কোথাও ঢং-ঢং শব্দে ঘণ্টা বাজল। গোনার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম ঘণ্টাধ্বনি দূরে অপস্রিয়মাণ, আর তা ক্ষীণতম হতে-হতে ভীষণ গম্ভীর অন্ধকার চারদিক থেকে ঘিরে ধরল। মাথা তুলে দেখি, কালো আকাশ জুড়ে এরাতে বডো বেশি নক্ষত্রের ঝাঁক। আর স্তব্ধতা। বড়ো বেশি সেই স্তব্ধতা, যা গাছপালা থেকে শিশিরের ফোঁটা ঝরে পড়ার টুপটাপ ধ্বনিপুঞ্জকেও করতলগত করে। আর হঠাৎ যদি দূরে হেঁকে ওঠে রোদের চৌকিদার, তারপর ভেসে আসে কোনও হকচকিয়ে ওঠা কুকুরের ডাক, তবুও এ শবকালীন মধ্যবাতেব ওই স্তব্ধতা সেগুলোকে নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বারুচাচাজি বলতেন, প্রকৃতি সর্বগ্রাসী …।
আলোর বিন্দুটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছিল। যত স্পষ্ট হচ্ছিল, তত আমার কাঁধে কারুর হাতের ছোঁয়া টের পাচ্ছিলাম। চমকে উঠে আবিস্কার করলাম নুবুভাইকে। আমি তার সঙ্গে মসজিদের দিকেই চলেছি। বারান্দার থামের ফাঁক দিয়ে সুদৃশ্য চীনা লণ্ঠনটি দেখা যাচ্ছে। চত্বরে ঢুকে নুরুভাই একটু কেশে সাড়া দিল। তারপর চত্বরকেন্দ্রের চৌবাচ্চার কাছ থেকে সাড়া এল, নুরুজ্জামান!
জি।
শফি এসেছে?
জি হাঁ।
অন্ধকার উঁচু বিরাট ছায়ামূর্তির কাছে গিয়ে পদচুম্বন করলাম। আর সেই বুঝি ছিল এক আশ্চর্য ও অবিস্মরণীয় রাত, যে-রাতে সেই প্রথম ও শেষবার আমার পিতা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।
মসজিদের বারান্দার নিচে জুতো খুলে রেখে আমরা দুভাই তাঁকে অনুসরণ করলাম। তিনি খালি পায়ে ছিলেন। ভেতরে লণ্ঠনের আলোয় একটি নকশাদার কাশ্মীরি গালিচা দেখলাম। গালিচাটির পরিপ্রেক্ষিত ছিল লাল। সেটি পুরু ও নরম। আব্বা পা-মুড়ে বসে আস্তে বললেন, বসো। একটু দূরত্ব রেখে বসতে যাচ্ছিলাম। আব্বা বললেন, এখানে বসো। আমরা দু-ভাই গালিচার ওপর বসলাম। তখন আব্বা চোখ বুজলেন। তাঁর হাতে ছিল একটি তসবিহদানা (জপমালা)। চোখ বুজে থেকে তিনি বললেন, তোমাদের দু-ভাইয়ের শাদির ইন্তেজাম করেছি।
নুরুভাই আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আস্তে বলল, জি! তার এই ‘জি’ শব্দে সম্মতি ছিল।
আব্বা আমাকে ডাকলেন, শফিউজ্জামান!
জি? আমার এই ‘জি’ শব্দে প্রশ্ন ছিল।
আব্বা চোখ না খুলেই বললেন, দেওয়ানসাহেব তোমার শাদিতে নারাজ। দরিয়াবিবির সঙ্গে তাঁর এজন্য কাজিয়া হয়েছে, শুনেছি। দেওয়ানসাহেব নাকি বলে গেছেন, শফিউজ্জামানের সঙ্গে বেটির শাদি দিনে’ উনি আর এবাড়ি কখনও আসবেন না।
নুরুভাই কিছু বলতে ঠোঁট ফাঁক করল। কিন্তু বলল না। তার মুখে বাঁকা কিছু রেখা ফুটে উঠল।
আব্বা বললেন, ইসলাম বলেছে ছেলে-মেয়ের শাদি দেওয়া বাবা-মায়ের ফরজ (অবশ্য পালনীয়)।
কথাটা বলে আব্বা চোখ খুললেন। আমার দিকে তাকালেন। নুরুভাই তাকাল আমার দিকে। লণ্ঠনের আলোয় তিনটি মুখ পরস্পরের দিকে নিবদ্ধ। বাইরে দূরে রোদের চৌকিদার ডাকল একবার। হেই-ই-ই! জা–আ-গো-ওঃ! তারপর আব্বা ডাকলেন, শফিউজ্জামান!
আমি ফের বললাম, জি! এই শব্দটি এবার ছিল নিরর্থক একটি শব্দমাত্র। যেমন শিশির-পড়ার কিংবা যে-কোনো প্রাকৃতিক ধ্বনির মতোই, যার এমন কঠিন নিজস্বতা আছে যে মানুষ তাকে উপমায় বা প্রতাঁকে বা কোনোভাবেই চৈতন্যসংক্রান্ত ব্যাখ্যায় পরিণত করতে পারে না। সেটি একটি জড় ধ্বনিমাত্র। জলে ঢিল ছুড়লে যে শব্দ ওঠে, তাকে তুমি –হে লম্বানেকো শান্ত্রী, জলের আর্তনাদ বলে একটি ব্যাখ্যা দিতে পারো। কিন্তু আমার ওই জি-শব্দটির তেমন কোনো আরোপিত ব্যাখ্যাও চলে না।
অথচ মানুষের মূঢ়তা এমনই অবিমৃষ্যকারী, এমনই অসহায়তা তার অস্তিত্বের এক মৌল উপাদান– যা সে মাতৃগর্ভ থেকে সঙ্গে নিয়ে জন্মায় যে, সবকিছুকেই চৈতন্যময় ভাবে। আজ আমি অনিবার্য মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি বলেই নয়, এ তো একটা নিজস্ব-সাধিত পরিণতি আমারই অস্তিত্বের, ক্রমশ জেনেছিলাম এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে জড়প্রক্রিয়ারই এক হঠকারী পরিণাম জীবন নামক একটা ঘটনা– নিছক ঘটনামাত্র!
এই দেখো, আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। চল্লিশ বছর আগের এক শরৎকালীন মধ্যরাতে মৌলাহাট গ্রামের উত্তরপ্রান্তে অবস্থিত একটি প্রকাণ্ড প্রাচীন মসজিদের ভেতর লণ্ঠনের আলোয় কাশ্মীরি গালিচায বসে, পরবর্তীকালে বদুপির নামে যিনি প্রখ্যাত হন এবং যার মাজার শরিফ পর্যন্ত গড়ে ওঠে, অথচ যিনি একদা ছিলেন। পিরতন্ত্র বিরোধী কট্টর ফরাজি মৌলানা, তাঁর ‘শফিউজ্জামান’ সম্ভাষণে প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন ছিল শাদিতে আমার সম্মতি আছে কি না! ভাবা যায় না হে লম্বানেকো শাস্ত্রীভাই, তা তোমার কাঁধে বন্দুকই থাক কিংবা কোমরে ঝুলুক খাপেঢ়াকা বেয়নেট!
কিন্তু আমার ‘জি’ শব্দটিকে তিনি, তাঁর মতো বিচক্ষণ জ্ঞানী পুরুষ, একই সাধারণ মূঢ়তায় সম্মতি বলে ধরে নিলেন, যদিও আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলতে চাইনি। কারণ তখন আমার দুপাশে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন। বারুচচাজি এবং রুকু। আমি ভাবছিলাম কার দিকে যাব– কে আমার প্রিয়?….
.
খুব সকালে আমার ঘুম ভাঙাল আয়মনি। তার চেহারার ঝলমলানি দেখে তো আমি অবাক! সে গাভরা রুপোর গয়না পরেছে। রঙিন ডুরে শাড়ি, এমন কী কুর্তাও পরেছে –যত বেঢপ দেখাক আর তার কপালে কাঁচাপোকার টিপ। তার সারা দেহ ঝিকমিক করছিল হাসিতে। শফি এসেছ? মানিকসোনা এসেছ? বলতে বলতে সে আমার হাত ধরে টেনে ওঠাল বিছানা থেকে। সে আমার শাদিতে কত খুশি বোঝনোর জন্য চাপা গলায় একরাশ কথা বলতে থাকল। আমি চুপ করে থাকলাম। অথচ আমার জানতে ইচ্ছে করছিল রুকুর কথা। মুখ ফুটে জিগ্যেস করতে পারছিলাম না।