সে-কথা তবারক ভুইঞা উত্তমরূপেই জানত। সেজন্যেই কি সেদিন সন্ধ্যা বেলায় নৌকায় করে যাবার উপদেশ দেয় নি তাকে? ততক্ষণে মুহাম্মদ মুস্তফার কেমন খেয়াল হয়েছিল, হয়তো দু-একদিনের মধ্যে স্টিমার ফিরে আসবে। তবারক ভুইঞাকে জিজ্ঞাসা করেছি, স্টিমারঘাটে নূতন কোনো খবর এসেছে কিনা। তবারক ভুইঞা। বলেছিল, না, কোনো খবর নেই, তবে দু-একদিনের মধ্যে স্টিমার আসবে কিনা সন্দেহ। তখনই নৌকার কথা তুলেছিল। নৌকায় করে যেতে কষ্ট হবে, সময়ও নেবে। পথটা উজানের। স্টিমারে যে-পথ বারো ঘন্টার মাত্র, নৌকায় সে-পথ অতিক্রম করতে দু-দিন লাগবে। তবু বিলম্ব না করে সে যদি রওনা হয়ে পড়ে তবে সময়মতো ঢাকায় পৌঁছুতে পারবে।
কাল সকালের জন্যে একটি নৌকা ঠিক করে দেন, মুহাম্মদ মুস্তফা বলেছিল। তবে নৌকায় করেও তার যাওয়া হয় নি, সেদিন রাতে তার ভয়ানক জ্বর ওঠে। এবং দুদিন পরে তবারক ভুইয় খোদেজার মৃত্যুর কথা জানতে পায়।
কুমুরডাঙ্গায় আসার কিছুদিন আগে মুহাম্মদ মুস্তফার দেশের বাড়ির শ্যাওলা-আবৃত লতাপাতা জলজ-আগাছায় ভরা ডোবার মতো পুকুরে খোদেজার মৃত্যু ঘটে। তখন মুহাম্মদ মুস্তফার শিক্ষানবিশী সবেমাত্র শেষ হয়েছে।
খোদেজার মৃত্যুর খবর আসে গ্রামের চৌধুরীদের ছেলের হাতে লেখা একটি পত্রে; আমি বাড়ি না থাকলে বাড়ির লোকেরা তাকে দিয়েই পত্রাদি লিখিয়ে নিত। খোদেজার মৃত্যুর খবর ছাড়া সে-চিঠিতে আরেকটি কথা ছিল যা মুহাম্মদ মুস্তফা প্রথমবার লক্ষ্য করে নি, কী কারণে চিঠিটা আবার পড়ছে তখন তা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পত্ৰলেখক যার মুখের কথা অক্ষর-নিবদ্ধ করেছে তার উদ্দেশ্য হয়তো প্রথমে ঠিক বুঝতে পারে নি। পরে বুঝতে পারলেও লিখতে গিয়ে কেমন একটি লজ্জা বোধ করে থাকবে, কারণ দুবার লিখে দুবার কেটে হঠাৎ যেন লজ্জাশরম জয় করে দৃঢ়হস্তে বড়-বড় করে লিখেছে তা। তবে লজ্জাশরম সম্পূর্ণভাবে জয় করতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ, কারণ ছোট বাক্যটি লিখতে গিয়ে সচরাচর যার বানানে ভুল হয় না তার বানান-জ্ঞান কেমন যেন লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছে।
বাক্যটি এবার মুহাম্মদ মুস্তফার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বটে কিন্তু তার অর্থ সে বুঝতে পারে না, দু-একবার অর্থোদ্ধার করার চেষ্টা করে স্থির করে অর্থহীন হবে; কখনো কখনো গ্রাম্য চিঠিতে অসংলগ্ন বা নিতান্ত অর্থহীন এক-আধটা বাক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়, কারণ অন্যের মুখের কথা বুঝতে পারলেও ভাষার দীনতার জন্যে পত্ৰলেখক সে কথা যেভাবে প্রকাশ করে তাতে তা সব সময়ে বুদ্ধিগম্য হয় না।
দু-দিনের ছুটি নিয়ে মুহাম্মদ মুস্তফা যখন বাড়ি অভিমুখে রওনা হয় তখন দুর্বোধ্য বাক্যটি তো বটেই, যে-মৃত্যুর খবরে মনে একটু ঈষৎ আঘাত পেয়েছিল বা সামান্য ব্যথা বোধ করেছিল সে-মৃত্যু সম্বন্ধেও বিস্মৃত হয়ে পড়েছে : জীবন-মৃত্যু দুটিই সে অতি সহজে গ্রহণ করে। আলো-অন্ধকারের মতো জীবন এবং মৃত্যু পাশাপাশি বসবাস করে একই নদীতে মিলিত দুটি ধারার মতো গলাগলি হয়ে প্রবাহিত হয়; দুটিই বিনা বাক্যে গ্রহণ করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় তার কাছে।
অন্যবারের মতো স্টিমারে করে প্রথম চাঁদবরণ ঘাটে, তারপর সে-ঘাটে স্টিমার ছেড়ে যথারীতি নৌকার পথ ধরে। ছোট খালের পথ। কখনো ঝুলে-পড়া গাছপালার শাখাপল্লবে ছায়াচ্ছন্ন কখনো উন্মুক্ত স্থানে মেঘনীলাম্বর-প্রতিফলিত স্রোতে হীনপ্রায় সে খাল মাঠক্ষেত জনপদের মধ্যে দিয়ে এঁকে-বেঁকে চলে, কখনো তীরের বেশ নিচে দিয়ে কখনো তীরের সঙ্গে সমতল হয়ে। পানিতে সোঁদালো গন্ধ, বদ্ধপ্রায় ধারায় নীরবতা, অন্যবারের মতোই লগির ধাক্কায়-ধাক্কায় ছাপরবিহীন খোলা নৌকা এগিয়ে চলে, প্রতিবারই পানিতে তরল আওয়াজ জাগে, প্রতিবারই গলুইর নিশানা কেমন দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে আবার আপনা থেকেই সোঝা হয়ে পড়ে। নৌকার মাঝখানে কোনোদিন ছাতার তলে, কোনোদিন শূন্য মাথায় হাঁটু তুলে পিঠ খাড়া করে বসে মুহাম্মদ মুস্তফা এ-পথে কতবার গিয়েছে কোনো দিকে না তকিয়ে নৌকার গতি লক্ষ্য না করে, খাল থেকে যে সোঁদালো গন্ধ উঠে ধীরে-ধীরে তার নাসারন্ধ্র ভরে দিয়েছে সে-গন্ধ সম্বন্ধে সজ্ঞান না হয়ে, পানির রঙ হঠাৎ রৌদ্রদীপ্ত আকাশের তলে আকস্মিক উজ্জ্বলতায় ঝলমল করে উঠলেও তাতে চমকিত না হয়ে। সেদিনও সে কিছুই লক্ষ্য করে নি, কিছুই দেখে নি। শুধু তাই নয়। যে-বাড়ি অভিমুখে সে ধীরে-ধীরে এগিয়ে যায় সে-বাড়ির কথাও ভাবে নি।
খালের পর এবার পায়ের পথ। হাতে ছোট বাক্স, যে-বাক্সে অন্যবার বাপ-জান মা-জান তাদের আশ্রিতা বিধবা চাচী এবং চাচীর মেয়ে খোদেজা-সকলের জন্যেই কিছু-কিছু টুকিটাকি উপহার থাকত। কোনো-কোনোবার অর্থাভাবে বড়দের জন্যে কিছু না থাকলেও খোদেজার জন্যে কিছু থাকত। অনেক সময় বেশ ফ্যাসি ধরনের জিনিস : সখের রঙিন ফিতা বা চিরুনি, বা ছোট হাত-আয়না, কোনোদিন-বা সুগন্ধ তেলের শিশি। সেদিন কারো জন্যে কিছু ছিল না, খোদেজার জন্যেও নয়; মৃত মানুষের জন্যে কেউ উপহার বহন করে নিয়ে যায় না। পায়ের পথের পর আইলেন পথ, যে-পথ কোথাও শুষ্ক, কোথাও কর্দমাক্ত, কোথাও দলাবাধা। তারপর একটি বাঁশের পুল, শেষ অপরাহ্নের সোনালি আলোয় স্নাত তন্দ্রাচ্ছন্ন জনহীন একটা ঘাটলা। ঘাটলার পর নূতন ছাদের টিনে সুশোভিত ঝুনু মিাদের বাড়ি; তারপর পুকুর-মসজিদ, আবার ধানক্ষেত, আবার একটি পুকুর যার উত্তর পাড়ে বরকতপুরের হাট সেদিন শূন্যতায় খাঁ খাঁ করে। হাটটি বসে সপ্তাহে দু-দিন : বুধবার আর শনিবার। কোনো-কোনোবার শহর থেকে খোদেজার জন্যে উপহার আনা সম্ভব না হলে এবং দিনটি হাটের দিন হলে সে হাট থেকেই কিছু কিনে নিয়ে গিয়েছে খোদেজার জন্যে। বস্তুত খোদেজার জন্যে কিছু-না কিছু নিয়ে যায় নি-এমন দিনের কথা মনে পড়ে না। ক্ষণকালের জন্যে তার কথা স্মরণ হয়, তবে শীঘ্র তা ভারহীন সারশূন্য তুলাসম মেঘখণ্ডের মতো মনাকাশে দেখা দিয়ে আবার উড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।