মা অনর্গল এসব কথা বলছিলেন। কিন্তু আমি শুনতে চাইলাম রুকুর কথা। রুকু কী বলছে? রুকু কি আগের মতো আসছে আমাদের বাড়িতে? রুকু কি খুশি হয়েছে?
মা ওসব কথা কিছুই বললেন না। আঁচল দিয়ে আমার পা, হাত, মুখ মুছিয়ে কাঁধ ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন। তারপর বাইরে কেউ গম্ভীর গলায় বলে উঠল, আম্মাজি! স্বরটা চেনা মনে হল। কিন্তু আব্বার চেয়ে গম্ভীর আর প্রতিধ্বনিময় সেই কণ্ঠস্বর। আবার সে বলল, শফি এসেছে শুনলাম। কই সে? তারপর দরজায় একজনকে দেখতে পেলাম। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।
ঝকমকে উজ্জ্বল গৌরবর্ণ মুখে কালো দাড়ি। মাথায় ফেজ টুপি। পরনে ঘিয়ে রঙের আচকান। পায়ে নাগরা জুতো। এই কি আমার বড়োভাই নুরুজ্জামান? মা আমাকে ঠেলে দিয়ে বললেন, বড়োভাইয়ের সঙ্গে আদব-লেহাজ করতে হয় জানো না? ছিঃ!
আমি ওঠার আগেই নুরুভাই এসে আমাকে আলিঙ্গন করল। বলল, তু কিতনা বাঢ় গিয়া, শফি? তুমকো হাম পছনতাভি নেহি!
মা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ওই জবানে বাতচিত আর করিস না বাবা! ওই খোট্টামি শুনলে আমার গা জ্বলে যায়।
নুরুভাই হাসতে-হাসতে বলল, মুসলমানের জবান, আম্মাজান! তারপর আমার পাশে বসে বলল, তুই নাকি ইংরেজি ইস্কুলে পড়ছিস? আব্বাজানকে বললাম, ইয়ে ক্যা কিয়া আপনে? আব্বাজানের বাত সমঝ করা গেল না। কে এক নবাববাহাদুরের দেওয়ানসাব নাকি তেনাকে কীসব সমঝেছেন, আব্বাজান তাঁর ফাঁদে পড়ে –তো শফি, তোর চেহারায় হিউঁর ছাপ পড়েছে। তুই কি ইস্কুলে থোতি উতি পিঁধিস, নাকি পায়জামা-কুর্তা পিঁধিস?
আস্তে বললাম, হাফপ্যান্ট হাফশার্ট পরে স্কুলে যেতে হয়।
নাউজুবিল্লাহ! নরুভাই বলল। অবশ্য সে হাসছিল। তোকে আব্বাজান–
না। বারিচাচাজি কিনে দিয়েছেন।
উও কৌন? কে সে?
মা বললেন, সেই তো দেওয়ানসাহেল। দরিয়া-আপা –মানে তোদের হবু শাশুড়ির দেওর হন তিনি। হাতিতে চেপে মহালে-মহালে ঘোরেন। ওনাকে তুই চিনিস নে, নুরু! উনি ইংরেজিপাস পণ্ডিত। হিন্দুরাও ওনার কত কদর করে জানিস?
নুরুভাই একটু গম্ভীর হয়ে বলল তো ঠিক হ্যায়। নসিব আপনা-আপনা। আম্মাজান, ভুখ লেগেছে। জলদি খানা নিকালেন। অনেকবছর পরে দুভাই পাশাপাশি বসে খাই। দেওবন্দের মেহমানখানায় (অতিথিশালা) খেয়ে মু খারাব হয়ে গিয়েছে। শফি, তুই নাকি কার বাড়ি ‘জায়গির’ আছিস?
মা বলে গেলেন, খোনকারসাহেবের বাড়ি। খবর নিয়েছি, ওনারা শরিফ ঘর।
নুরুভাই ঘোষণা করল, আল্লার দুনিয়ায় শরিফ-নিচ, আশরাফ-আজলাফ কিছু নাই। সবাই আল্লাহতায়লার বান্দা । দুনিয়ায় কোথাও ইসলামে এ জিনিস নাই। খালি হিন্দুস্তানের মুসলমান হিন্দুদের দেখে জাত-বেত শিখেছে। মুসলমান ‘কুফরি কালাম’ (নাস্তিক্যমূলক বিদ্যা) পেয়েছে হিন্দুস্তানে এসে। সব মানুষ সমান। আমরা সবাই বনি-আদম (আদমবংশধর)।
নুরুভাইয়ের এই কথাটাই এতক্ষণে ভালো লাগল।…
বারুচাচাজি বলতেন, ‘ইসলাম ইজ দ্য ড্রাসটিক ফরম অব ক্রিসটিয়ানিটি’ বলে একটা কথা চালু আছে, জানিস শফি? তো তোর বড়োভাই মৌলানা নুরুজ্জামান। ইজ দা ড্রাসটিক ফরম অব ইওর ফাদার মৌলানা বদিউজ্জামান! পিতৃনিন্দা শুনে রাগ করলি না তো? নিন্দাছলে স্তৃতি। অলঙ্কারশাস্ত্রে একে বলে ব্যাজ্যুতি। তোর পড়ার বইতে নেই ভরতচন্দ্রের সেই কবিতাটা– শিবের ব্যাজ্যুতি?
হরিণমারা স্কুলে গিয়ে একটা বিপত্তি ঘটেছিল। ঘটিয়েছিলেন বারুচাচাজিই। আব্বাকে জানতে দেননি, আরবি-ফারসির বদলে সংস্কৃত নিয়েছিলাম আমি। তাঁরই কথায়। তাঁর কথায় সায় দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না আমার। আমাকে তিনি বশ করে ফেলেছিলেন। তবে খোনকারসাহেবের ছেলে রবিকেও সংস্কৃত নিতে হয়েছিল। কাবণ প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলে গোড়ার দিকে আরবি-ফারসি শিক্ষক নেওয়ার প্রশ্ন ওঠেনি। মুসলিম ছাত্রসংখ্যা ছিল খুবই কম। আমার ভর্তি হওয়ার বছর। নবাববাহাদুরেব অর্থসাহায্যে সক্রেটাবি হিন্দু জমিদার রায়সাহেব প্রথম মৌলবি শিক্ষক রাখেন। তাঁর নাম ছিল জসিমুদ্দিন। তাঁকে ছাত্ররা বলত, যশু মৌলবি। কেপ্পনের যাশু এই মৌলবি সম্পর্কে নানান গুজব ছড়াত ছাত্ররা। আমাকে আর রবিকে দুচোখে দেখতে পারতেন না তিনি। তবে পোদোকে বড্ড ভয় করতেন। তারই ভয়েই হয়তো আব্বার কানে আমার সংস্কৃত পড়ার কথাটা তুলতে যাননি।…
লম্বানেকো শাস্ত্রটি গরাদের ভেতর দিয়ে কুতকুতে চোখে ডাকল, সাব!
মুহূর্তে দেখলাম আমার চারদিকে কালো দেয়াল এগিয়ে এসে ঘিরল। মুখ তুলে দেখলাম, উঁচুতে একটা ছাদ। কোনায় মিটমিটে বিজলিবাতি জ্বলছে।
কুছ তকলিফ হ্যায়, সাব?
না তো ভাই!
সে সরে গেল। তার বুটের শব্দ থামলে আমি আবার সামনে দেয়ালের দিকে তাকালাম। দেয়াল ফুঁড়ে বেরিয়ে এল সাতমার কান্নু পাঠান। তার গলার কাছে টাটকা ক্ষত! গলগল করে রক্ত পড়ছে। বুক ভেসে যাচ্ছে। কাটা শ্বাসনালী দিয়ে লাল বুজকুড়ি ফুটে উঠছে। সে বলল, শফিসাব! আর বুজকুড়িগুলো ফাটতে থাকল। ঘড়ঘড় শব্দ।
বলো কাল্লু!
সিতারা –সিতারা আমাকে বলল কী—
কাল্লু পাঠানের বুকে দুমদাম ঘুসি মারতে থাকলাম। আমার হাতে রক্ত লাগল।
লম্বানেকো শাস্ত্রীটি ব্যস্তভাবে ডাকছে শুনতে পেলাম, সাব! সাব!
ঘুরে দেখে স্থির দাঁড়িয়ে গেলাম। আস্তে বললাম, ও কিছু না!…