ভয় পেয়ে শফি এরকম করত। একবার সন্ধ্যার পর গোরস্তানের পাশ দিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ প্রচণ্ড ভয় পেয়ে তেমনি হঠাৎ রুখে দাঁড়িয়েছিল সে। চিড়খাওয়া গলায় চিৎকার করে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, চলে আয, দেখি। পরে খুব লজ্জা পেয়েছিল সে। যদি কেউ শুনে থাকে, তাকে মেজভাইয়ের মতো পাগলা ভাববে যে? কিন্তু মজার কথা, পরে তাকে মেহেদি নামে একজন তোক বলেছিল, হ্যাঁ গো, সেদিন গোরস্তানে কার সঙ্গে করার করছিলেন? শফি বলেছিল, ও কিছু না চাচা! কিছু না।
উলুশরার মাঠে সকালের আলোয় তারপর সে ‘কালা জিনে’র কথা ভুলে গেল। ক্রমশ সে একটা নতুন আর অচেনা দুনিয়ার ঢুকে পড়েছিল। টের পাচ্ছিল, এ কোনো মানুষের দেশ নয়। ঘাসফড়িংগুলো কি কিড় করে ডাকছিল। ডাকছিল। পাখপাখালি। কাঁটাগাছের ফুলন্ত ঝোঁপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছিল কাশের ডগা ছুঁয়ে। একখানে খরগোশ দেখে গাড়োয়ানরা হল্লা করতে লাগল। একজন হুজুরের কাছে জানতে চাইল, খরগোশ হালাল না হারাম। হুজুর ফতোযা। দিলেন, জরুর হালাল। কিন্তু তখন খরগোস উধাও। শফি-একটা শেয়াল দেখল। একটা খেঁকশিয়ালি তার পায়ের ফাঁক দিয়ে পালিয়ে গেল। একটা ঢ্যামনা সাপ ছুটে গিয়ে ব্যানাবনে ঢুপে পড়ে। শফি বুঝতে পারছিল এটা মানুষের দুনিয়া নয়। সে ছিপটিটাকে শক্ত করে ধরে সতর্কভাবে হাঁটছিল। মাঝেমাঝে মুন্নিকে ছিপটির ঘা। মারছিল নেতাহ অকারণে। পোকামাকড়ের ডাক, পাখপাখালির ডাক, সাতখানা গোরুর গাড়ির ঘসটানো ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ, উলুকাশের শোঁ শোঁ শনশন আওয়াজের মধ্যে দিয়ে শফি চলেছে তো চলেছে। কখন হাওয়া উঠেছে। কাশবন দুলতে লেগেছে। কত অদ্ভুত নতুত-নতুন শব্দ। রোদ পড়লে মাথার টুপিটা খুলে পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে রাখল শফি।
তারপর হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে পর-পর সাতখানা গাড়ি থেমে গেল।
শফি কী হয়েছে দেখার জন্য দৌড়ে সামনে চলে গেল। তারপর থমকে দাঁড়াল। সামনে জল।
বদিউজ্জামান অবাক চোখে তাকিয়ে আছেন। আগের লোকটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে। কুলসুম এই সুযোগে দড়ি ঢিলে পেয়ে হাঁটু বাঁকা করে জল খেয়ে নিচ্ছে। গাড়োয়ান বোবাধরা গলায় বলে উঠল, হা আল্লা!
একটু স্তব্ধতা হকচকানি। তারপর কথা ফুটল লোকগুলোর। একজন চিৎকার করে উঠল, হারামি! নাফরমান।
সেই কালো লোকটি যে ভুলপথে পাঠিয়ে দিয়েছে, বুঝতে পারছিল সবাই। গাড়োয়ানরা তার উদ্দেশে ক্রোধ বর্ষণ করতে থাকল। তাদের মনে ভীষণ এবং জঘন্য গালাগালি। কিন্তু হুজুরের সামনে মুখখিস্তি করা চলে না। শফি তার আব্বাকে আবার লক্ষ্য করছিল। বদিউজ্জামানের নিষ্পলক দুটি চোখ জলের দিকে। ঈষৎ কুঞ্চিত। হাতের তসবিহদানা স্থির। ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে আছে। শফি মনে মনে বলল, আব্বা! আমি জানতাম।
সে ঘুরে দ্বিতীয় গাড়ির দিকে তাকাল। টাপরের পরদার ফাঁকে মায়ের একটা চোখ দেখা যাচ্ছে। শফির ইচ্ছে করল, মায়ের কাছে গিয়ে কালা জিনের কথাটা তোলে। কিন্তু কারুর কাছে ব্যাপারটা ধরা পড়েনি দেখে সে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেল। আর তার মনের ভেতর ঘুরে বেড়াতে থাকল ‘আমি জানতাম’ এই শব্দটা।
একজন জলে একটু নেমেই ব্যস্তভাবে উঠে এল। বলল, সর্বনাশ হুজুর। অগাধ পানি।
আরেকজন বলল, খাগড়ির সোঁতা না এটা?
তাই বটে।
কিন্তু এত পানি থাকার তো কথা না।
সেটাই আশ্চর্য লাগছে।
একজন ডাইনে-বাঁয়ে দূরে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে কোথায় লোকে বাঁধ দিয়ে পানি আটকেছে। বোরোধান পুঁতেছে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওই তো হারা রঙ ঝিকমিকোচ্ছে! তাকিয়ে দ্যাখো অসিমুদ্দিন।
অসিমুদ্দিন তাকিয়ে দেখল। সে বয়সে সবচেয়ে প্রবীণ। তার কপালে নমাজপড়ার কালচে ছোপ। পরনে খাটো লুঙ্গি গায়ে কোরা থানের পাঞ্জাবি। মাথায় তালশির দিয়ে তৈরি টুপি। সে গম্ভীর কণ্ঠস্বর ডাকল, হুজুর পিরসাহেব!
জি! বদিউজ্জামান আস্তে সাড়া দিলেন।
শয়তান আমাদের মুসিবতে ফেলে দিয়েছে।
জি।
হুজুর! এ মুসিবত থেকে বাঁচার রাস্তা আপনার হাতে। আপনি একটা কিছু করুন।
শফি বুতে পারছিল লোকটা কী বলতে চাইছে। উত্তেজনায় চঞ্চল, হয়ে উঠল সে। কালো জিনের কারচুপি সম্ভবত ধরতে পারছে ওরা। কিন্তু আব্বা চুপ কেন? জিনেরা তো তাঁর কথা শোনে!
এইসময় সাইদার চাপা ফুঁপিয়ে ওঠা শুনতে পেল শফি। তারপর আব্বার গর্জন শুনল। বেঅকুফ নাদান ঔরত! বেশরম কাঁহেকা!
অসিমুদ্দিন ডাকল, হুজুর!
গর্জন করার পর কান্নাটা থেমে গিয়েছিল। বদিউজ্জামান চোখ বন্ধ করেছেন। ঠোঁট কাঁপছে। নাসারন্ধ্র ফুলে উঠেছে। তারপর সুর ধরে উচ্চারণ করলেন, আউজুবিল্লাহে শয়তান-ইর রাজিম। বিশমিল্লাহে রহমান-ইর রহিম।
বদিউজ্জামানের কণ্ঠস্বর ছিল জোরালো, উদাত্ত। জমিদারি মসজিদের মিনারে উঠে কোনো-কোনো ফজরে আজান দিতেন নিজেই। সারা খয়রাডাঙ্গার ঘুম ভেঙে যেত। মধুরস্বরে কোরান আবৃত্তিকারদের বলা হয় কারি এবং কোরান যাদের মুখস্থ তাঁরা হাফিজ। বদিউজ্জামান ছিলেন কারি এবং হাফিজ দুই-ই।
কোরানের সুরা ইয়াসিন আবৃত্তি করছিলেন তিনি। বিপদে-আপদে এই সুরা আবৃত্তি করা হয়। নীলধূসর চৈত্রের আকাশের নিচে সেই গম্ভীর ও উদাত্ত ধ্বনি ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারদিকে। বলদগুলোও যেন শ্বাস ফেলতে ভুলে গিয়েছিল। চারপাশে কাশবনে শনশন হাওয়ার শব্দ, বনচড়ুইয়ের ঝাঁকে অস্ফুট ডাকাডাকি, ঘাসফড়িঙদের প্রচ্ছন্ন চিৎকার, তার মধ্যে সঙ্গীতময় ওই পবিত্র ঈশী-ধ্বনিপুঞ্জ। খাগড়ির সোঁতার ওপারে দুটি শাদা সারস মর্মর পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।