- বইয়ের নামঃ গল্প (সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ)
- লেখকের নামঃ সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
একটি তুলসীগাছের কাহিনী
ধনুকের মতো বাঁকা কংক্রিটের পুলটার পরেই বাড়িটা। দোতলা, উঁচু এবং প্রকাণ্ড বাড়ি। তবে রাস্তা থেকেই সরাসরি দণ্ডায়মান। এদেশে ফুটপাত নাই বলে বাড়িটারও একটু জমি ছাড়ার ভদ্রতার বালাই নাই। তবে সেটা কিন্তু বাইরের চেহারা। কারণ, পেছনে অনেক জায়গা। প্রথমত প্রশস্ত উঠান। তারপর পায়খানা-গোসলখানার পরে আম-জাম-কাঁঠালগাছে ভরা জঙ্গলের মতো জায়গা। সেখানে কড়া সূর্যালোকেও সূর্যাস্তের ম্লান অন্ধকার এবং আগাছা আবৃত মাটিতে ভাপসা গন্ধ।
অত জায়গা যখন তখন সামনে কিছু ছেড়ে একটা বাগান করলে কী দোষ হত?
সে-কথাই এরা ভাবে। বিশেষ করে মতিন। তার বাগানের বড় শখ, যদিও আজ পর্যন্ত তা কল্পনাতেই পুষ্পিত হয়েছে। সে ভাবে, একটু জমি পেলে সে নিজেই বাগানের মতো করে নিত। যত্ন করে লাগাত মৌসুুমি ফুল, গন্ধরাজ-বকুল-হাস্নাহানা, দু-চারটে গোলাপও। তারপর সন্ধ্যার পর আপিস ফিরে সেখানে বসত। একটু আরাম করে বসবার জন্যে হালকা বেতের চেয়ার বা ক্যানভাসের ডেকচেয়ারই কিনে নিত। তারপর গা ঢেলে বসে গল্প-গুজব করত। আমজাদের হুঁকার অভ্যাস। বাগানের সম্মান বজায় রেখে সে না হয় একটা মানানসই নলওয়ালা সুদৃশ্য গুড়গুড়ি কিনে নিত। কাদের গল্পপ্রেমিক। ফুরফুরে হাওয়ায় তার কণ্ঠ কাহিনীময় হয়ে উঠত। কিংবা পুষ্পসৌরভে মদির জ্যোৎস্নারাতে গল্প না করলেই বা কী এসে যেত? এমনিতে চোখ বুজে বসেই নীরবে সান্ধ্যকালীন স্নিগ্ধতা উপভোগ করত তারা।
আপিস থেকে শ্রান্ত হয়ে ফিরে প্রায় রাস্তা থেকেই চড়তে থাকা দোতলায় যাবার সিঁড়ি ভাঙতে-ভাঙতে মতিনের মনে জাগে এসব কথা।
বাড়িটা তারা দখল করেছে। অবশ্য লড়াই না করেই; তাদের সামরিক শক্তি অনুমান করে বাড়ির মালিক যে পৃষ্ঠপ্রদর্শন করেছিল তা নয়। দেশভঙ্গের হুজুগে এ শহরে এসে তারা যেমন-তেমন একটা ডেরার সন্ধানে উদয়াস্ত ঘুরছে, তখন একদিন দেখতে পায় বাড়িটা। সদর দরজায় মস্ত তালা, কিন্তু সামান্য পর্যবেক্ষণের পর বুঝতে পারে বাড়িতে জনমানব নাই এবং তার মালিক দেশপলাতক। পরিত্যক্ত বাড়ি চিনতে দেরি হয় না। কিন্তু এমন বাড়ি পাওয়া নিতান্ত সৌভাগ্যের কথা। সৌভাগ্যের আকস্মিক আবির্ভাবে প্রথমে তাদের মনে ভয়ই উপস্থিত হয়। অবশ্য সে-ভয় কাটতে দেরি হয় না। সে-দিন সন্ধ্যায় তারা সদলবলে এসে দরজার তালা ভেঙে রৈ-রৈ আওয়াজ তুলে বাড়িটায় প্রবেশ করে। তাদের মধ্যে তখন বৈশাখের আম-কুড়ানো ক্ষিপ্র উন্মাদনা বলে ব্যাপারটা তাদের কাছে দিন-দুপুরে ডাকাতির মতো মনে হয় না। কোনো অপরাধের চেতনা যদি-বা মনে জাগার প্রয়াস পায় তা বিজয়ের উল্লাসে নিমেষে তুলোধুনো হয়ে উড়ে যায়।
পরদিন শহরে খবরটা ছড়িয়ে পড়লে অনাথিতদের আগমন শুরু হয়। মাথার ওপর একটা ছাদ পাবার আশায় তারা দলে-দলে আসে।
বিজয়ের উল্লাসটা ঢেকে এরা বলে, কী দেখছেন? জায়গা নাই কোথাও। সব ঘরেই বিছানা পড়েছে। এই যে ছোট্ট ঘরটি, তাতেও চার-চারটে বিছানা পড়েছে। এখন-তো শুধু বিছানা মাত্র। পরে ছ-ফুট বাই আড়াই-ফুটের চারটি চৌকি এবং দু-একটা চেয়ার-টেবিল এলে পা ফেলার জায়গা থাকবে না।
একজন সমবেদনার কণ্ঠে বলে,
আপনাদের তকলিফ আমরা কি বুঝি না? একদিন আমরা কি কম কষ্ট পেয়েছি? তবে আপনাদের কপাল মন্দ। সে-ই হচ্ছে আসল কথা।
যারা হতাশ হয় তাদের মুখ কালো হয়ে ওঠে সমবেদনা-ভরা উক্তিতে
ঐ ঘরটা?
নিচের তলায় রাস্তার ধারে ঘরটা অবশ্য খালিই মনে হয়।
খালি দেখালেও খালি নয়। ভালো করে চেয়ে দেখুন। দেয়ালের পাশে সতরঞ্চিতে বাঁধা দুটি বেডিং। শেষ জায়গাটাও দু-ঘণ্টা হল অ্যাকাউন্টস-এর মোটা বদরুদ্দিন নিয়ে নিয়েছে। শালার কাছ থেকে বিছানা-পত্তর আনতে গেছে। শালাও আবার তার এক দোস্তের বাড়ির বারান্দায় আস্তানা গেড়েছে। পরিবার না থাকলে শালাটিও এসে হাজির হত।
নেহাত কপালের কথা। আবার একজনের কণ্ঠ সমবেদনায় খলখল করে ওঠে। যদি ঘণ্টাদুয়েক আগে আসতেন তবে বদরুদ্দিনকে কলা দেখাতে পারতেন। ঘরটায় তেমন আলো নেই বটে কিন্তু দেখুন জানালার পাশেই সরকারি আলো। রাতে কোনোদিন ইলেকট্রিসিটি ফেল করলে সে আলোতেই দিব্যি চলে যাবে।
বা কিপ্পণতা যদি করতে চায়—
অবশ্য এ-সব পরাহত বাড়ি-সন্ধানীদের কানে বিষবৎ মনে হয়।
যথাসময়ে বে-আইনি বাড়ি দখলের ব্যাপারটা তদারক করবার জন্যে পুলিশ আসে। সেটা স্বাভাবিক। দেশময় একটা ঘোর পরিবর্তনের আলোড়ন বটে কিন্তু কোথাও যে রীতিমতো মগের মুলুক পড়েছে তা নয়। পুলিশ দেখে তারা ভাবে, পলাতক গৃহকর্তা কি বাড়ি উদ্ধারের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছে? তবে সে-কথা বিশ্বাস হয় না। দু-দিনের মধ্যে বাড়িটা খালি করে দিয়ে যে দেশ থেকে উধাও হয়ে গেছে, বর্তমানে তার অন্যান্য গভীর সমস্যার কথা ভাববার আছে। সন্দেহ থাকে না যে, পুলিশকে খবর দিয়েছে তারাই যারা সময়মতো এখানে না এসে শহরের অন্য কোনো প্রান্তে নিষ্ফলভাবে বাড়ি দখলের ফিকিরে ছিল। মন্দভাগ্যের কথা মানা যায় কিন্তু সহ্য করা যায় না। ন্যায্য অধিকার-স্বত্ব এক কথা, অন্যায়ের ওপর ভাগ্য লাভ অন্য কথা। হিংসাটা ন্যায়সংগত-তো মনে হয়-ই, কর্তব্য বলেও মনে হয়।
এরা রুখে দাঁড়ায়।
আমরা দরিদ্র কেরানি মানুষ বটে কিন্তু সবাই ভদ্র ঘরের ছেলে। বাড়ি দখল করেছি বটে কিন্তু জানালা-দরজা ভাঙি নাই, ইট-পাথর খসিয়ে চোরাবাজারেও চালান করে দিই নাই।
আমরাও আইনকানুন বুঝি। কে নালিশ করেছে? বাড়িওয়ালা নয়। তবে নালিশটাও যথাযথ নয়।
কাদের কেবল কাতর রব তোলে। যাব কোথায়? শখ করে কি এখানে এসে উঠেছি?
সদলবলে সাব-ইন্সপেক্টর ফিরে গিয়ে না-হক না-বেহক না-ভালো না-মন্দ গোছের ঘোর-ঘোরালো রিপোর্ট দেয় যার মর্মার্থ উদ্ধারের ভয়েই হয়তো ওপরওয়ালা তা ফাইল চাপা দেয়া শ্রেয় মনে করে। অথবা বুঝতে পারে, এই হুজুগের সময় অন্যায়ভাবে বাড়ি দখলের বিষয়ে সরকারি আইনটা যেন তেমন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না।
কাদের চোখ টিপে বলে, সত্য কথা বলতে দোষ কী? সাব-ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় বউ আমার এক রকম আত্মীয়া। বোলো না কাউকে কিন্তু।
কথাটা অবশ্য কারোই বিশ্বাস হয় না। তবে অসত্যটি গোড়ায় যে কেবল একটা নির্মল আনন্দের উস্কানি, তা বুঝে কাদেরকে ক্ষমা করতে দ্বিধা হয় না।
উৎফুল্ল কণ্ঠে কেউ প্রস্তাব করে, কী হে, চা-মিষ্টিটা হয়ে যাক।
রাতারাতি সরগরম হয়ে ওঠে প্রকাণ্ড বাড়িটা। আস্তানা একটি পেয়েছে এবং সে-আস্তানাটি কেউ হাত থেকে কেড়ে নিতে পারবে না—শুধু এ-বিশ্বাসই তার কারণ নয়। খোলামেলা ঝরঝরে তকতকে এ-বাড়ি তাদের মধ্যে একটা নতুন জীবন সঞ্চার করেছে যেন। এদের অনেকেই কলকাতায় ব্লকম্যান লেন-এ খালাসি পট্টিতে, বৈঠকখানায় দফতরিদের পাড়ায়, সৈয়দ সালেহ লেন-এ তামাক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বা কমরু খানসামা লেন-এ অকথ্য দুর্গন্ধ নোংরার মধ্যে দিন কাটিয়েছে। তুলনায় এ-বাড়ির বড়-বড় কামরা, নীলকুঠি দালানের ফ্যাশনে মস্ত-মস্ত জানালা, খোলামেলা উঠান, আরো পেছনে বনজঙ্গলের মতো আম-জাম-কাঁঠালের বাগান—এসব একটি ভিন্ন দুনিয়া যেন। এরা লাটবেলাটের মতো এক-একখানা ঘর দখল করে নাই সত্য, তবু এত আলো-বাতাস কখনো তারা উপভোগ করে নাই। তাদের জীবনে সবুজ তৃণ গজাবে, ধমনিতে সবল সতেজ রক্ত আসবে, হাজার-দু-হাজারওয়ালাদের মতো মুখে ধন-স্বাস্থ্যের জলুস আসবে, দেহও ম্যালেরিয়া-কালাজ্বর-ক্ষয় ব্যাধিমুক্ত হবে। রোগাপটকা ইউনুস ইতিমধ্যে তার স্বাস্থ্যের পরিবর্তন দেখতে পায়। সে থাকত ম্যাকলিওড স্ট্রিটে। গলিটা যেন সকালবেলার আবর্জনাভরা ডাস্টবিন। সে-গলিতেই নড়বড়ে ধরনের একটা কাঠের দোতলা বাড়িতে রান্নাঘরের পাশে স্যাঁতসেঁতে একটি কামরায় কচ্ছদেশীয় চামড়া-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে চার-বছর সে বাস করেছে। পাড়াটি চামড়ার উৎকট গন্ধে সর্বক্ষণ এমন ভরপুর হয়ে থাকত যে রাস্তার ড্রেনের পচা দুর্গন্ধ নাকে পৌঁছত না, ঘরের কোণে ইঁদুর-বেড়াল মরে-পচে থাকলেও তার খবর পাওয়া দুষ্কর ছিল। ইউনুসের জ্বরজ্বারি লেগেই থাকত, থেকে-থেকে শেষরাতে কাশির ধমক উঠত। তবু পাড়াটি ছাড়েনি এক কারণে। কে তাকে বলেছিল, চামড়ার গন্ধ নাকি যক্ষ্মার জীবাণু ধ্বংস করে। দুর্গন্ধটা তাই সে অম্লানবদনে সহ্য-তো করতই, সময়-সময় আপিস থেকে ফিরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে পাশের বাড়ির নিশ্ছিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে বুকভরে নিশ্বাস নিত। তাতে অবশ্য তার স্বাস্থ্যের কোনো উন্নতি দেখা যায় নাই।
খানাদানা না হলে বাড়ি সরগরম হয় না। তাই এক সপ্তাহ ধরে মোগলাই কায়দায় তারা খানাদানা করে। রান্নার ব্যাপারে সকলেরই গুপ্ত কেরামতি প্রকাশ পায় সহসা। নানির হাতে শেখা বিশেষ ধরনের পিঠা তৈরির কৌশলটি শেষ পর্যন্ত অখাদ্য বস্তুতে পরিণত হলেও তারিফ-প্রশংসায় তা মুখরোচক হয়ে ওঠে। গানের আসরও বসে কোনো-কোনো সন্ধ্যায়। হাবিবুল্লা কোত্থেকে একটা বেসুরো হারমোনিয়াম নিয়ে এসে তার সাহায্যে নিজের গলার বলিষ্ঠতার ওপর ভর করে নিশীথ রাত পর্যন্ত একটি অব্যক্তব্য সঙ্গীতসমস্যা সৃষ্টি করে।
এ-সময়ে একদিন উঠানের প্রান্তে রান্নাঘরের পেছনে চৌকোণা আধ-হাত উঁচু ইটের তৈরি একটি মঞ্চের উপর তুলসীগাছটি তাদের দৃষ্টিগত হয়।
সেদিন রোববার সকাল। নিমের ডাল দিয়ে মেছোয়াক করতে-করতে মোদাব্বের উঠানে পায়চারি করছিল, হঠাৎ সে তারস্বরে আর্তনাদ করে ওঠে। লোকটি এমনিতেই হুজুগে মানুষ। সামান্য কথাতেই প্রাণ-শীতল-করা রৈ-রৈ আওয়াজ তোলার অভ্যাস তার। তবু সে-আওয়াজ উপেক্ষা করা সহজ নয়। শীঘ্রই কেউ-কেউ ছুটে আসে উঠানে।
কী ব্যাপার?
চোখ খুলে দেখ!
কী? কী দেখব?
সাপখোপ দেখবে আশা করেছিল বলে প্রথমে তুলসীগাছটা নজরে পড়ে না তাদের। দেখছ না? এমন বেকায়দা আসনাধীন তুলসীগাছটা দেখতে পাচ্ছ না?
উপড়ে ফেলতে হবে ওটা। আমরা যখন এ-বাড়িতে এসে উঠেছি তখন এখানে কোনো হিন্দুয়ানির চিহ্ন আর সহ্য করা হবে না।
একটু হতাশ হয়ে তারা তুলসীগাছটির দিকে তাকায়। গাছটি কেমন যেন মরে আছে। গায় সবুজ রঙের পাতায় খয়েরি রং ধরেছে। নিচে আগাছাও গজিয়েছে। হয়তো বহুদিন তাতে পানি পড়েনি।
কী দেখছ? মোদাব্বের হুঙ্কার দিয়ে ওঠে। বলছি না, উপড়ে ফেল!
এরা কেমন স্তব্ধ হয়ে থাকে। আকস্মিক এ-আবিষ্কারে তারা যেন কিছুটা হতভম্ভ হয়ে পড়েছে। যে-বাড়ি এত শূন্য মনে হয়েছিল, ছাদে যাওয়ার সিঁড়ির দেয়ালে কাঁচা হাতে লেখা—ক-টা নাম থাকা সত্ত্বেও যে-বাড়িটা এমন বেওয়ারিশ ঠেকেছিল, সে-বাড়ির চেহারা যেন হঠাৎ বদলে গেছে। আচমকা ধরা পড়ে গিয়ে শুষ্কপ্রায় মৃতপ্রায় নগণ্য তুলসীগাছটি হঠাৎ সে-বাড়ির অন্দরের কথা প্রকাশ করেছে যেন।
এদের অহেতুক স্তব্ধতা লক্ষ্য করে মোদাব্বের আবার হুঙ্কার ছাড়ে।
ভাবছ কী অত? উপড়ে ফেল বলছি!
কেউ নড়ে না। হিন্দু রীতিনীতি এদের তেমন ভালো করে জানা নাই। তবু কোথাও শুনেছে যে, হিন্দুবাড়িতে প্রতি দিনান্তে গৃহকর্ত্রী তুলসীগাছের তলে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়, গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করে। আজ যে-তুলসীগাছের তলে ঘাস গজিয়ে উঠেছে, সে-পরিত্যক্ত তুলসীগাছের তলেও প্রতি সন্ধ্যায় কেউ প্রদীপ দিত। আকাশে যখন সন্ধ্যাতারা বলিষ্ঠ একাকিত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তখন ঘনায়মান ছায়ার মধ্যে আনত সিঁদুরের নীরব রক্তাক্ত স্পর্শে একটি শান্ত-শীতল প্রদীপ জ্বলে উঠত প্রতিদিন। ঘরে দুর্দিনের ঝড় এসেছে, হয়তো কারো জীবন-প্রদীপ নিভে গেছে, আবার হাসি-আনন্দের ফোয়ারাও ছুটেছে সুখ সময়ে, কিন্তু এ-প্রদীপ-দেওয়া-অনুষ্ঠান একদিনের জন্যেও বন্ধ থাকে নাই।
যে-গৃহকর্ত্রী বছরের পর বছর এ-তুলসীগাছের তলে প্রদীপ দিয়েছে সে আজ কোথায়? মতিন একসময়ে রেলওয়েতে কাজ করত। অকারণে তার চোখের সামনে বিভিন্ন রেলওয়ে-পট্টির ছবি ভেসে ওঠে। ভাবে, হয়তো আসানসোল, বৈদ্যবাটি, লিলুয়া বা হাওড়ায় রেলওয়ে-পট্টিতে সে-মহিলা কোনো আত্মীয়ের ঘরে আশ্রয় নিয়েছে। বিশাল ইয়ার্ডের পাশে রোদে শুকোতে-থাকা লাল পাড়ের একটি সমৃণ কালো শাড়ি সে যেন দেখতে পায়। হয়তো সে-শাড়িটি গৃহকর্ত্রীরই। কেমন বিষণ্নভাবে সে-শাড়িটি দোলে স্বল্প হাওয়ায়। অথবা মহিলাটি কোনো চলতি ট্রেনের জানালার পাশে যেন বসে। তার দৃষ্টি বাইরের দিকে। সে-দৃষ্টি খোঁজে কিছু দূরে, দিগন্তের ওপারে। হয়তো তার যাত্রা এখনো শেষ হয় নাই। কিন্তু যেখানেই সে থাকুক এবং তার যাত্রা এখনো শেষ হয়েছে কি হয় নাই, আকাশে যখন দিনান্তের ছায়া ঘনিয়ে ওঠে তখন প্রতিদিন এ-তুলসীতলার কথা মনে হয় বলে তার চোখ হয়তো ছলছল করে ওঠে।
গতকাল থেকে ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাব। সে বলে,
থাক্ না ওটা। আমরা-তো তা পূজা করতে যাচ্ছি না। বরঞ্চ ঘরে তুলসীগাছ থাকা ভালো। সর্দি-কফে তার পাতার রস বড়ই উপকারী।
মোদাব্বের অন্যদের দিকে তাকায়। মনে হয়, সবারই যেন তাই মত। গাছটি উপড়ানোর জন্যে কারো হাত এগিয়ে আসে না। ওদের মধ্যে এনায়েত একটু মৌলবী ধরনের মানুষ। মুখে দাড়ি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও আছে, সকালে নিয়মিতভাবে কোরআন-তেলাওয়াত করে। সে-পর্যন্ত চুপ। প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকর্ত্রীর সজল চোখের দৃশ্যটি তার মনেও জাগে কি?
অক্ষত দেহে তুলসীগাছটি বিরাজ করতে থাকে।
তবে এদের হাত থেকে সেটি রেহাই পেলেও এরা যে তার সম্বন্ধে পর মুহূর্তেই অসচেতনায় নিমজ্জিত হয় তা নয়। বরঞ্চ তেমন একটা দুর্বলতার ভাব, কর্তব্যের সম্মুখে পিছপা হলে যেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা আছে তেমন একটা অস্বচ্ছন্দতা তাদের মনে লেগে থাকে। তারই ফলে সে-দিন সান্ধ্য আড্ডায় তর্ক ওঠে। তারা বাক-বিতণ্ডার স্রোতে মনের সে-দুর্বলতা-অস্বচ্ছন্দতা ভাসিয়ে দিতে চায় যেন। আজ অন্য দিনের মতো রাষ্ট্রনৈতিক-অর্থনৈতিক আলোচনার বদলে সাম্প্রদায়িকতাই তাদের প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
—ওরাই তো সবকিছুর মূলে, মোদাব্বের বলে। উলঙ্গ বাল্ব-এর আলোয় তার সযত্নে মেছোয়াক করা দাঁদ ঝকঝক করে।—তাদের নীচতা হীনতা গোঁড়ামির জন্যেই তো দেশটা ভাগ হল।
কথাটা নতুন নয়। তবু আজ সে-উক্তিতে নতুন একটা ঝাঁঝ। তার সমর্থনে এবার হিন্দুদের অবিচার-অত্যাচারের অশেষ দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়। অল্প সময়ের মধ্যে এদের রক্ত গরম হয়ে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস সংকীর্ণ হয়ে আসে।
দলের মধ্যে বামপন্থী বলে স্বীকৃত মকসুদ প্রতিবাদ করে। বলে, বড় বাড়াবাড়ি হচ্ছে নাকি? মোদাব্বেরের ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিয়ে ওঠে।
বাড়াবাড়ি মানে?
বামপন্থী মকসুদ আজ একা। তাই হয়তো তার বিশ্বাসের কাঁটা নড়ে। সংশয়ে দুলে-দুলে কাঁটাটি ডান দিক হেলে থেমে যায়।
কয়েকদিন পরে রান্নাঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তুলসীগাছটা মোদাব্বেরের নজরে পড়ে। সে একটু বিস্মিত না হয়ে পারে না। তার তলে যে আগাছা জন্মেছিল সে-আগাছা অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়। যে-গাঢ় সবুজ পাতাগুলি পানির অভাবে শুকিয়ে খয়েরি রং ধরেছিল, সে-পাতাগুলি কেমন সতেজ হয়ে উঠেছে। সন্দেহ থাকে না যে তুলসীগাছটির যত্ন নিচ্ছে কেউ। খোলাখুলিভাবে না হলেও লুকিয়ে-লুকিয়ে তার গোড়ায় কেউ পানি দিচ্ছে।
মোদাব্বেরের হাতে তখন একটি কঞ্চি। সেটি শাঁ করে কচু-কাটার কায়দায় সে তুলসীগাছের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়। কিন্তু ওপর দিয়েই। তুলসীগাছটি অক্ষত দেহেই থাকে।
অবশ্য তুলসীগাছের কথা কেউ উল্লেখ করে না। ইউনুসের সর্দি-সর্দি ভাবটা পরদিন কেটে গিয়েছিল। তুলসীপাতার রসের প্রয়োজন হয় নাই তার।
তারা ভেবেছিল ম্যাকলিওড স্ট্রিট খানসামা লেন ব্লকম্যানের জীবন সত্যিই পেছনে ফেলে এসে প্রচুর আলো-হাওয়ার মধ্যে নতুন জীবন শুরু করেছে। কিন্তু তাদের ভুলটা ভাঙতে দেরি হয় না। তবে শুধু ততখানিই দেরি হয় যতখানি দরকার, সে-বিশ্বাস দৃঢ় পরিণত হবার জন্য। ফলে আচম্বিত আঘাতটা প্রথম নিদারুণই মনে হয়।
সেদিন তারা আপিস থেকে সরাসরি বাড়ি ফিরে সকালের পরিকল্পনা মোতাবেক খিচুড়ি রান্নার আয়োজন শুরু করেছে এমন সময় বাইরের সিঁড়িতে ভারী জুতার মচ্মচ্ আওয়াজ শোনা যায়। বাইরে একবার উঁকি দিয়ে মোদাব্বের ক্ষিপ্রপদে ভেতরে আসে।
পুলিশ এসেছে আবার। সে ফিসফিস করে বলে।
পুলিশ? আবার কেন পুলিশ? ইউনুস ভাবে, হয়তো রাস্তা থেকে ছ্যাঁচড়া চোর পালিয়ে এসে বাড়িতে ঢুকেছে এবং তারই সন্ধানে পুলিশের আগমন হয়েছে। কথাটা মনে হতেই নিজের কাছেই তা খরগোশের গল্পের মতো ঠেকে। শিকারির সামনে আর পালাবার পথ না পেয়ে হঠাৎ চোখ বুজে বসে পড়ে খরগোশ ভাবে, কেউ তাকে আর দেখতে পাচ্ছে না। আসলে তারাই কি চোর নয়? সব জেনেও তারাই কি সত্য কথাটা স্বীকার না করে এ-বাড়িতে একটি অবিশ্বাস্য মনোরম জীবন সৃষ্টি করেছে নিজেদের জন্যে?
পুলিশদলের নেতা সাবেকি আমলের মানুষ। হ্যাট বগলে চেপে তখন সে দাগ-পড়া কপাল থেকে ঘাম মুচছে। কেমন একটা নিরীহ ভাব। তার পশ্চাতে বন্দুকধারী কনস্টেবল দুটিকেও মস্ত গোঁফ থাকা সত্ত্বেও নিরীহ মনে হয়। তাদের দৃষ্টি ওপরের দিকে। তারা যেন কড়িকাঠ গোনে। ওপরের ঝিলিমিলির খোপে একজোড়া কবুতর বাসা বেঁধেছে। হয়তো সে কবুতর দুটিকেই দেখে চেয়ে। হাতে বন্দুক থাকলে নিরীহ মানুষেরও দৃষ্টি পড়ে পশু-পক্ষীর দিকে।
সবিনয়ে মতিন প্রশ্ন করে, কাকে দরকার?
আপনাদের সবাইকে। পুলিশদের নেতা একটু খনখনে গলায় ঝট্ করে উত্তর দেয়। আপনারা বে-আইনিভাবে এ-বাড়িটা কব্জা করেছেন।
কথাটা না মেনে উপায় নাই। ওরা প্রতিবাদ না করে সরল চোখে সামান্য কৌতূহল জাগিয়ে পুলিশের নেতার দিকে চেয়ে থাকে।
চবি্বশ ঘণ্টার মধ্যে বাড়ি ছাড়তে হবে। সরকারের হুকুম।
এরা নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে। অবশেষে মোদাব্বের গলা সাফ করে প্রশ্ন করে, কেন, বাড়িওয়ালা নালিশ করেছে নাকি?
অ্যাকাউন্টস আপিসের মোটা বদরুদ্দিন গলা বাড়িয়ে কনস্টেবল দুটির পেছনে একবার তাকিয়ে দেখে বাড়িওয়ালার সন্ধানে। সেখানে কেউ নেই। তবে রাস্তায় কিছু লোক জড়ো হয়েছে। অন্যের অপমান দেখার নেশা বড় নেশা।
কোথায় বাড়িওয়ালা? না হেসেই গলায় হাসি তোলে পুলিশদলের নেতা।
এদের একজনও হেসে ওঠে। একটা আশার সঞ্চার হয় যেন।
তবে?
গভর্নমেন্ট বাড়িটা রিকুইজিশন করেছে।
এবার আর হাসি জাগে না। বস্তুত অনেকক্ষণ যেন কারো মুখে কোনো কথা সরে না। তারপর মকসুদ গলা বাড়ায়।
আমরা কি গভর্নমেন্টের লোক নই?
এবার কনস্টেবল দুটির দৃষ্টিও কবুতর কড়িকাঠ ছেড়ে মকসুদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়। তাদের দৃষ্টিতে সামান্য বিস্ময়ের ভাব। মানুষের নির্বুদ্ধিতায় এখনো তারা চমকিত হয়।
তারপর প্রকাণ্ড সে-বাড়িতে অপর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকলেও একটা গভীর ছায়া নেবে আসে। প্রথমে অবশ্য তাদের মাথায় খুন চড়ে। নানারকম বিদ্রোহী-ঘোষণা শোনা যায়। তারা যাবে না কোথাও, ঘরের খুঁটি ধরে পড়ে থাকবে; যাবে-তো লাশ হয়ে যাবে। তবে মাথা শীতল হতে দেরি হয় না। তখন গভীর ছায়া নেবে আসে সর্বত্র। কোথায় যাবে তারা?
পরদিন মোদাব্বের যখন এসে বলে তাদের মেয়াদ ছবি্বশ ঘণ্টা থেকে সাত দিন হয়েছে তখন তারা একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেও সে-ঘন ছায়াটা নিবিড় হয়েই থাকে। এবার মোদাব্বের পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টরের দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কথা বলে না। তবু না-বলা কথাটা সবাই মেনে নেয়। তারপর দশম দিনে তারা সদলবলে বাড়ি ত্যাগ করে চলে যায়। যেমনি ঝড়ের মতো এসেছিল, তেমনি ঝড়ের মতোই উধাও হয়ে যায়। শূন্য বাড়িতে তাদের সাময়িক বসবাসের চিহ্নস্বরূপ এখানে-সেখানে ছিটিয়ে-ছড়িয়ে থাকে খবর কাগজের ছেঁড়া জুতোর গোড়ালি।
উঠানের শেষে তুলসীগাছটা আবার শুকিয়ে উঠেছে। তার পাতায় খয়েরি রং। সেদিন পুলিশ আসার পর থেকে কেউ তার গোড়ায় পানি দেয়নি। সেদিন থেকে গৃহকর্ত্রীর ছলছল চোখের কথাও আর কারো মনে পড়েনি।
কেন পড়েনি সে-কথা তুলসীগাছের জানবার কথা নয়, মানুষেরই জানবার কথা।
মতিনউদ্দিনের প্রেম – সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
মতিনউদ্দিন মেদমাংসশূন্য ক্ষীণ কাঠামোর ক্ষুদ্র আকৃতির মানুষ। ক্ষিপ্রবেগে চলার অভ্যাস সত্ত্বেও পথেঘাটে সে সহজে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। বাচালতা দোষ। নেই বলে অন্যদের মতো অজস্র কথায় সৃষ্ট একটি স্পর্শনীয় দৃশ্যমান চরিত্রও তার নয়। আপিসে দীর্ঘ বারান্দা-ঘরের সহযোগীদের মতো রাজনৈতিক সামাজিক ব্যাপারে তার মতামত থাকলেও কচিই তা সে প্রকাশ করে। কেবল চাল-ডালের দামের কথা উঠলে সে একটি বিশেষ মন্তব্য না করে যেন পারে না। একই ভঙ্গিতে একই স্বরে সে প্ররি বলে, শায়েস্তা খানের আমলে এক মণ চাল পাওয়া যে মাত্র দু-আনায়। উক্তিটা সত্য হলেও তা এখন সময় কালবহির্গত এবং বাস্তব হতে এত দূরস্থিত শোনায় যে তার সে-ঐতিহাসিক মন্তব্যটি শুন্যে বুলে মিলিয়ে যায়। সে-সব্যটিও তার সহযোগীদের মনে তার সম্বন্ধে স্বল্পভাষী নলাজুক মানুষের ছবিটিতে বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আনে না।
তবে বাড়িতে পা দেওয়া মাত্র সেমানুষেরই চেহারা-হাবভাবে একটি বিষম পরিবর্তন ঘটে। বাইরে মতিনউদ্দিন এবং ঘরের মতিনউদ্দিনের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। ইট-তর্জা, টিনযোগে কোন মনে দাঁড়া করিয়ে রাখা তার ক্ষুদ্র বাসস্থানটি তার নতুন চরিত্রে স্পর্শে প্রাসাদে পরিণত হয়, এবং ঘরে তার স্ত্রী ছাড়া দ্বিতীয় কোন লোক
থাকলেও মনে হয় যেন তার হুকুম তামিল করবার জন্য মোসাহেব-গোমস্তা বাবুর্চি-খানসামা পেয়াদা-কাবরদারের অন্ত নাই। তখন তার ত্রিশ-ইঞ্চি বুক থেকে অহরহ বাঘের মতো আওয়াজ বের হয়। তবে বন-জঙ্গলের শক্তিশালী পশুটির মতো তার সিনাটা গভীর নয় বলে মনে হয়, নিনাদ প্রচেষ্টায় যে-কোন সময়ে তার রগ ফেটে যাবে। মতিনউদ্দিনের খড়মেও কম আওয়াজ হয় না। বরাবর দেখে-শুনে শক্ত মজবুত খড়ম কেনে সে। বস্তুত, তার ঘরের জাদরেল সত্তাটির একধারে তার গলা অন্যধারে। খড়ম।
তিন বছর হলো তাদের বিয়ে হয়েছে। কিন্তু তার বউ খালেদা এখনো জানে না। কখন তার স্বামী হুঙ্কার দিয়ে উঠবে, কখন হুড়ুম করে লাফিয়ে যাবে উঠান থেকে কাক কুত্তা তাড়াতে। সেজন্যে সত্যিই পান থেকে চুন খসার প্রয়োজন নাই, উঠানে কাক কুত্তার উপস্থিতির দরকার নাই। দিনের মধ্যে কতবার যে খালেদার বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে, তার ঠিক নাই।
খালেদাও ছোটখাটো মানুষ। গোপনে শরীরে একটু-যে মেদমাংস হয়েছে সে ধরটা ঢাকতে চেষ্টা করে নিঃশব্দে আলগোছে হেঁটে, দেহটা কাপড়ে জড়িয়ে রেখে। অবশ্য এ-বিষয়ে তার লজ্জার কোন অর্থ নাই, সাবধানতাও নিষ্প্রয়োজন। মউিদ্দিন কখনো তার বউ এর দিকে চোখ খুলে তাকায় না। তাকালেও বুঝবে না যে তার স্ত্রী কেমন একটু মোটাসোটা হয়ে উঠেছে। দোষভাবটা খালেদার মনেই। মোটা-হওয়া মানে খেয়েদেয়ে সে আরামেই আছে। সে কথা প্রকাশ করতে তার লজ্জা হয়। বিশেষ করে স্বামীটি যখন তেমন রোগাপটকাই থাকে।
তারপর একদিন অকস্মাৎ মতিনউদ্দিনের মধ্যে একটি অবিশ্বাস্য পরিবর্তন ঘটে। এমন আশ্চর্য ঘটনাটি ঘটে বিনা খবরে, তার অব্যবহিত পূর্বে ক্ষীণতম ইঙ্গিত ছাড়া। পরিবর্তনটি শুরু হয় সকালেই, কিন্তু খালেদা তা লক্ষ করে সন্ধ্যাবেলায়। সেদিন আপিস থেকে ফিরে বেড়াঘেরা ক্ষুদ্র উঠানে বসে মতিনউদ্দিন কেমন নীরব হয়ে থাকে। বসার ভঙ্গিটা শিথিল, দৃষ্টি মাটির দিকে। নিত্যকার মতো চায়ের পেয়ালাটা নিয়ে আসে খালেদা। মতিনউদ্দিন চা পান করে বটে কিন্তু অন্যদিনের মতো থেকে থেকে তৃপ্তিসূচক উচ্চ আওয়াজ করে না। তারপর খালেদা কাটা নিয়ে এলে সে ধূমপানও করে, কিন্তু আজ ইঞ্জিনের ধুয়ারমতো রাশি রাশি ধুয়া নির্গত হয় না, কার পানিতে দুর্দান্ত গড়গড় আওয়াজও হয় না। ধূমপান শেষ করেও মতিনউদ্দিন কেমন নিস্তেজ ভাবে বসে থাকে, বেড়ার ওপর বসে একটা কাক তারস্বরে আর্তনাদ শুরু করলেও সে টু শব্দটা করে না। এদিকে সূর্য ডুবে যায়, আকাশে চাঁদ ওঠে, পাশের বাড়িতে ছেলেটি উচ্চকণ্ঠে ইতিহাস পাঠ খতম করে ঘুমোতে যায়। খালেদা চুলার আগুনের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে, কিন্তু উঠান থেকে কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করে না, খাবার তৈরি হয়েছে কিনা।
তিনদিন কাটলেও মতিনউদ্দিনের এ-অত্যাশ্চর্য ব্যবহার শুধু-যে অব্যাখ্যাত থাকে তা নয়, তার সেব্যবহারে কোন তারতম্যও হয় না। সেদিন রাতে খাবার সময়ে হ্যারিকেনটা একটু তেজ করে রাখে খালেদা। স্বামীকে সে ভালো করে দেখতে চায়, যদি বুঝতে পারে তার পরিবর্তনের কারণ। সে দেখে, মতিনউদ্দিনের মুখে ব্যথা বেদনার কোন স্পর্শ নাই, থমথমে ভাব নেই, কিন্তু গভীর ঘুম থেকে থেকে জেগে ওঠার-পর বেদনার কোন স্পর্শ নাই, থমথমে ভাব নেই, কিন্তু গভীর ঘুম থেকে জেগে-ওঠার-পর মানুষের মুখে যেমন একটা আবেশ দেখা যায়, তেমনি একটা আবেশে তার সারা মুখ আচ্ছন্ন। হাত-মুখ নড়ে, কিন্তু তার মনটা যেন ঘুমিয়ে। কিংবা দেহ-পরিত্যাগ করে তার মনটি কোথাও নিরিবিলি স্থানে গাছের ডগায় একাকি বসে আছে।
খালেদার চোখ স্বামীর ওপর থাকে বলে গ্লাসটা হাত থেকে পড়ে যায়। মেঝেটা মাটির বলে সেটি না ভাঙলেও পানি ছড়িয়ে পড়ে। সভয়ে খালেদা স্বামীর দিকে তাকায়। কিন্তু স্বামীর চোখ বর্তন থেকে ওঠে না। তারপর খাদ্যের গন্ধ পেয়ে একটি নোমছাড়া কুকুর চোরের মতো অনিশ্চিতভাবে দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরের দিকে তাকালে একটু অপেক্ষা করে খালেদাই আজ কুকুরটাকে তাড়িয়ে দেয়।
এবার হঠাৎ খালেদার মনে হয় মউিদ্দিনের ব্যবহার আর সহ্য করা যায় না। স্বামীর হুঙ্কার গর্জন লাফাঝাপি সহ্য হয়, কিন্তু তার এই পরিবর্তন সহ্য করা হয় না। কিন্তু সে কি করবে? স্বামীকে কোন প্রশ্ন করা যায় না। তিন বছরের পারিবারিক জীবনে তাদের মধ্যে এমন একটি আদত গড়ে উঠেছে যে, কোন ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা সহজ নয়। কাক কুত্তা ত্যক্ত করলে তা নিয়ে কথা হতে পারে, কিন্তু স্বামী একমাস কথা না বললেও তাকে জিজ্ঞাসা করা যায় না তার মৌনতার হেতু। অনেক হাসি ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অনেক কথা জিজ্ঞাসা করে, গুরুর কথারও উত্থাপন করে মতিনউদ্দিনের ঘরে তা সম্ভব হয়। বিয়ের প্রথম মাসেই তার স্বামী পরিষ্কারভাবে তাকে বলে দিয়েছিলো যে, হাসি-ঠাট্টার মানুষ সে নয়। একদিন রাতের বেলায় মতিনউদ্দিন যখন তার দিকে পিঠ দিয়ে শুয়েছিলো, তখন মস্করা করে হাল্কাভাবে সে তার পিঠে একটু খোঁচা দেয়। তৎক্ষণাৎ মতিনউদ্দিন বিপুলবেগে লাফিয়ে উঠে রেগে লাল হয়ে তাকে প্রশ্ন করে, গুতা দেও কেন? সেদিন থেকে খালেদার মস্করায় কোন সাধ নেই। অবশ্য তাতে খালেদার কোন আফসোস নাই। তার মতে, স্বামীর আইনকানুন আচার ব্যবস্থা স্ত্রীকে মানতেই হয়।
কাজেই হ্যারিকেন তেজ করে রাখলেও খালেদা শেষ পর্যন্ত স্বামীকে কোন প্রশ্ন করে না, তার পরিবর্তনের কারণও জানতে পারে না। তাতে অতি প্রত্যুষে উঠে নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে স্বামীটি যখন আঙ্গিনায় বসে চুপচাপ হয়ে তাকে, তখন তার মনে একটা ভয়ের সঞ্চার হয়। তার স্বামীটির হলো কি?
জাগ্রত সময়ের প্রতি মুহূর্তে মানুষ কিছুনা-কিছু ভেবেই চলে। তবে প্রত্যেকের চিন্তাধারার স্বরূপটা নিজস্ব। খালেদার মনে চিন্তাধারাটি দুই বন্ধুর আলাপ-আলোচনার রূপ গ্রহণ করে।
খালেদা তার মনের বন্ধুকে বলে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। বন্ধু উত্তর দেয়, বোঝা মুশকিল।
তারপর খালেদা এবং তার মনের বন্ধু দু’জনেই কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে থাকে।
নির্বাক হয়ে থাকলেও একটা কথা দু’জনের মধ্যেই উকিঝুঁকি মারে। কেবল সেটা তুলতে কারো সাহস হয় না। অবশেষে তার বন্ধুই বলে, আমার কি মনে হয় জানো?
কি? সে উত্তর দেয়।
মনে হয় কোন মেয়েলোকের ওপর তোমার স্বামীর দিল পড়েছে।
সে টক করে উত্তর দেয় না। কথাটা সে যেন বোঝে না। দিল পড়ার অর্থ কি? কেনই বা একটি পুরুষের দিল একটি মেয়েমানুষের ওপর পড়ে? তাছাড়া, সে-ও কি মেয়েমানুষ নয়?
তার মনের বন্ধু উত্তর দেয়, হয়তো মেয়েলোকটি সুন্দরী।
খালেদা কিন্তু তার মনের বন্ধুর কথা মানতে চায় না। মাথায় একটু ঝামটা দিয়ে বলে, আমি জানি তার কি হয়েছে।
কি হয়েছে?
কোন ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে। মনের বন্ধু হাসে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়েছে না কচু হয়েছে। দেখ না কেমন যত্ন করে সিঁথি কাটে আজকাল, মুখে-চোখে কেমন আবেশ?
খালেদা জবাব দেয় না। সে নিজেই বোঝে, ফকির-দরবেশের ডাক পড়লে খোদারসুলকেও মনে পড়ে। কিন্ত মতিনউদ্দিনের মধ্যে বিচিত্র পরিবর্তনটা আসার পর সে একদিনও কলমা পর্যন্ত মুখে নেয় নাই। হয়তো তোমার কথাই ঠিক। সে মনের বন্ধুকে বলল। একটু থেমে আবার বলে, তবে চিন্তার কারণ নাই। ভেবেছিলাম, তার অসুখ-বিসুখ হয়েছে বুঝি।
মনের বন্ধু মুখ টিপে হাসে।
সুন্দরী মেয়েমানুষের ওপর তোমার স্বামীর মন পড়লে চিন্তার কারণ নাই?
চিন্তার কি কারণ? গোয়ার্তুমির ভাব করে খালেদা উত্তর দেয়।
যদি তোমাকে তাড়িয়ে দিয়ে তাকে বিয়ে করে?
আবার কিছুক্ষণ খালেদা নীরবে ভাবে। তারপর আরেকবার মাথায় ঝামটা দিয়ে বলে, আমি চলে যাব।
সে ভাবে, অন্য একটি বউ ঘরে নিয়ে এসে তাকে তাড়িয়ে দিলে সে বাপের বাড়িতে না-হয় ভাই-এর বাড়িতে চলে যাবে। এখানে ভাত কাপড়টা পায়, বাপ-ভাই এর বাড়িতেও ভাত কাপড়টাও পাবে। দেশের বাড়িতে ক্ষেতখামার আছে, কুমড়ো শাকবজি আম-কাঁঠাল আছে, গাই-ছাগল আছে, এখানে উঠান ছাড়া আছে কি?
কিন্তু তুমি একটি মানুষের বউ। তাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না?
আবার একটু ভেবে খালেদা জবাব দেয়, কষ্ট কিসের? যেতে হলে যাবো।
মতিনউদ্দিনের চিন্তাধারাটা ভিন্ন ধরনের। তার মনের প্রাসাদের থামের আড়ালে দেয়ালের আনাচে-কানাচে অসংখ্য শ্রোতা। তবে তারা নীরবেই তার কথা শোনে। কেবল তারই কণ্ঠের প্রতিধ্বনি জাগে মনের সেপ্রাসাদের কক্ষে কক্ষে।
তবে তার মধ্যে ঘোর পরিবর্তনটি আসার পর তার চিন্তাধারার রূপটাও বদলেছে। আজ তার মনের প্রাসাদ নির্জন, সেখানে শ্রোতারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে নিঃসঙ্গ প্রাসাদের অসীম ভার সে একাই বহন করে বেড়ায়—আপিসে দীর্ঘ ঘরে হোক, মিষ্টমধুর কলতানমুখর নদীতীরে থোক, আপন ঘরেই হোক। তার এই নিঃশব্দ জগতে একটি কাক পর্যন্ত নাই যে-একটু শব্দের লহরি তুলবে।
আসলে একটা নিদারুণ ভয় পাথরের মতো ভারি হয়ে চেপে আছে তার মনে। সে ভয়েই নিজের মনে কোন কথা তুলতে সাহস পায় না। কি হয়েছে তার?
সে বোঝে, ভয়ের তলে আসলে আছে একটি বিচিত্র মিগ্ধভাব—এমন-এক ভাব যার স্পর্শে এক চাঁদ শত চাঁদ হয়ে ফুটে ওঠে, ধানের ক্ষেতের মধুর হাওয়ার ঢেউ জাগে। সত্য কথা বলতে কি, সে প্রেমেই পড়েছে কেবল কথাটা স্বীকার করার সাহস তার নাই। না হলে পাথর ঠেলে যে-মিগ্ধ মনোরম ভাবটি বারেবারে তার মনে ছেয়ে ফেলতে চায়, তাকে সে বাধা দিতো না।
সে যে তার পারিবারিক জীবনের বা খালেদার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আপন মনে এই সংগ্রামে লিপ্ত হয়, তা নয়। বস্তুত, এ-পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যেও সেসব কথা তার মনে পড়ে নাই। সে-যে দায়িত্বহীন তাও নয় পারিবারিক শাসন-সংযমের খাতিরে কঠোর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা সে বিশ্বাসী বলে তার মনোভারে বাহ্যিক কোন পরিচয় সে দেয় না। কিন্তু খালেদার প্রতি তার স্নেহ-মমতা-দায়িত্ববোধের অন্ত নেই।
যে কারণে পরিবারের কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনের আকাশে উদয় হয় না তা এই যে, তার হৃদয়ে যে প্রেমের ভাবটি জেগেছে তা অতি বিচিত্র। আসলে তার কোন বাস্তবরূপ নাই; সে-প্রেমের উৎপত্তি স্বপ্নের মধ্যেই। তবু আজ কদিন ধরে তা-তাকে গম্ভীরভাবে আবিষ্ট করে রেখেছে তার মানসিক সংগ্রামের এবং ভয়ের কারণ তাই। সেজন্যেই তার মনের প্রাসাদ কেচ্ছা কাহিনীর অভিশপ্ত কোন প্রাসাদের মতো নিস্তব্ধ নির্জন।
স্বপ্নের কথাটি সে ভাবতে চায় না। ও বারবার তারই অজ্ঞাতে তার মনে তা ভেসে ওঠে এবং প্রতিবারই তাকে কেমন অবশ করে ফেলে।
তার স্বপ্নটি এই। সে পুরুকে গোসল করতে যাচ্ছে, হাতে লাল গামছা। সেদিন কোন কারণে তার বড় তাড়াতাড়ি। হয়তো আপিসে যাওয়ার সময় উতরে গেছে। ঘরের বউটিও রান্না করতে দেরি করেছে। গোসল করতে গিয়েও তার আবার দেরি হয়, কারণ সে দেখতে পায় পুকুরের ধারে মস্ত একটা বাজার বসেছে। মানুষের হৈ হট্টগোল, ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকাহাঁকি, গরু-ছাগলের পায়ের ধুলায় স্থানটি ভরপুর। ভিড়ের মধ্যে অসংখ্য মানুষের গা ঘেঁষাঘেঁষি। করে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সময় দুর্ধর্ষগোত্রে একটি পুলিশ এসে তার হাত ধরে। তারপর মুহূর্তে কোথাও সব গোলমাল হয়ে যায় যেন। সে যেমন জানে তেমনি পুলিশও জানে, সে নির্দোষ। লু সে দৌড়তে শুরু করে প্রাণপণে। শীঘ্র সে ভোলা মাঠে এসে পৌঁছয়, উন্মুক্ত হাওয়ায় তার বুক ভরে ওঠে। পুলিশ তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। লু তার ভয়টা সম্পূর্ণভাবে যায় না। ক্ষেত্রে আল ধরে পুর্ণোদ্যমে আবার সে ছুটতে শুরু করেছে। এমন সময় সারা আকাশ খণ্ডবিখণ্ড করে একটি নারীর আর্তনাদ জেগে ওঠে। সে নারীর আর্তনাদে কি ছিলো কে জানে, কিন্তু পুলিশের ভয় ভুলে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে সে দাঁড়িয়ে। পড়ে। শীঘ্র সে বুঝতে পারে, নারীকণ্ঠ আর্তনাদ করে তাকেই ডাকছে। উদভ্রান্তের মতো সে এদিক-ওদিক তাকায় প্রথমে কোথাও কাউকে দেখতে পায় না। তারপর বিস্ময়ে সে দেখে, সামান্যদুরে বেড়ার পাশে দাঁড়িয়ে একটি সুতন্বী নারী। তার পরনে উগ্র লাল বর্ণের শাড়ি, মুখে কেমন বেদনাভরা নমনীয়তা। তাদের চোখাচোখি হতেই নারীটি তাকে হৃদয়বিদারক কন্ঠে অনুরোধ করে, সে যেন তাকে ফেলে না যায়। পরক্ষণেই উত্তরের অপেক্ষা না করে সে বুক ভাসিয়ে কাঁদতে শুরু করে। সে যেন বুঝতে পারে, মতিনউদ্দিন তাকে ফেলে চলে যাবেই। এসময় মউিদ্দিনের ঘুম ভেঙে যায়, স্বপ্নেরও অবসান ঘটে।
স্বপ্নটি স্বপ্ন বলেই উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে মতিনউদ্দিন। ক্রন্দনরতা যে মেয়েকে সে জীবনে কখনো দেখে নাই, নিদ্রায় তার আবির্ভাব স্বপ্নের খামখেয়ালি এবং অর্থহীনতা ব্যতীত আর কি? বুদ্ধিমত্তার যুক্তি কিন্তু জয়ী হয় না। সব বুঝলেও সে অজানা মায়াময়ীর ডাক, তার অনুরোধ, তার কান্না ক্রমশ মতিনউদ্দিনের মনে একটা বিচিত্র মোহজাল বিস্তার করে। যেকণ্ঠ সে শুনতে চায় না সেকণ্ঠ বারবার তার মধ্যে অবিশ্বাস্য ঝংকারের সৃষ্টি করে, যার রেশ অবশেষে তার সমগ্র দেহে ছড়িয়ে তাকে গম্ভীরভাবে অভিভূত করে। সে জানে স্বপ্নটির কোন অর্থ নাই। তু তার হাত থেকে নিস্তার পায়না। বরঞ্চ তার মনে হয়, সে স্বপ্ন তার মধ্যে একটি নতুন সৌন্দর্যদীপ্ত আকাশ উন্মুক্ত করেছে, একটি সুপ্ত চেনাকে যাদুমন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছে, একটি বিস্ময়কর ভাবাবেগের দ্বার খুলে দিয়েছে। ক্রমশ তার মনে হয়, নারীটি যেন অবাস্তব নয়, একটু চাইলেই সে সশরীরে উপস্থিত হবে। একথায় সে ভয়ই পায়।
তারপর আজ সন্ধ্যায় একাকি নদীতীরে বসে আরেকটি কথা উপলব্ধি করলে তার ভীতিটা আরো ঘনীভূত হয়। সে বুঝতে পারে স্বপ্নের সে নারীটি শুধু যে তার মনের সুখশান্তি ধ্বংস করেছে তা নয়, সংসার থেকেও তার মনকে যেন উঠিয়ে নিচ্ছে। খালেদা তার স্বপ্নের নারীর তুলনায় সোনার পাশে পেতলের মতো সস্তা, অলোভনীয় হয়ে পড়েছে ভয়ে ক্ষণকালের জন্যে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সে বোঝে, অবাস্তব যখন বাস্তবকে ধ্বংস করে তখন প্রত্যুত্তরে কিছু করবার থাকে না। বাস্তবের পক্ষে অবাস্তবের সঙ্গে যুদ্ধ করার কোন অস্ত্র নাই।
স্বপ্নের মায়াময়ী নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করার অস্ত্র মতিউদ্দিনের নাই।
ক্ষুদ্র উঠানের কোণে খালেদাও একাকি বসে। অনেকক্ষণ ধরে একটি বাসনই সে বারেবারে মাঝে-ঘষে। মনের বন্ধুর সঙ্গে কথালাপনে মগ্ন থাকে বলে তা সে লক্ষ করে না।
মনের বন্ধু বলে মেয়েলোকটি কেমন সুন্দরী তা তোমার জানতে ইচ্ছা করে না?
খালেদা একটু ভাবে। সুন্দরী হওয়াটা কী? আসলে সে কথাই তার সর্বপ্রথম জানতে ইচ্ছা করে। জীবনে সে বেশি মেয়েমানুষ দেখেনি। দেশের বাড়িতে কুলসুম আমেনাকে দেখেছে। এখানে পাশের কুনু বিবির সঙ্গে তার দেখা হয়। কিন্তু কখনো ভাবেনি কে কার চেয়ে বেশি সুন্দরী, কেবা রূপবতী। কে কার বউ, বা মেয়ে, কার কি নাম, সে-সব কথাই মনে এসেছে। অবশ্য ছোটবেলায় পরীর কথা শুনেছে। কিন্তু তারা হাওয়াই বস্তু। মানুষের আঁটগাটের বাইরে তাদের বিচরণ।
কে জানে। হয়তো পরীর ওপর তার নজর পড়েছে বলে সে হাসে। হাসিটা অবশ্য লোক দেখানো। তার বন্ধুর খাতিরেই সে হাসে। গম্ভীর হয়ে বলে, সুন্দরী হোক অসুন্দরী হোক, আমার তাতে মাথাব্যথা নাই। তবে আজকাল তার খাওয়াটা কমে গেছে। বাসনে হাত নাড়াচাড়া করেই উঠে যায়। কি করি?
কি আর করবে?
মনে হয় চোয়ালের নিচে গাল বসে গেছে। হয়তো অসুখই হয়েছে।
জ্বর নাই, কাশি নাই, লোটা নিয়েও দৌড়াদৌড়ি নাই— অসুখ আবার কিরে?
তবে করি কি?
কি আর করতে পারো তুমি?
একটু থেমে খালেদা আবার বলে, থেকে-থেকে বুকের ভেতরটা কেমন করে ওঠে। মানুষটার হলো কি? হাঁকাহাঁকি নাই, গলাবাজি নাই। হলো কি তার? কবরের মতো নিঝুম ভাবটি আর সত্যিই সহ্য হয় না। একদিন আমিই এবার পাগলের মতো চেঁচিয়ে উঠবে বলে দিলাম।
কথাটি অবশ্য তার মনের বন্ধুরও বিশ্বাস হয় না।
কিন্তু তা যে শুন্য ভয়প্রদর্শন নয়, খালেদা তার প্রমাণ দেয় সেদিন সন্ধ্যাবেলায়। আপিস থেকে ফিরে কাপড় বদলে উঠানে নিত্যকার মতো মতিনউদ্দিন চা-এর জন্যে অপেক্ষা করে। সে লক্ষ করে না যে চুলার তলে ঠাণ্ডা ধূর ছাই-এর ভূপ, খালেদাও দরজার চৌকাঠ ধরে নিস্পন্দ হয়ে দাঁড়িয়ে চা না এলে সে একবার অস্পষ্টভাবে এদিক-ওদিক তাকায়, কিন্তু কিছু বলে না। খালেদা নড়ে না। সে একটা উল্লাসমিশ্রিতভীতি বোধ করে। মনে হয় তার স্বামী হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠে চা দাবি করবে।
কিন্তু মতিনউদ্দিন কিছুই বলে না। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে ঘুমঘোরের মতো উঠে ভেতরে যায়, শার্ট-জুতা পরে তারপর আবার উঠানে নামে। খালেদাকে সে দেখেই না যেন।
মতিনউদ্দিন যখন উঠানের মধ্যখানে পৌঁছয় তখন খালেদার দেহে কেমন অদম্য কাঁপন ধরেছে। সে নিজেই বুঝতে পারে না, তার কারণ রাগ না ভয়।
মতিনউদ্দিন ততক্ষণে উঠানটা অতিক্রম করেছে বটে কিন্তু অদৃশ্য হয়ে যায় নাই। খালেদা দরজার চৌকাঠ শক্ত করে ধরে। তারপর তার দেহের সে-অদম্য কম্পন হঠাৎ একটি চিৎকারে কেন্দ্রীভূত হয়ে উচ্চ, তীক্ষ্ণ আওয়াজে ফেটে পড়ে। সে বলে, মানুষটি যাচ্ছে কোথায়?
নিজের কানেই চিৎকারটি বিচিত্র শোনায়।
বেড়ার পাশে মতিনউদ্দিন থমকে দাঁড়ায়। তার সারা মুখে গভীর বিস্ময়ের ছায়া। সে অবুঝের মতো এধার-ওধার তাকায়। তারপর তার দৃষ্টি ফিরে যায় খালেদার প্রতি। তার বিস্ময়টা আরো বেশি। নির্বোধের মতো তার নিচের ঠোঁটটি ঝুলে থাকে। সে যা দেখে তা তার যেন বিশ্বাস হয় না।
সেরাতে মতিউদ্দিনের নিথর ভাবটি মাত্রাতিরিক্তই মনে হয়। রাতটাও কেমন গুমোেট ধরে আছে। কোথাও হাওয়া নাই। পাশে বাণ্ডিলের মতো নিস্তেজ হয়ে শুয়ে খালেদা কান খাড়া করে রাখে। তার স্বামীর চোখে যে ঘুম নাই সে কথা সে জানে।
আজ মতিনউদ্দিনের নিদ্রাহীনতার কারণটি কিন্তু একদিনের মোহ নয়। বস্তুত, আজ সন্ধ্যায় বেড়ার নিকট হতে ফিরে আসার পর হঠাৎ সে বুঝতে পারে, স্বপ্নের সুতন্বী নারীটি তার হৃদয়বিদারক আবেদন ক্রন্দনসহ কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখন সজ্ঞানভাবে সে নারীর কথা স্মরণ করলেও হৃদয়ে ভাববেগের ঢেউ ওঠে না, দেহে মধুর ঝংকার জাগে না। প্রথমে সে একটু ক্ষোভ বোধ করে, তারপর মনে স্বস্তিই পায়। এখন যে কথা তার ঘুমের ব্যাঘাত করে তা হচ্ছে এই। স্বপ্নের মায়াময়ী নারীর হাত থেকে সে নিস্তার পেয়েছে বটে কিন্তু সে যেন এখনো ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করে নাই : সূতম্বী নারীটি তাকে নিরবল অবস্থায় ঝুলিয়ে রেখেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। যে পাখায় ভর করে একদিন সে উড়ে বেড়িয়েছিলো সে-পাখা আর নাই বটে কিন্তু সে তার পায়ের তলে শক্ত জমি এখনো ফিরে পায় নাই। তাছাড়া তার কণ্ঠেও এখনো ভাষা ফিরে আসে নাই। শুধু তাই নয়, হঠাৎ খালেদা সম্বন্ধে এমন একটি তীক্ষ্ণ সচেনা সে বোধ করে যে একটু নড়বারও সাহস সে পায় না যেন। তবে তার সন্দেহ। নাই, একবার সে ধরণীতে প্রত্যাবর্তন করতে পারলে তার নিরাবলম্বভাব, তার বাকশূন্যতা এবং খালেদার বিষয়ে তীক্ষ্ণ বেদনাদায়ক সচেতনাটি দূর হয়ে যাবে, কিন্তু কি করে সে মৃত্তিকাময় স্থূল পৃথিবীতে প্রত্যবর্তন করে, কি করেই বা তার সাধারণ স্বাভাবিক জীবন পুনঃগ্রহণ করে?
সাহায্য আসে অপ্রত্যাশিত অঞ্চল থেকে।
বেহেস্ত-প্রেরিত একটি ফেরেশতা অতি দক্ষতার সঙ্গে তাদের মশারির মধ্যে অদৃশ্য একটি ছিদ্র আবিষ্কার করে। সে-ছিদ্র দিয়ে সে মশারিতে প্রবেশ করে কয়েক মহুর্ত বিজয় উল্লাসে নৃত্য করে। অবশ্য তার আবির্ভাব অলক্ষিতই থাকে। গব্যস্থলে পৌর প্রশংসনীয় দক্ষতা সত্ত্বেও মনস্কামনা চরিতার্থ করার ব্যাপারে অশেষ ধৈর্য অধ্যবসায় থাকা সত্ত্বেও ফেরেশতাটি একটি অতিক্ষুদ্রকায় জীবন, দিনের বেলায় তার ছায়া পড়ে না কোথাও, রাত্রে অন্ধকারে সে অদৃশ্যই থাকে।
গ্যস্থলে পৌঁছানোর আনন্দোচ্ছাসটি কাটলে বেহেস্তপ্রেরিত ফেরেশতাটি এবার আপনকার্যে মনোনিবেশ করে। কাপড়ের বান্ডিলটি উপেক্ষা করে সরাসরি মতিনউদ্দিনের ঘর্মাক্ত ডান গালে সে অবতীর্ণ হয়। তার স্বীয় পাখাদুটিতে আলগোছে বার কয়েক ঝাঁপটা দিয়ে সে হঠাৎ নিশ্চল হয়ে পড়ে।
একটু পরে আকস্মাৎ চাপড়ের মতো উচ্চ আওয়াজ শোনা যায়। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রে গভীর নীরবতা মতিনউদ্দিনের নিকট আর্তনাদের ভঙ্গুর কাঁচের মতোই খণ্ডবিখণ্ড হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। নিজের গালে চাপড় দিয়ে এবং আর্তনাদ করেই মতিনউদ্দিন ক্ষান্ত হয় না। দুর্ধর্ষ গলায় হুঙ্কার দিয়ে বলে, মশারিতে হাজারো মশা। কি করে মানুষ চোখ বোজে?
তারপর মশারিতে যে মশার অন্ত নাই সেকথাই প্রমাণ করার জন্যে সে ঠাসঠাস করে নিজের দেহের নানা স্থানে চড়-চাপড় মারে। মশা মারতে সে কামান দাগে।
অন্যদিন হলে খালেদা উঠে মশারিটা ঝেড়ে আবার সযত্নে গুঁজে দিতো। আজ সে নড়ে না।
মতিনউদ্দিন অবশেষে শান্ত হয়। শবিজয়ী সেনাপতির মতো আত্ম সচেতভাবে কিছুক্ষণ নড়েচড়ে সে যখন ঘুমের আয়োজন করে, তখন তার পিঠটা খালেদার পিঠের সঙ্গে একটু লেগে থাকে। গ্রীষ্মের দিনে সে সংস্পর্শ মধুর না হলেও মতিনউদ্দিন সরে না।
খালেদার চোখে যখন নীরব অশ্রুর আবির্ভাব হয় তখন বাড়িতে ডাকাত পড়েছে এমন রব তুলে মউিদ্দিন নাক ডাকতে শুরু করেছে।