হরিণমারার মুসলিমরা ছিল হানাফি সম্প্রদায়। তারা কেউ কেউ আব্বাকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত। রবিও করত। কিন্তু তার বাবা খোন্দকার হাসমত আলি ছিলেন আব্বার অনুরাগী মানুষ। লম্বাটে চেহারার এই মানুষটির চিবুকে ছিল ছাগলদাড়ি। মাথায় সব সময় তুর্কি ফেজটুপি পরে থাকতেন। লাল কৌটো-গড়নের টুপিটার শীর্ষে ছিল কালো মাদুলির মতো দেখতে একটুকরো গালা আর তা থেকে ঝুলত রেশমি কালো একগুচ্ছ সুতোর ঝালর। বিনীত, মৃদুভাষী এই লোকটি প্রথম দিন থেকেই আমার প্রতি স্নেহপ্রবণ ছিলেন। তার বংশ-পদবি ছিল খোলকার। তিনি ছিলেন উচ্চবণীয় আশরাফ, যাঁদের মিয়াঁ বলাই মুসলিমদের মধ্যে রেওয়াজ। হিন্দুরা অজ্ঞতাবশে মুসলিমমাত্রেই মিয়াঁ বলেন দেখেছি। বারুচাচাজি বলতেন, মিয়াঁ বা মিঞা কথাটা ফারসি। এর মানে হল মধ্য। সমাজের মাঝখানে যারা আছে। কিন্তু জেনো শফি, এই মাঝখানে-থাকা লোকগুলোর মতো বদমাইশ দুনিয়ায় আর থাকতে নেই। এরা গাছেরও খায়, তলারও কুড়োয়। এই যে ‘খোন্দকার’-সায়েবকে দেখছ, আমার কথা মানেন-গোনেন, ভয়-ভক্তি করে চলেন, তার কারণ কী জানো? উলুশরার নাবাল মাঠে নবাববাহাদুর যে ঘের (বাঁধ) তৈরির আরজি মনজুর করেছেন, তার মূলে আমি। আর খোকার আছেন তদ্বিরে, চাষাভুষো গরিব-গুরবোর ইস্তফা দেওয়া ভুইখেত সামান্য সেলামিতে যাতে পেয়ে যান। ঘের হলে উলুশরার মাঠে ফসল ফলবে। নবাবের খাজাঞ্চিখানা উঠবে ভরে।
জমিজমা ভুঁই-খেত এসব আমি তখনও বুঝতাম না। আব্বা গর্ব করে বলতেন, মাটি নিয়ে দুনিয়াদারি আমাদের নয়। খোদাতা’র দুনিয়ায় সব ছেড়ে শুধু মাটি মেপে বেড়ায় যারা, তারা গোনাহগার পাপী। সেই পাপেই মুসলমানের বাদশাহি বরবাদ হয়েছে। খোনকারসায়েব তাঁর ছাগলদাড়ি মুঠোয় চেপে যখন ছড়ি-হাতে মাঠের জমির আলে দাঁড়িয়ে থাকতেন, আমার মনে হত, আব্বা যদি এখন ওঁকে দেখতেন, কথাটা স্মরণ করিয়ে দিতেন।….
বারুচাচাজি আমার কানে ফুসমন্তর দিয়ে চলে যাওয়ার কদিন পরেই দুখু নামে একটি লোক এল মৌলাহাট থেকে। শীর্ণকায় এই খেতমজুরটি ছিল ভারি আমুদে। সে মুচকি হেসে যখন বলল, হুজুর তলব দিয়েছেন, তখনই আমি সতর্ক হলাম। আমার চোয়াল আঁটো হয়ে গেল। আস্তে বললাম, কদিন পরেই স্কুলে পুজোর ছুটি পড়বে। তখন যাব।
দুখু চোখ নাচিয়ে বলল, সে যখন যাবেন, তখন যাবেন। হুজুর বলেছেন, আপনার আম্মাজানও বলেছেন– পইপই করে বলেছেন, একবেলার জন্য যেতেই হবে। আমাকে ধরে আনতে হুকুম জারি হয়েছে, বাপজি!
শরৎকালের বিকেলে বাদশাহি সড়কের ধারে ক্লাস সিক্সের কজন বন্ধু মিলে আমরা রোজ গিয়ে বসে থাকতাম। রবি, কালীচরণ, বিনোদ আর পোদো। পেপাদোর আসল নাম ছিল হরেন। কালোরঙের মারকুটে চেহারার পোদো দুখুকে চোখ পাকিয়ে বলল, শফির বাবাকে গিয়ে বললো, শফি বিয়ে করবে না। শালা! গুয়োর ডিম ভাঙেনি, এখনই মেয়েমানুষের পাশে শোবে!
শোনামাত্র আমি চমকে উঠলাম। রবি তাহলে কথাটা রটিয়ে দিয়েছে। তখন স্কুলেপড়া ছাত্রদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে। এমন কী, বিনোদেরও বিয়ে হয়েছে। সে ময়রাবাড়ির ছেলে। বয়সে সবার বড়ো। সে ফিকফিক করে হাসতে লাগল। দুখুও খিকখিক করে বেজায় হাসল। বলল, বাবুমশাই, তা বললে কি চলে? গাঁ জুড়ে রোয়াব উঠেছে, পিরসাহেবের ছেলেদের বিহা।
পোদো আমার গোপন অঙ্গে খামচে ধরে বলল, কী রে? বিয়ে করবি? ছিঁড়ে ফেলব– বল, করবি?
আমি জোরে মাথা নেড়ে, কিন্তু মুখ নামিয়ে বললাম, না।
দুখু বেগতিক দেখে গোমড়ামুখে বলল, সেটা পরের কথা! হুজুর যখন ডেকেছেন, তখন একবার চলুন। মাজান বড়ো কাঁদেন আপনার জন্য। আর আয়মনি– আয়মনিও কেঁদে ‘বিয়াকুল’। বলে আহা, চোখের ছামু থেকে ছেলেটা দূর হয়ে গেল গো!
হঠাৎ আমার মনে হল, রুকু কি কিছু বলে না? কোনো কথা বলে না কারুর কাছে? সড়কের দুধারে অপার সবুজ ধানখেত। সাঁকোর ধারে আমরা বসেছিলাম। নিচে স্বচ্ছ জলেভরা কাঁদর। দিনের শেষ আলোয় সবকিছুর ভেতর রুকুকে প্রতিষ্ঠিত দেখলাম। উত্তরদেশের গাড়োয়ানদের যে দলটি সার বেঁধে গোরুর গাড়ি নিয়ে একটু আগে সাঁকো পেরিয়ে গেছে, তাদের একজনের গান তখনও ভেসে আসছিল দূর। থেকে। হরিণমারার জমিদারবাড়ির সিংহবাহিনীর মন্দিরে কাসরঘণ্টা বাজতে থাকল। মুসলিমপাড়ার প্রাচীন নবারি মসজিদের শীর্ষ থেকে মোয়াজ্জিনের আজানধ্বনি ভেসে এল। আর দুখু শেখ ব্যস্ত হয়ে কাঁদরের জলে অজু করে নমাজে দাঁড়াল। তার বিস্মিত আর বিচলিত চাউনি দেখে বুঝতে পারছিলাম, পিরসাহবের ছেলেকে তার পাশে নমাজে আশা করেছিল। কিন্তু শেষে হতাশ হয়ে নমাজ পড়তে থাকল। রবি চাপা গলায় রুকু আর আমার সম্পর্কে অশালীন কথা বলতে থাকল বন্ধুদের সঙ্গে। সে কি নিছক কাম? সে কি প্রেম? আমার চারপাশ থেকে প্রতিবিম্বিত রুকু হাতছানি। দিল। তার মেয়েলি চুলের গন্ধ আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার, যে গন্ধ সে কাছে এসে দাঁড়ালেই ঝাঁঝাল হয়ে নাকে ঢুকেছে এবং কী এক প্রক্ষোভে জর্জরিত হয়েছে আমার আমূল অস্তিত্ব। দুখু নমাজ শেষ করে টুপিটি ভাঁজ করে ফতুয়ার পকেটে খুঁজে আমার কাছে এল। আর সঙ্গে-সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম। রবি বলল, রাত্তিরটা থাকিস। কালীচরণ আর বিনোদ খ্যাখ্যা করে হাসতে থাকল। শুধু পোদো বলল, মরবি শফি, মারা পড়বি।….