শফি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। খয়রাডাঙ্গা তাকে পেয়ে বসেছিল। কতবার তার ইচ্ছে করছিল, চুপিচুপি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাবে। কিছুক্ষণ আগে একটা স্বপ্ন দেখেছিল সে। মাদ্রাসার পেছনে বটগাছটার তলায় মৌলবি নাসিরুদ্দিনের মেয়ে জহরা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার স্বপ্নটা ভেঙে গেল। একটানা শো শো ঘস ঘস অদ্ভুত শব্দ শুনে সে উঠে বসল! পর্দা ফাঁক করে দেখল বালির চড়ার ওপর গাড়ি চলেছে।
গাড়ি থামলে সে লাফ দিয়ে নেমেছিল। তারপর ঘুরে নদীর ক্ষীণ স্রোতটার দিকে তাকাতেই স্বপ্নের কষ্টটা চলে গেছে। সে দৌড়ে নদীর জল ছুঁয়েছিল। তারপর আব্বা তাকে ডাকলেন, শফিউজ্জমান!
শফি সাড়া দিয়ে বলল, জি!
ওজু করো বেটা! আমরা এখানেই ফজরের নমাজ পড়ব।
নমাজে দাঁড়িয়ে সামনে নদীর ওপারে তাকিয়েই শফি চমকে উঠেছিল। ছাইমাখানো আলোয় কালো এক মূর্তি। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শফির মনে হল, তার চোখদুটোকেও সে দেখতে পাচ্ছে। জন্তুর চোখের মতো কি? যেন নীল চকচকে দুটি চোখ এবং তা শুধু শফিকেই দেখছে। শিউরে উঠল শফি।
করজোড়ে মোনাজাতের সময়ও আঙুলের ফাঁক দিয়ে শফি লক্ষ্য রেখেছিল কালো মূর্তিটার দিকে। সে তেমনি দাঁড়িয়ে।
নমাজ শেষ হওয়ার পর একজন গাড়োয়ান তাকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করল, এ ভাই! উলুশরার মাঠে রাস্তা হয়েছে?
লোকটার গলা শুনে আরও চমকে উঠল শফি। খ্যানখেনে এমন কণ্ঠস্বর কি মানুষের? সেও চেঁচিয়ে বলল, হয়েছে!
গাড়োয়ান তবু জিগ্যেস করল, হয়েছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে। তবে কিনা
তবে কিনা—
নদীটা ছোট। তত কিছু চওড়া নয়। হাওয়া বন্ধ ছিল। আস্তে কথা বললেও শোনা যেত। কিন্তু গ্রামের মানুষজনের চেঁচিয়ে কথা বলাই অভ্যাস। ততক্ষণে ওপারের উঁচুপাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা স্পষ্ট হয়েছে। তার পরনে একফালি ন্যাতা। ঝাঁকড়া চুলেও একটা ন্যাতা জড়ানো। কিন্তু সে সাঁওতাল বা মুশহর নয়, সেটা তার কথাতেই বোঝা যাচ্ছিল। খুব স্পষ্ট আর জোরালো তার উচ্চারণ। আকাশের নিচে নদীর ওপর তার কণ্ঠস্বর গমগম করছিল, যেন ধ্বনি নয়, প্রতিধ্বনি।
গাড়োয়ান আবার চিৎকার করল, তবে কিনা?
সে একটু ঘুরে হাত তুলে বলল, পাকুড়গাছের কাছে যেয়ে ডাইনের লিকে গাড়ি ঘোরাতে হবে। নৈলে–
নৈলে?
বাঁয়ের লিকে গেলে গুপিডাঙ্গার নামুতে কেঁওলির বিল। তবে কিনা যাওয়া হবে কোথা?
সেকেচ্ছা-মখদুমলগর।
সে তো বিরভুঁই জেলায়। তাই বটে।
হঠাৎ লোকটা হনহন করে চলে গেল। ঠিক অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মতো। শফির বুকের ভেতরটা ধড়াস করে উঠল। চোখ বড়ো করে উঁচুতে নীলধূসর আকাশের বিশাল পটের দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটা ভীষণ শূন্য করে দিয়েছে আকাশটাকে। কালো একটা রহস্যময় কে ও?
শফি আড়চোখে আব্বাকে দেখে নিল। মা বলেছিলেন, দুরকম জিন আছে। ভাল জিন, মন্দ জিন। ভাল জিনের গায়ের রঙ ফিট শাদা, ধপধপে কাফনের থানের মতো। কালো জিনের গায়ের রঙ মাটির হাঁড়ির তলার মতো ভূসকালো বদিউজ্জামান। তাঁর কেতাববোঝাই টাপর দেওয়া গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে তখনও তসবিহ (জপমালা) জপছেন। ন্যালা মেজভাই মনিরুজ্জামান টাপরের ভেতরে থেকে মুখ বের করে হাত চুষছে আর খ্যা খ্যা করে হাসছে। সাইদা গাড়ির আড়াল দিয়ে এইমাত্র মেজছেলের। খোঁজ নিতে এলেন। একটাই ভয় ছিল। বিছানায় পেচ্ছাপ করে দেয় আঠারো বছর বয়সের ছেলেটি। পবিত্র কেতাবগুলি যদিও চট আর কাপড়ে বাঁধা রয়েছে, কিছু বলা যায় না। সাইদা ফিসফিস করে বললেন, ইস্তেঞ্জা (মূত্রত্যাগ) করবি বেটা? কানে গেলে বদিউজ্জামান জপ থামিয়ে বললেন, খাওয়ার ইন্তেজাম করো। সাইদা, চলে গেলেন নিজের গাড়িতে। গাড়ির তলা দিয়ে তাঁর এলোমেলো পা ফেলা এবং লাল চটি দুটো দেখতে পেল শফি।
আব্বার কোনো ভাবান্তর না দেখে অবাক হয়েছিল শফি। নিশ্চয় একটা কালো জিন এসেছিল। ও কখনও মানুষ হতে পারে না।
কিছুক্ষণ পরে তুমুল চেঁচামেচি করে গাড়িগুলোকে নদীর চালু পাড় বেয়ে যখন ওপারে ওঠানো হল, আবার শফির গা শিউরে উঠল। এ কোথায় চলে এসেছে তারা? যতদূর চোখ যায়, ধূসর উলুকাশের বন। জনমানুষহীন খাঁ খাঁ নিঝুম এক দুনিয়া। এখানে এক কালো মানুষের কথা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। খুব আদিম এই ভূখণ্ডে মানুষের পায়ের ছাপ খুঁজে মিলবে না। সাতখানা গাড়ি সার বেঁধে চলেছে। সাতজোড়া চাকায় একটানা ঘস ঘস ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজ। তার সঙ্গে উলুকাশের ঘষা-খাওয়া শোঁ শোঁ শনশন অদ্ভুত ধারাবাহিক শব্দ। অবাধ এই তৃণভূমিতে এতক্ষণে সূর্যের লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। সবার আগে এবার কুলসুমকে টানতে টানতে নিয়ে চলেছে একজন প্রবীণ শিষ্য। ছানাদুটিকে অদ্ভুত দক্ষতায় বুকে চেপে রেখেছে সে। মুন্নি শেষ গাড়িটির পেছনে আগের মতোই বাঁধা। এতক্ষণে শফি গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামল। সাইদা পর্দা ফাঁক করে দেখেই প্রায় চেঁচাতে যাচ্ছিলেন। বলদের পিঠের ওপর এমনি করে ঝাঁপিয়ে পড়তে আছে? এক্ষুণি বুকের ওপর চাকা চলে গিয়ে কলজে ফেটে যেত না বাছার? গাড়োয়ান হ্যা হ্যা করে হাসতে লাগল।
শফি একা হতে চাইছিল। চ্যালেঞ্জের একা ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসেছিল। শেষ গাড়ির পেছনে চলে গিয়ে সে ঝোঁপ থেকে একটা ডাল ভেঙে নিল। ডালটা শক্ত করে ধরে সে তৃণভূমিতে চারদিকে তাকিয়ে কালো জিনটিকে খুঁজতে থাকল।