দ্বিতীয়া বলল, মৌলানা বলে থান ভাঙতে হবে? এমন তো শুনিনি কখনও। বুক, ছেলেটা কী বলছে শোন।
রুকু মুখ টিপে হাসছিল। জল কুলকুচি করে আকাশে ছুঁড়ে বলল, থান কেউ ভাঙে? ও আমাদের সঙ্গে তামাশা করছে।
শফি জলভরা বদনা নিয়ে উঠে দাঁড়াল। খুব গম্ভীর হয়ে বলল, আমরা থান টান মানি না। আমরা ফরাজি।
দুই বোন একসঙ্গে চমকে উঠে বলল, কী বললে?
আমরা ফরাজি।
দুজনে আবার হেসে উঠল। রুকু একটু তেজি। সে সুব ধরে ছড়া কাটল:
ফরাজিদের নমাজপড়া
টেকির মতন মাথানাড়া ।।
শফির কান লাল হয়ে উঠল। অনেক জায়গায় হানাফি সম্প্রদায়ের ছেলেরা এই ছড়া গেয়ে তাকে উত্যক্ত করত। সে ভীষণ খেপে গিয়ে ঢিল ছুঁড়ে ভাগিয়ে দিত তাদের। এরা যদি ছেলে হত, সে হাতের বদনাটা ছুঁড়ে মারত। কিন্তু এরা মেয়ে। তাছাড়া এরা যে যমজ দুটি বোন তা সে বুঝতে পেরেছে। সে তাদের উপেক্ষা করল। আৰু এইসময় গাড়োয়ানরা বালতি হাতে ঘাটের দিকে আসছিল। তাই দেখে মেয়ে দুটি শাড়ি টেনে মাথা ঢাকল। তারপর ঝটপট কলসিতে জল ভরে ঘাটের একটা পাশ দিয়ে ভয়পাওয়া ভঙ্গিতে উঠে গেল। তারা ঘাটের মাথায় ভিড় দেখে থমকে দাঁড়াল একটু। তারপর সেদিকে না গিয়ে দীঘির ধারে-ধারে ভেজা শাড়ির শব্দ করতে-করতে পালিয়ে যাওয়ার মতো হেঁটে গেল। তারা মসজিদের ওপাশে ঝোঁপের ভেতর দিয়ে চলে গেলে তখন শফি ফিরে এল বটতলায়। রাগে দুঃখে অস্থির সে। মেয়েদের কাছে জীবনে এই প্রথম সে অপমানিত।
আর এরপরই হুজুর পির বদিউজ্জামানের দ্বিতীয় মোজেজা দেখা গিয়েছিল। মোজেজা ছাড়া আর কী বলা যায় একে? নকিব আর ফজল গ্রামে নতুন ধুরির খোঁজে গিয়েছিল। ওরা যখন ফিরে এল, তাদের সঙ্গে একশো লোক। লোকগুলির মুখেচোখে ঐশী নিদর্শন অনুসন্ধানের প্রচণ্ড আকুলতা, আর তাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল আকাশে। তারা ছবিতে আঁকা মানুষের মতো স্থির আর শব্দহীন। সেই জনতাকে দেখে অসিমুদ্দিন কিন্তু প্রথমে ভয় পেয়েছিল, কারণ সে-যুগে ফরাজিতে দীক্ষিতদের ওপর কোথাও-কোথাও হামলা ঘটত। সে দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে হুজুরকে খুঁজতে গিয়েই চমকে উঠল। অভিভূত হল সে। তার ঠোঁটদুটি কাঁপতে থাকল। তার সারা শরীরে রোমাঞ্চ দেখা দিল। দীঘির উঁচু পাড়ে শাহি মসজিদের প্রান্তে একখণ্ড পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন বদিউজ্জামান। ওইখানে কোনো বৃক্ষলতা নেই। চৈত্রের নীলধূসর আসমানের গায়ে আঁকা শাদা আলখেল্লা আর শাদা পাগড়িপরা মূর্তিটিকে দেখে মনে হয় ওই মানুষ দুনিয়ার নন। অসিমুদ্দিন সঙ্গে-সঙ্গে বুঝতে পারল আবার একটি মোজেজা ঘটতে চলেছে। সে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, আলহামদুলিল্লাহ! হে ঈশ্বর, সকল প্রশংসা শুধু তোমার। আর মৌলাহাটের সেই জনতাও অভিভূত। তারা ঘুম-ঘুম কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনি তুলল, আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! তারপর তারা গাম্ভীর্য আর সম্ভ্রমে এগিয়ে গেল সেই দিকে। পরগম্বর ইশা মানুষকে মেষপালের। উপমা দিয়েছিলেন। বস্তৃত মৌলাহাটের এই মানুষগুলি মেষপালের মতো দীঘির পাড় বেয়ে উঠে যাচ্ছিল। তারা ফারসি-হরফখখাদিত কালো গ্রানাইট শিলাটির সামনে। গেলে বদিউজ্জামান প্রথমে সম্ভাষণ করলেন, আস-সালাম। তারপর বদিউজ্জামান তার বিশাল দুই হাত প্রসারিত করে আলিঙ্গনের ভঙ্গিতে বললেন, বেরাদানে ইসলাম!…
এরপর তিনি যে ভাষণটি দেন, মৌলাহাটের মুসলমানেদের কাছে বংশপরম্পরায় একটি কিংবদন্তি-ভাষ হয়ে ওঠে। তারা বলত, হুজুর আমাদের কানে গরম সীসার মতো কিছু কথা ঢেলে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে আমরা অন্য কথা শুনতে পাই না। যদি বা শুনতে পেতাম, আমাদের কানের দুয়ার বন্ধ।
কিশোর শফি বটতলায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখছিল। পর্দার ফাঁক থেকে সাইদাও উঁকি দিয়ে দেখছিলেন। তিনিও অসিমুদ্দিনের মতো প্রথমে প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন, লোকগুলি নিশ্চয় হানাফি মজহারে এবং তাই তারা ফরাজি ধর্মগুরুকে হয়তো আক্রমণ করতে যাচ্ছে। পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা কামরুন্নিসা জিগ্যেস করেছিলেন, কী হল বউবিবি? অত পায়ের শব্দ হচ্ছে কেন? আমার বদুর কি কোনো বিপদ হল? কামরুন্নিসা উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন।….বউবিবি! তুমি কথা বলছ না কেন? সাইদার বুক কাঁপছিল। বিরক্ত হচ্ছিলেন শাশুড়ি বিবিজির প্রতি। একই উদ্বেগসংকুল দৃষ্টিতে সাইদা খুঁজছিলেন শফিকেও। শফি পর্দার ভেতর মায়ের কাছে চলে এলে সে নিরাপদ। কারণ ওরা স্ত্রীলোকদের ওপর হামলা করবে না। তিনি শফিকে দেখতে পেয়ে শরিয়তি অনুশাসন তুচ্ছ করে ঈষৎ চড়া গলায় ডাকলেন, শফি। শফি! পর্নাব্যুহের ফাঁকে তাঁর পাতাচাপা ঘাসের মতো ফ্যাকাসে আর কোমল হাতখানিও নড়তে লাগল। সেই হাতে তিনগাছি করে সবুজ কাঁচের চুড়ি ছিল। চুড়ির শব্দে বটতলায় আবিষ্ট অসিমুদ্দিনের চমক ভাঙল। সঙ্গে সঙ্গে সে চাপা স্বরে এবং মৃদু হেসে বলল, আল্লাহ আমাদের। ভর করবেন না মা-জননী। বাছা শফি-উজ্জামান। জলদি যেয়ে দেখুন, আম্মাজান তলব করেছেন।
শফি গ্রাহ্য করল না। সে দীঘির উঁচু শিলাখণ্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা তার আব্বা আর সামনে বসে-পড়া মেষপালটিকে দেখছিল। দেখতে-দেখতে যমজ বোনেদের কথাই ভাবছিল সে। তারা যদি এবার এই দৃশ্যটা দেখতে পেত! রাগ দুঃখ-অপমান ভুলে তারা শফির মনটা নির্মল হল। সে মনে-মনে বালিকাদুটিকে ক্ষমা করে দিল। আর অসিমুদ্দিন তার উদ্দেশে চাপা গলায় বলে, উঠল, কী দেখছেন বাপজান? তামাম মৌলাহাট ফরাজি হয়ে যাবে। আলহামদুলিল্লাহে রব্দুল আলামিন! এমন কী ঝটপট দুহাত প্রার্থনার ভঙ্গিতে সে মুখে ঘষতে থাকল। শুধু গাড়োয়ানদের কোনো দৃকপাত ছিল না। তারা নিঃশব্দে দীঘি থেকে জল এনে বলদগুলিকে জাবনা খেতে দিচ্ছিল। নকিব তার ভাঙা ধুরিটাতে বারবার হাত বুলিয়ে পরখ করছিল। পরে সে বলেছিল, হুজুর সাহেবের কথা শোনামাত্র আমার ধুরির কথা চাপা পড়েছিল। চাদ্দিকে অমনি ছুটোছুটি, হাঁকডাক, ওরে সব আয়, বদুপির এসেছেন। বটুপির এসেছেন। বলতে বলতে সে এক ঝড় বইয়ে দিলে। আর ফজল বলেছিল, নকুর কথা ধরো না। কী হয়, কী বলে? আসলে হাটতলায় একটা শালিশি বসেছিল। অনেক লোক ছিল সেখানে। আমি একজনকে আড়ালে ডেকে কালো জিন শাদা জিনের কথাটা বললাম। হুজুরের কেরামতির কথা বললাম। তবে তো–