.
মৌলাহাটে পৌঁছেই দুখু আমাকে প্রথমে মসজিদে আব্বার কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু তখন এশার নমাজ চলেছে । নমাজের প্রতি ততদিনে আমার গরজ কমে গেছে। দুখু মসজিদে ঢুকে চত্বরের চৌবাচ্চায় অজু করতে ব্যস্ত হলে আমি সেই সুযোগে কেটে পড়লাম। সোজা বাড়ি গিয়ে ঢুকলাম। ডাকলাম, মা! তারপরই শুধরে নিয়ে ডাকলাম, আম্মা!
দেখলাম, মা বারান্দায় সবে নমাজ শেষ করে ‘মোনাজাত’ –করজোড়ে প্রার্থনা করছেন। একটু তফাতে একটা লম্ফ জ্বলছে! রান্নাঘরের বারান্দাতেও একটি লক্ষের সামনে বসে মেজোভাই মনি দুলছে আর আঙুল চুষছে। তার মুখের দুপাশ লালায় ভেসে যাচ্ছে। তার গালে দাড়ি গজিয়ে গেছে। সে আমাকে দেখে অদ্ভুত গোঙানো। গলায় যখন বলে উঠল, ছফি! তখনই আমার চমক লাগল। আব্বার অনুরক্ত জিনেরা কি তাহলে একদিন মনিভাইয়ের ভেতরকার কালো জিনটিকে তাড়াতে পেরেছে?
ঘরের ভেতর থেকে দাদি-আম্মার সাড়া পেলাম, কে রে? নুরু?
না দাদি-আম্মা! আমি।
শফি! পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা বৃদ্ধা প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন। খুশি ফেটে পড়ছিল তাঁর কণ্ঠস্বরে। ঘরে ঢুকে তাঁর কদমবুসি –পদচুম্বন করামাত্র তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলেন। হেসে-কেঁদে বৃদ্ধা অস্থির। তারপরই দেখতে পেলাম দরজার সামনে দাঁড়ানো এক ছায়ামূর্তি।
ছায়ামূর্তিই। মাকে চিনতে পারছিলাম না। সে যেন মায়েরই বিকৃত এক প্রতিরূপ। কোটরগত চোখ, কণ্ঠার হাড় ঠেলে বেরিয়েছে, বসা গলা, সরু নাকটিও নেতিয়ে গেছে। পরনে যেমন-তেমন একটা শাড়ি। উঠে এসে কদমবুসি করলে বুকে চেপে ধরলেন। বুকের স্পন্দন অনুভব করলাম। সেই মুহূর্তে দাদি-আম্মা সহাস্যে বলে উঠলেন, তোমার ব্যাটার মুখে বস্তু (দুর্গন্ধ) নিকলাচ্ছে, বউবিবি! ওকে পুছ করে দ্যাখো, বিড়ি-তামুক খেতে শিখেছে ইস্কুলে!
দাদি-আম্মা খুব হাসতে থাকলেন। মা কোনো কথা না বলে আমাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। দেখলাম, ঘরখানিতে অনেক বদল ঘটেছে। তত্তায় রাখা আব্বার আরবি-ফারসি কেতাবের স্তূপটি নেই। সেখানে নতুন কিছু তোরঙ্গ আর বেতের পেটরা রয়েছে। তত্তাপেশের বিছানাটি নতুন বলে মনে হল। আলনায় কিছু নতুন শাড়ি ঝুলছে। মা আমাকে নিয়ে বিছানা বসলেন। তাঁর চোখে জল ছিল। মুছে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, তুই-ও আমাকে ভুলে গেলি, বাছা?
মনে-মনে বললাম, ভুলিনি আম্মা! মুখে বললাম, স্কুলে খুব পড়ার চাপ।
মা একটু চুপ করে থেকে বললেন, নুরু এসেছে খবর পেয়েছিস?
হুঁ। বারি-চাচাজি বলছিলেন।
নুরু ‘ফাজিল’ হয়েছে। মায়ের মুখে ঈষৎ গর্বের রেখা ফুটে উঠল কথাটা বলতে।
‘ফাজিল’ ইসলামি শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি। কিন্তু আমি তাচ্ছিল্য করে বললাম, বড়োভাই এবার খুব ফাজলেমি করে বেড়াবে দেখবেন!
মা ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ছিঃ! বড়োভাই সম্পর্কে আদব-লেহাজ করে কথা বলতে হয়।
বড়োভাই বুঝি মসজিদে?
মা মাথা নাড়লেন। তারপর একটু হেসে বললেন, তোদের দু-ভাইয়ের শাদির ইন্তেজাম হয়েছে। দরিয়াবানুরই জেদ। তোর আব্বাসাহেবও মত দিয়েছেন।
মায়ের একটা চোখ ছিল রান্নাঘরের বারান্দার দিকে। হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠে গেলেন। দেখলাম, মনিভাই লম্পটার দিকে ঝুঁকে দিচ্ছে। মা ‘অই! অই! বলে তার হাত থেকে লম্প কেড়ে নিলেন। তারপর ভীষণ অবাক হয়ে দেখলাম মনিভাইয়ের কাঁধ ধরে টানতে-টানতে নিয়ে আসছেন। মনিভাই টলোমলো পা ফেটে হেঁটে আসছে। এঘরে ঢুকেই সে মেঝেয় বসে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে ফ্যা ফ্যা করে হাসতে লাগল। মা আমার পাশে বসে একটু হেসে বললেন, মনির আমার খানিক-খানিক হুঁশবুদ্ধি ফিরেছে।
গোপন কথা বলার ভঙ্গিতে ফিসফিসিয়ে বললেন, ফের, খবরদার বাবা, তোর আব্বা যেন জানতে না পারেন। দরিয়া-আপার কথায় খোঁড়াপিরের মাজারে গিয়ে সিন্নি চড়িয়েছিলাম। অমনি মনি আমার
মা! আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম।
মা বললেন, চুপ। চুপ। দেওয়ালের কান আছে।
আমরা ফরাজি না?
মায়ের মুখে একটা কালো ছাপ পড়ল। ঠোঁট বেঁকে গেল। হিশ-হিশ করে বললেন, এতকাল দুনিয়া জুড়ে পিরদের সঙ্গে জেহাদ করে এবার নিজেই পির সেজে বসেছেন! মসজিদে রাতের বেলা জিনপরি এসে খিদমত (সেবা) করছে। তাই হুজুরের আর বাড়ি আসা হয় না। ফরাজি! আহলে হাদিস! লা-মজহারি! মোহাম্মদি! তারপর কি না ওহাবি। মুখে কতরকম বুলি! এদিকে–
হঠাৎ মা আমাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না। একটু পরে বললাম, আপনি কাঁদছেন কেন আম্মা?
মা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আয়। ইঁদারার পানি তুলে দিই। হাত পা ধো!
মা বেরিয়ে গেলেন, তখনও আমি বসে আছি। কিছু বুঝতে পারছি না। তারপর মনিভাইয়ের দিকে চোখ পড়ল। সে আমার দিকে তাকিয়েছিল। মুখে কেমন একটা হাসি। তারপর সে দুইহাতের আঙুল দিয়ে মিথুন-সংকেত দেখাতে লাগল। এই সংকেতটি খয়রাডাঙার স্কুলে পড়ার সময় আবু নামে এক সহপাঠীর কাছে প্রথম দেখি। মনিভাইয়ের এমন কাণ্ড দেখে লজ্জায়-রাগে-ঘেন্নায় দ্রুত বেরিয়ে গেলাম।
উঠোনের জীর্ণ ইঁদারাটি মেরামত হয়েছে। লম্পের সামান্য আলোয় বাড়িটা নতুন দেখাচ্ছিল। মা নিজেই আমার হাত-পা ধুয়ে দিলেন। দিতে-দিতে বললেন, দেখছিস কত গাঁদাফুলের ঝাড় হয়েছে। সব আয়মনির কাণ্ড। একটু আগে খবর: নিতে এসেছিল শফি এল নাকি। সবচেয়ে ওর খুশিটাই বেশি, জানিস? বলে কী, পিরসাহেব তো মসজিদে। আমরা ঢোলক বাজাব, শাদিতে নাচব। গীত গাইব। সং দেব। পিরসাহেব শোনে তো শুনুক। ফরাজি হয়েছি তো কী হয়েছে? ‘পুরুষান’ (পুরুষানুক্রমে) যা হয়ে এসেছে মৌলাহাটে, তা না হলে চলে?