্ষা করেন–তবে তা ভালোই হয়–ভিন্ন জাতির পোশাক পরে নিজের অসম্মান হয়-এও ঠিক।
হালিমা : ভাবি, তুমি সব সমযে সেমিজ, কোর্তা, ব্যবহার করো কী করে?–এতে কষ্ট হয় না?
কুলসুম : পুরুষ জামা, জুতা, কোট, পাতলুন পরে সব সময়ে অফিসে বসে থাকে কী করে? গরম লাগে বলে কি খালি গা থাকা যায়? মেয়ে মানুষের পক্ষে এক কাপড় পরে থাকা। বড়ই দোষের।
হালিমা : ছেলে হলে সেমিজ পরা চলে না। খোকা জামা ছিঁড়ে মাই খেতে চায়। গা ভরে পেশাব করে।
কুলসুম : ছেলে হলে কি কাপড় জামা ফেলে দিয়ে নেংটা হয়ে থাকতে হবে? ফিডিং বোতল মুখের কাছে ধরলেই তো কাজ চলতে পারে। রাত-দিন-টানাটানি করাবার দরকার কি? এক রকম বোতল আছে তাতে একবার সের দেড়েক মতো গরম দুধ যদি ভরে রাখা যায়, তা হলে সেই দুধে ২৪ ঘণ্টা চলে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠাণ্ডাও হয় না। দিনে রাতে। যতবার ইচ্ছা ফিডিং বোতলে দুধ ঢেলে খোকাকে খাওয়ান যায়।
হালিমা : মাইতে দুধ জমলে মাই ফুলে ওঠে না? অবস্থায় না কুলোলে মাই এর দুধ ছাড়া উপায় কী?
কুলসুম : এক রকম যন্ত্র আছে। ডাক্তারখানায় পাওয়া যায়-তাই দিয়ে দুধ গেলে ফেললে মাই জ্বালা করে না। দুধে যদি প্রসূতির কষ্ট হয়, তবে ডাক্তারের সাহায্য নেওয়া উচিত। দরিদ্র অবস্থার কথা ভাবলে চলবে না–খোকার জন্যে দুধ চাই-ই চাই। দুধ যে তার আহার। একেবারে নিরুপায় হলে মাই-এর দুধ দেবে। এজন্য তোমাকে খালি থাকতে হবে না।
হালিমা : হিন্দু মেয়েরা জুতো পায়ে দেয় না–কারণ কী?
কুলসুম : কারণ কি, তা তো জানি না। রান্নাঘরের পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করবার জন্য হয়তো তারা জুতো ব্যবহার করে না।
হালিমা : এক একটা তাদের অন্যায় রীতি। পায়খানায় যাবার সময় জুতো খুলে রেখে গেলেই হয়। তার পর হাত-পা ধুয়ে বা অজু করে রান্নাঘরে প্রবেশ করতে পারবে। আসল কথা তারা বড় কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
কুলসুম : তাই ঠিক।
হালিমা : কী জুতো ব্যবহার করা ভালো?
কুলসুম : মেয়েদের পক্ষে বিশেষ করে আমাদের দেশের মেয়েরা বুট বা সু পরতে পারে না। তাতে তাদের কাজের অসুবিধা হয়। চটি বা পামসু জুতোই প্রশস্ত। যে সব বাড়িতে চেয়ার-টেবিল আছে সেখানে মেয়েরা মাঝে সু পরতে পারে। অনেকবার জুতো খোলা অসুবিধা বলেইচটি ব্যবহার করতে হবে।
হালিমা : আচ্ছা ভাবি, আপনাকে তো গয়না পরতে দেখি নে–কারণ কী? গয়না না পরলে কী করে রূপ ফোটে? ভদ্রসমাজে কীভাবে বের হওয়া যায়।
কুলসুম : আমার গয়না না পরবার কারণ আছে-সে কারণ তোমাকে বলবো না। হালিমা আব্দার ধরিয়া কহিল-কারণ বলতেই হবে।
কুলসুম বলিলেন-তুমি বড় দুষ্ট-কারণ বলছি শোন, রেলে ভ্রমণ করবার সময় দেখেছি মেয়েরা লোককে গয়না দেখাবার জন্য কাপড় সরিয়ে হাতখানি বাইরে ঝুলিয়ে রেখে দেয়। সব মেয়েরই এই দস্তর। গয়না পরলেই স্ত্রী লোকের মন অহঙ্কারে ভরে ওঠে। গয়না ও রূপের চটক দেখাবার জন্য তারা অস্থির হয়ে ওঠে। নিজের মনকে এইভাবে বিভ্রান্ত করে তুলতে আমি অত্যন্ত ঘৃণা বোধ করি।
হালিমা : তা হলে কি আপনি গয়না পরতে একদম নিষেধ করেন?
কুলসুম : না, তা করি না। তোমার মতো সুন্দরীর গায়ে যদি গয়না ওঠে তা হলে রূপ শত গুণে বেড়ে উঠবে। বোন, কত মেয়ে মানুষ ছেঁড়া কাপড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে–কত ভদ্রঘরের মেয়ে অভাবে বিবস্ত্র হয়ে আছে–আমি কি করে এদের সামনে গয়না পরে রূপ দেখাই, বড় লজ্জা ও বেদনা হয়। এ বড় মানুষেমির ডঙ্কা বাজাতে চাই নে। বাইরের রূপ ও চটকের মূল্য কী? মনের উন্নতি, সৎস্বভাব নিরহঙ্কার ব্যবহার এবং আত্মমর্যাদাবোধ। মানুষের সৌন্দর্যের মূল্য। তুমি ছেলে মানুষ তোমার গয়না মানাবে ভালো।
হালিমা : ভাই বাড়ি এলে তো আপনি গয়না পরেন, দিনে সাতবার সিঁথি তোলেন–দিনে দুই তিনবার কাপড় বদলান।
কুলসুম হাসিয়া কহিলেন–পাগলি, বিয়ে হলে বুঝবে স্বামীর সম্মুখে এলে মেয়ে মানুষের মনে কি আনন্দ হয়। স্বামীর সম্মুখে পেত্নীর মতো থাকা নারীর পক্ষে অশোভন। প্রেম, মোহ যত পার স্বামীর সম্মুখে সৃষ্টি কর–আপত্তি নেই। এতে স্বামীও আনন্দ পান।
হালিমা : কি কি গয়না পরা উচিত?
কুলসুম : হাজার গণ্ডা গয়না পরে লাভ নাই–গয়না দুদিনের মোহ সৃষ্টি করে। খোদার দেওয়া সৌন্দর্যই যথেষ্ট। মোটামুটি হার, বালা, সোনার চুড়ি, অনন্ত ব্যবহার করবে। গয়না পর আর না-পর সর্বদা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকবে, চুলগুলি ঠিক করে রাখবে?
হালিমা : মেখলা, নথ, মল-এসব?
কুলসুম : ওগুলির মধ্যে ভয়ঙ্কর মাদকতা মাখান থাকে। এ সব স্বামী ছাড়া যদি বাড়িতে আর কেউ না থাকে তা হলে ব্যবহার করা যায়। সাবধান! লোক দেখানোর জন্যে গয়না পরবে না–স্বামী মনোরঞ্জনের জন্যেই গয়না পরতে হয়–মনে যেন অহঙ্কার না আসে–অহঙ্কার এলে খোদার অভিশাপ আসে। যে মানুষ পায়ের তলে থাকতে লজ্জা বোধ করে না, তাকেই খোদা বড় করেন। পায়ের তলে থাকার অর্থ আত্মার অবনত অবস্থা নয়–কিংবা শয়তান লোকের প্রভাব স্বীকার করা নয়।