বদিউজ্জামানের সংসার সবসময় তৈরি থাকত, কখন হুকুম জারি হবে, উঠে পড়ো, গুটিয়ে নাও। কিন্তু খয়রাডাঙ্গা থেকে যেমন করে উঠে পড়তে হয়েছিল, সে যেন একটা শেকড় পড়ানোর ব্যাপার। সেই প্রথম ইটের ঘরে থাকা। প্রথম নিজস্ব একটি ইঁদারা। আর শফির বয়স তখন প্রায় সোল। পৃথিবীর কিছু কিছু কুয়াশা। তার চারপাশ থেকে অপসৃত। সেই প্রথম সে বন্ধুতার স্বাদ পেয়েছে যৌনতা বুঝেছে। তার কষ্ট হচ্ছিল খয়রাডাঙ্গা ছেড়ে চলে যেত। এখানকার মেয়েরা তার চোখে পরি হয়ে উঠেছিল।
মৃদু আপত্তি করেছিলেন সাইদা। কিন্তু বদিউজ্জামান অমনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বললেন, খামোশ বুড়বক ঔরত!
কামরুন্নিসা তখন চলচ্ছক্তিরহিত। ধরে ওঠাতে হয়। খাইয়ে দিতে হয়। অর্ধাঙ্গে পক্ষাঘাত। শুধু বললেন, কেন বেটা? বদিউজ্জামান জবাব দিলেন না। জোব্বাব। আস্তিন গুটিয়ে কেতাব গোছাতে থাকলেন। এইসব সময় তাঁবেদার জিনেরা এসে যেত মানুষের চেহারায়। সামান্য সময়ের মধ্যে লটবহর তারা ছাড়া কে গোছাতে পারবে?
অনেক পরে শফি বুঝতে পেরেছিল আব্বার খয়রাডাঙ্গা ছাড়ার কারণ কী। খোঁড়া পিরের প্রতি নবদীক্ষিত ফরাজিদের গোপন ভক্তি থেকে গিয়েছিল। তারা বাইরে। ফরাজি হলেও ভেতর-ভেতর হানাফি। তাছাড়া মাদ্রাসার আলেমরা বদিউজ্জামানের একাধিপত্য বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। তার চেয়ে বড় কথা, তাঁরা ফরাজি মত মেনে নেননি। এমন কী ‘বাহাছ’ অর্থাৎ প্রকাশ্য তর্কযুদ্ধেরও ডাক দিয়েছিলেন। জমিদারসাহেব বিব্রত বোধ করছিলেন। বদিউজ্জামানের বহু ব্যাপারে বাড়াবাড়ি দেখে। বিরক্ত হচ্ছিলেন। ভদ্রলোক ছিলেন সঙ্গীতের ভক্ত। বাংলা উপন্যাস ভালবাসতেন। বিকেলে আরামকেদারায় বসে থাকতেন এবং মাদ্রাসা থেকে পালা করে একজন পড়য়া এসে তাঁকে উপন্যাস পড়ে শোনাত। এমন কি আলবোলায় তামাক খাওয়া তাঁর আজীবন অভ্যাস, কিন্তু ফরাজি হওয়ার পর ধূমপান হারাম গণ্য। বদিউজ্জামান নাকি তাঁর কাছে গেলে তামাকের গন্ধ পেতেন এবং ধর্মগুরুসুলভ ভৎর্সনা, যাকে বলা হয় নসিহত’, করতেন। লোকের সামনে শাস্ত্রীয় এই ভৎর্সনা সহজ মনে মেনে নিতে পারছিলেন না জমিদারসাহেব।
মাসটা ছিল চৈত্র। আগের বর্ষায় ভাল বৃষ্টি হয়নি। রাস্তাঘাট শুকনো খটখটে। বারো ক্রোশ দূরে সেকেচ্ছা যেতে সিধে নাকবরাবর রাস্তাই বেছে নেওয়া হয়েছিল। শীতলগাঁয়ের কাছে মৌরালা নদী পেরুলে তিনক্রোশের একটি অনাবাদি মাঠ পড়ে। উলুশরার মাঠ। আসলে মাঠ নয়, উলুকাশের জঙ্গল। শীতের শেষে সেখানে গাড়ি চলার রাস্তা হয়ে যায়। রাস্তা বলতে শুধু কাশবন ভেঙে দুটি চাকার দীর্ঘ আঁকাবাঁকা দাগ। তারপর আবার উঁচু মাটির আবাদি মাঠ। সেখানে আবার স্থায়ী সড়ক। সেকেড্ডা পৌঁছুতে পরদিন বিকেল হয়ে যাবে।
এবার তল্পি গুটোনোর সময় সেই আনুষ্ঠানিক রীতির ব্যতিক্রম ঘটালেন হুজুর। তবু খবর পেয়ে ছোটখাট একটা ভিড় হল। গম্ভীর হুজুর দুচার কথার কৈফিয়ত দিলেন। কিন্তু অন্ধকারে কোনো ক্রন্দন শোনা গেল না। না কোনো দীর্ঘশ্বাস। সাতখানা গোরুর গাড়ি, দুখানায় টাপর চাপানো। পেছনে পাঁচখানা গাড়িতে গেরস্থালির লটবহর। শেষে গাড়ির পেছনে বাঁজা গাইগোরু মুন্নি টানটান করে বাঁধা। নিঃসন্তান প্রাণীটি ছিল ভীষণ বৈরাগিনী। দড়ি ঘেঁড়ার তাল করত। বারবার নিখোঁজ হয়ে বিস্তর ভোগাতও শফিকে।
ধাড়ি ছাগল কুলসুম সওয়ার হয়েছিল দ্বিতীয় গাড়ির টাপরের পেছনে। তার দুদিনের ছানাদুটোকে এক প্রধান শিষ্য পেছনের খোলাগাড়িতে কোলে নিয়ে বসে। ছিল। বেচারি সারারাত ঘুমোতে পারেনি। কিন্তু খয়রাডাঙ্গার শিষ্যদের মধ্যে সেই ছিল হুজুরের সবচেয়ে অনুগত মানুষ। পুণ্যের লোভ ছিল তার অসম্ভব বেশি। ভোরবেলা যখন এই অদ্ভুত কারাভা শীতলগায়ের নদীটির ধারে পৌঁছল, তখন তার মার্কিন থানের লুঙ্গি এবং ফতুয়া হলুদ হয়ে গেছে। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। প্রায় বুজে যাওয়া নদীর শুকনো বালিতে গাড়িগুলো দাঁড়ানোমাত্র সে ছানা দুটিকে নিয়ে লাফ দিল। সেখানেই তাদের ছেড়ে দিয়ে নদীর হাটুজলে উপুড় হয়ে পড়ল।
ছানাদুটি লম্ফঝম্ফ করে মাকে ডাকছিল। কুলসুমকে নামিয়ে দেওয়া হল তাদের কাছে। তখন কুলসুম ঠ্যাং ফাঁক করে দাঁড়িয়ে তাদের দুধ খেতে দিল এবং খুদে লেজ দুটোকে দুধারে মুখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে পুঁকতে থাকল।
বদিউজ্জামান ক্ষীণ নদীস্রোতের দিকে ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চটি খুলে রেখে তামচিনির বদনাটিতে জল ভরলেন। কিনারায় বসে উপাসনার প্রক্ষালন ‘ওজু’ সেরে নিলেন। সাতখানা গাড়ির সাতজন গাড়োয়ান আর তিনজন শিষ্য নদীতেই ওজু করল। তারপর হুজুরের পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। পরিস্কার বালির ওপর ফজরের নমাজ শুরু হল। সামনে হুজুরের পরিচিত ময়ূরমুখো ছড়িটি পোঁতা।
ঠিক এইসময় নদীর ওপারে পশ্চিমে ঈষৎ উঁচুপাড়ের ওপর ভোরের ধূসর আলোয় একটি ছায়ামূর্তি ফুটে উঠল।
দ্বিতীয় টাপর চাপানো গাড়ির ভেতর ছিলেন সাইদা, তাঁর রুণা শাশুড়ি আর কিশোর শফি। সাইদা গাড়ির আড়ালে বদনা নিয়ে নেমেছিলেন। প্রার্থনাকারীরা অন্যদিকে রয়েছে দেখে আশ্বস্ত হলেন। তারপর বাকি দিকগুলিকে দেখে নিলেন। সেসব দিকে কোনো বেগানা মরদলোক আছে কি না এতে নিঃসশয় হওয়ার পর পা বাড়ালেন নদীর দিকে। এসব সময় তাঁকে খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়া পাখির মতো লাগে। নড়বড় করে পা ফেলেন। দুনিয়ার প্রকাশ্য মাটিতে হাঁটতে তাঁর যেন কষ্ট হয়। বহুকাল ধরে পাতার তলায় চাপাপড়া ঘাসের মতো বিবর্ণ তাঁর গায়ের রঙ। সামান্য দূরে একটি কাশঝোঁপ তাঁর লক্ষ্য ছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন পৌঁছুতে পারছিলেন না সেখানে। সারারাত গাড়ির ঝাঁকুনিতে শরীর অবশ। গিঁটে গিঁটে ব্যথা হয়ে গেছে। আর এই নরম বালি। বিব্রত বোধ করছিলেন সাইদা। এখনই যে সুরুজ বেরিয়ে পড়বে পুবে! দাগকাটা দুধের সরের মতো সেখানে মেঘ জমে আছে আর ক্রমশ লাল আভা ফুটে উঠছে। সাইদা যেন পয়গম্বর এব্রাহিমের পরিত্যক্তা নির্বাসিতা স্ত্রী বিবি হাজেরার মতো বিশাল মরুভূমিতে জলের খোঁজে ছুটে চলেছেন।