কাশবনের ভেতর থেকে দুটো শামুকখোল উড়ে গিয়ে একলা-দাঁড়ানো একটা নিষ্পত্ৰ গাছের ডালে বসলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, চাচাজি! শামুকখোল মারবেন না বন্দুকে?….
পরে বুঝতে পেরেছিলাম, দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি কেন সেদিন আমাকে হাতির পিঠে চাপিয়ে উলুশরার জঙ্গলে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রকৃতি বিলাসী মানুষটি প্রকৃতির ভেতরে গিয়ে আমাকে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন গোপনে। কারণ তিনিই জানতেন, প্রকৃতিই মানুষকে প্রকৃত গোপনীয়তা দিতে পারে।
কিন্তু রুকু– দিলরুখ, তাকে ওই ষোলবছর বয়সের কী দুর্দান্ত ভালোবেসে ফেলেছিলাম, তা তো বারুমিয়াঁ জানতেন না। আমিও প্রথম-প্রথম জানতাম কি? হরিণমারার কাজি হাসমত আলির বাড়িতে থেকে প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলে পড়ছি। তাঁর দহলিজঘরে আমার আস্তানা। তক্তপোশে বিছানা পাতা। তাকে বই। দেয়ালে মক্কা-মদিনাব ছবি সাঁটা। আব যে-স্বর্গীয় বাহন পয়গম্ববকে সাত আসমানের পবে আল্লাব সামনে পৌঁছে দিয়েছিল, তাবও একটি ছবি ছিল। বাহনটির নাম বোববাখ। তাব মুখ সুন্দরী নাবীব, শবীব পক্ষিবাজ ঘোডাব। তার চুলগুলো ছিল এলিয়ে পড়া। আমি তার মুখে বুকুকে দেখতাম। দিনের পর দিন দেখতে-দেখতে ওই মুখ বুকুব মুখ হয়ে উঠেছিল। আমার বুক ঠেলে আবেগ আসত। মনে হত, কেঁদে ফেলি। বুকুকে দেখার জন্য অস্থির হতাম। ছটফট কবতাম। তাকে স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম সে আমার সঙ্গে কথা বলছে না। বাগে-দুঃখে আমার ইচ্ছে কবত তাকে প্রচণ্ডভাবে মাবি। আব একবাতে দেখলাম, তাকে কবরে শোযানো হচ্ছে। কে যেন বলছে, শফি, তুমি ওকে শেষ দেখা দেখে নাও, এবং সে করবে শোযানো শাদা কাফনপবা বুকুব মুখে কাপড় সবিয়ে দিলে আমি চিৎকার করে উঠলাম। আমার পাশে শুত হাসমত সাহবেব ছেলে আমার সহপাঠী রবিউদ্দিন–রবি যাব ডাকনাম। সে বলত, তোমাব পেছনে জিন লেগেছে শফি। বোজ বাতে তুমি খোব দেখে গোঙ্গাও। তোমাৰ আব্বাজানের কাছে তাবিজ নিয়ে এসো।
এই রবিই আমাকে সঠিকভাবে যৌনতা চিনিয়ে দিয়েছিল। প্রতি বাতে সে অশ্লীল গল্প কবত। আমার গোপন অঙ্গটি দেখতে জববদস্তি কবত। ব্যর্থ হলে নিজেবটি দেখাত। সে আমাকে জঘন্যতম অনুবোধ জানাত। সাধাসাধি কবত। আমি একবাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে টেব পেয়েছিলাম, সে আমার শবীবেব একটি ত নিয়ে কিছু করতে চাইছে। আমি তাকে ধাক্কা মেবেছিলাম। সেই প্রথম আমি কাউকে আঘাত কবি শাবীবিকভাবে। কিন্তু দিনে রবি ছিল অন্য ছেলে। স্কুলে হিন্দু ছেলেদেবই সংখ্যা বেশি। তাদের সঙ্গে একমাত্র তাবই মাখামাখি ছিল। ক্রমশ রবিব মাবফত হিন্দু ছেলেদেব সঙ্গে আমার ভাব হয়েছিল। আব রবিই আমাকে প্রথম বিড়ি ফুঁকতে শেখায়। স্কুলের পেছনে একটা মন্দির ছিল। মন্দিবটা ছিল ভেঙে পড়া অবস্থায়। ঘন কল্কেফুলেব জঙ্গলের ভেতর সেই ভাঙা কালীমন্দিবেব পেছনে রবি বিড়ি ফুঁকতে যেত। কয়েকটি হিন্দু ছেলেও যেত। দলবেঁধে সবাই বিড়ি টানত। বাঘ যেমন নাকি মানুষের রক্তের স্বাদ পেলে মানুষখেকো হয়ে ওঠে, আমিও ক্রমশ প্রচণ্ড বিড়িখেকো হয়ে উঠেছিলাম। মাঝে-মাঝে ভয় পেয়ে ভাবতাম, আব্বার অনুগত কোনও জিন যদি এ গোপন খবব ওঁর কানে তোলে, আমার একটা সর্বনাশ ঘটে যাবে।….
উলুশবাবু মাঠ থেকে সেদিন আমাকে বারুচাচাজি হাসমত সাহেবের বাড়ির সামনে পৌঁছে দিলে আমার খাতির বেড়ে গিযেছিল ওবাড়িতে। কিন্তু বারুচাচাজি চলে যাওয়ার পরই আমার বুকের ভেতর একটা ঝড় বইতে লাগল। বুকুর সঙ্গে আমার শাদি হবে? এ কি সত্যি? বুকু আমার বউ হবে এবং সে আমার পাশে শোবে এবং আমি তাকে– এ কি সত্যি হতে পাবে?
সে কি কাম? নাকি প্রেম? রবিকে সে-রাতে কথাটা বলামাত্র সে দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। জঘন্যতম সব ব্যাপার সে আমাকে হাতেনাতে শেখাতে চাইল, আর আমি আত্মসমর্পণ করলাম। কিছুক্ষণ পরেই আমি চমকে উঠলাম। লজ্জায় সংকোচে কাঠ হয়ে গেলাম। বুকু্র সঙ্গে আমি এসব অশালীন কিছু করব ভাবতেই খাবাপ লাগল। মনে-মনে মিনতি করে বললাম, বুকু। তুমি মায়ের কাছে শোনা সেই আকাশচারিণী পরি, বাড়ির পিছনে তালগাছে যে মধ্যরাতের জ্যোৎস্নায় বিশ্রাম নিতে বসত আর খড়খড় সরসর শব্দে তালের বাগড়াগুলো নড়ত। রুকু সেই পরি, যার বাসস্থান আকাশের দ্বিতীয় স্তরের পরিস্তানে, যেখানে ফুটে আছে লক্ষকোটি নক্ষত্র দিয়ে গড়া প্রলম্বিত ছায়াপথ।….
.
খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যেতেই আমি যে খোলামেলা পৃথিবীকে দেখতে পেয়ে ছুটে গেলাম, সেখানে মানুষের গলায় ফাঁসির দড়ি পরানো নিষ্ফল। দবিরউদ্দিন আমাকে কলকাতার উচ্চ আদালতে আপিলের খবর এনেছিলেন। আমি তাঁকে মনে মনে গাল দিয়ে বললাম, শুওরের বাচ্চা! ইংরেজশাহির পা-চাটা গোলাম কুত্তা। আমাকে কেউ ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে পারে না, তুমি জানো না?
এই যে অবাধ দুনিয়ার হাট করে খোলা দরজা দিয়ে আমি ছুটে চলেছি, আমার ষোলো বছর বয়সের শরীরটাকে ফিরে পেয়েছি, আমার এই স্বাধীনতা প্রকৃতি থেকে আমার বুকের ভেতর ঢোকানো হয়েছিল। খানবাহাদুর, তুমি মাথামোটা এক খয়েরখা। তুমি যে এত ধর্ম-ধর্ম করো, সব তোমার শেখা বুলি। পয়গম্বরের ছেলেবেলার একটি গল্প বলতেন আব্বা। বালক পয়গম্বর যখন রাখাল ছিলেন, হঠাৎ সেই উপত্যকায় নেমে এল দুই ফেরেশতা। তাঁকে ধরে ফেলল তারা। চিত করে শোয়াল। তারপর তাঁর বুক চিরে ফেলে তাঁর কলজে থেকে অসৎ টুকরোটি কেটে নিয়ে সৎ এবং স্বর্গীয় একটি টুকরো জুড়ে দিল! এ একটি শল্যচিকিৎসা। ফেরেশতারা উধাও হয়ে গেলে সঙ্গী রাখাল বালকেরা আতঙ্কিত হয়ে খবর দিল পয়গম্বরের ধাইমা বিবি হালিমার কাছে। বিবি হালিমা ছুটে এসে দেখলেন, বালকটি শুয়ে আছে। কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই তার বুকে। আর এই ঘটনার নাম ‘সিনা-চাখ’ বা বক্ষবিদারণ। দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরী একটি বিশাল কালো জানোয়ারের পিঠে চাপিয়ে উলুশরার তৃণভূমিতে আমাকে নিয়ে যেন এমন কিছুই করেছিলেন এবং আমার কলজে আমারই অজান্তে বদলে গিয়েছিল। আমার ‘সিনা-চাথ বুঝতে আরও তিরিশ বছর লেগে গিয়েছিল। আমি বুঝতেই পারিনি আমি কী হয়ে গেছি সেদিন থেকে। অথচ রবিউদ্দিনের সঙ্গে রাতভর দিনভর খালি রুকুর কথা বলেছিলাম। কালীমন্দিরের পেছনের কল্কেফুটের জঙ্গলে বিড়ি টানতে-টানতে বলেছিলাম, রুকুর সঙ্গে আমার বিয়ে হলে আমি ওসব কিছু করতে পারব না, রবি! আর রবি খি-খি করে হেসে বলেছিল, তোর আব্বাজান তো পির-মৌলানা মানুষ! একজোড়া জিন-পরি পাঠিয়ে দেবেন তোকে হাতে-কলমে শেখাতে। তোর আবার ভাবনা?