এসব কথা শুনতেও পেতেন বদিউজ্জামান। কিন্তু এড়িয়ে থাকতেন। তিনি ফরাজি ধর্মগুরু। পূর্ববাংলার প্রখ্যাত ফরাজি আন্দোলনের প্রবক্তা হাজি শরিয়তুল্লার মুরিদ–শিষ্য। প্রচণ্ড পিউরিটান। হাত দুটো নাভির ওপরে রেখে নমাজ পড়েন। সুরা ফাতেহা আবৃত্তির পর উচ্চকণ্ঠে ‘আমিন’ বলেন। প্রার্থনারীতি ও ধর্মীয় আচরণে অসংখ্য এমন পার্থক্য মেনে চলেন অন্য তিনটি মজহাব বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তবে জিনে তাঁর আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ পবিত্র কোরানে স্বয়ং আল্লাহ বলেছেন, আমি জিন ও ইনসান (মানুষ) সৃষ্টি করেছি। জিন বানানো হয়েছে আগুন থেকে, মানুষকে মাটি থেকে। জিনরা অগ্নিজাতক। তারা আলোর মানুষ। বাস করে সপ্তস্তবক আসমানের কোনও একটি স্তবকে। (আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাষায় অন্য একটি গ্যালাক্সিতে) কাজেই জিন আছে। জিন থাকলে দুনিয়ায় তাদের আনাগোনা ঠেকাবে কে?
নিসিং পণ্ডিতের পাঠশালা ছেড়ে বরং খুশিই হয়েছিল শফি। কথায়-কথায় বেত মারতেন পণ্ডিত। শফি ভীষণ অবাক হয়ে যেত। তাকে পাড়ার দাড়িচুল-পাকা বুড়োরাও আপনি বলে। এমন কি শফি বিশ্বাস করত, তাদের বাড়ির লোকেরা মরবে না। কুতুবপুরে থাকার সময় তার আর একটি ভাই হয়েছিল। একবছর পরে একদিন সে পাঠশালা থেকে ফেরার সময় তার মরে যাওয়া শুনে প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিল। এ তো অসম্ভব ব্যাপার। বাড়ি ফিরে কান্নাকাটি শুনে সে থ। তারপর প্রায়ই কবরখানায় গিয়ে ছোট্ট কাঁচা কবরটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করত সামনের শ্যাওড়াগাছটার দিকে। শেষে রাগেদুঃখে ভ্যা করে কেঁদে ফেলত।
পন্ডিতের বেতের কথা শফি বাড়িতে চেপে যেত। ভাগ্যিস মুসলমানপাড়ার কোনও ছেলে পাঠশালায় পড়তে যেত না। কিন্তু মুসলমানদের ধর্মশিক্ষা আবশ্যিক। তাই ছোটরা মসজিদে একজন ওস্তাদজির কাছে আরবি পড়তে যেত! ওস্তাদদজিকে নিযুক্ত করা হয়েছিল হুজুরের সুপারিশে। তিনি একদা তাঁর তল্পিবাহক ‘তালেবুল আলিম’ ছিলেন। এদিকে মেয়েরা পড়তে আসত সাইদার কাছে। উঠোনে সারবেঁধে বসে দুলে দুলে তারা পড়ত; আলেফ জবর আ। বে জবর বা। তে জবর তা।
কুতুবপুর থেকে চলে যাওয়ার কথা শুনে শিষ্যদের সে কী হাউহাউ করে কান্না!
এসব সময় বদিউজ্জামানের চিরাচরিত একটি আনুষ্ঠানিক রীতি ছিল। একেবারে শেষ সময়ে মসজিদে নমাজের পর ভাষণ শুরু করতেন; বেরোদানে ইসলাম– ইসলামের ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহ পাক আমাকে জিন্দেগি-ভর রাহি মুসাফির করেছেন। যদি বলেন, আপনার দেশ কোথায়? আমার কোনো দেশ নেই ভাইসকল! আমার দেশ সারা দুনিয়া।
এরপর হুজুর গ্রামবাসী মোমিনবৃন্দের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেন আবেগ মাখা কণ্ঠস্বরে। প্রতিটি ছোটবড় ঘটনা উল্লেখ করে বুকে হাত রেখে বলতেন, সব আমার দেলে গাঁথা রইল। ভুলি নাই। ভুলব না। তবে আমার আবার সময় হয়েছে, ‘উঠো মুসাফির, কদম বাঢ়াও, আগেসে এক মঞ্জিল হ্যায়।
শিষ্যবৃন্দ (সমস্বরে) । হুজুর! হজুর! এ কী বলছেন! এ যে আসমান থেকে বাজ এসে পড়ল মাথায়।
(প্রবল কান্নার ধ্বনি)
হুজুর ॥ ভ্রাতৃবৃন্দ! আল্লাহ বলেছেন, কিছু চিরস্থায়ী নয়। কেউ কাউকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই আল্লাহ বলেছেন, কোনোকিছুর জন্য শোক হারাম। মৃতের জন্য শোক হারাম। নষ্ট হওয়ার জন্য শোক হারাম। কিছু হারানোর জন্য শোক হারাম। যে তোমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে, তার জন্য শোক হারাম।
(কান্নার ধ্বনির শ্বাসপ্রশ্বাসে রূপান্তব। চতুর্দিকে ফোঁসফোঁস নাক ঝাড়ার আওয়াজ ।)
সর্দারশিষ্য (কাঁধের ডোরাকাটা রুমালে চোখ মুছে) ॥ হুজুর, এদফা আপনার মঞ্জিল কোথায়?
হুজুর (বিষণ্ণ হেসে)।। খয়রাডাঙ্গা।
সর্দারশিষ্য (নাক মুছে) ॥ জায়গা ভালো। জমিদার মোছলমান। কিন্তু আমরা যে এতিম হয়ে গেলাম হজুর!
হজুর (চোখ মুছে) ।। আল্লার হাতে আপনাদের রেখে যাচ্ছি। নজর রাখবেন, যেন আউরত লোকেরা বেপর্দা না হন। গানবাজনা যেন না শোনা যায়। মোহররমে আর যেন তাজিয়া জুলুস গ্রামে না ঢোকে। কেউ যেন পিরের থানে মানত দিতে না যায়। কেউ নমাজ কামাই করলে জরিমানা করবেন। দোসরা বার করলে সাত হাত নাক খবদা সাজা দেবেন। তেসরা বার করলে পঁচিশ কোড়া মারবেন। আর তারপর করলে গ্রাম থেকে নিকালে দেবেন শয়তানকে।…
হজুর চলে গেলে সেসব অবশ্য কিছুই করা হত না। কারণ তাতে দলাদলি ও হাঙ্গামার আশঙ্কা ছিল। মেয়েরা আবার বেপরদা হয়ে মাঠে মরদ-ব্যাটাদের নাশতা। দিয়ে আসত। শাদি লাগলে ঢোল বাজিয়ে গীত গাইত আগের মতোই। নাচত এবং সঙ দিত। পাশের গায়ের হানাফি মজহাবের জোয়ানরা মোহররমের মিছিল এনে। খবর পাঠাত ঢুকবে নাকি এবং অনুমতিও পেত। তবে প্রধান ফরাজিরা দেখে না দেখা বা শুনেও না-শোনার ভান করে আড়ালে গিয়ে বসত। বাংলা পুঁথিগুলো বানান করে-করে সুর ধরে পড়তঃ ‘লাখে লাখে মরে লোক কাতারে কাতার/শুমার করিয়া দেখি পঞ্চাশ হাজার।….’ সেই কবে এসে ইরফান মৌলবি বাংলা মক্তব খুলেছিলেন। তখনই কিছু লোকের যা বাংলা হরফ শেখা, শ্লেটে দাগড়া দাগড়া ‘স্বরে অ, স্বরে আ।’ পাঁচন আর লাঙ্গলের মুঠিধরা হাতে দড়কচা পড়ে গেছে। ধান পুঁতে হাতে পায়ে হাজা।
খয়রাডাঙ্গায় গিয়ে একটা বছর না কাটতেই আবার তল্পি গুটোলেন বদিউজ্জামান। জমিদার সাহেব হুজুরকে দেখে আসন ছেড়ে সালামের জবাব দেননি। সেদিনই সন্ধ্যায় কজন অনুগত শিষ্যকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, এশার নমাজের পর রওনা হবেন সেকেচ্ছা। খানকতক গাড়ি এখনই দরকার।