হ্যাঁ, ডাকাতরা সাংঘাতিক মানুষ আমি জানতাম। তাই চুপ করে থাকলাম। এই সুবিশাল কালো জানোয়ার আর এই ঠাণ্ডাহিম বন্দুকের নল ডাকাতদের বিরুদ্ধে : যথেষ্ট ভেবে ও নিয়ে মাথা ঘামালাম না। কিন্তু এতক্ষণে লক্ষ্য করলাম, হাতির সামনে চলেছে জোব্বা ধরনের পোশাকপরা, কোমরে একটা চওড়া বেল্টআঁটা, মাথায় পাগড়িবাঁধা একটা লোক। লোকটার কাঁধে একটা বল্লম। তার প্রকাণ্ড গোঁফ আর গালপাট্টা। তাকে দেখিয়ে জিগেস করলাম, ও কে চাচাজি?
‘সাতমার’। বারুচাচাজি বললেন, ওদের সাতমার বলে। ওর নাম কী জানিস, কাল্লু পাঠান। ওকে আমি উল্লু পাঠান বলি। বারুচাচাজি হাসতে লাগলেন। লালবাগের পিলখানায় ওর ডেরা। লোকটা যেমন বোকা, তেমনি বদমায়েশ। ওর বিবি হল তিনটে। ছোটোবিবির বয়স মোটে বারো।
বারুচাচাজি এত জোরে হেসে উঠলেন যে সাতমার কাল্লু পাঠান ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, হূজৌর?
কুছ নেহি! তুম আপন কদম বাঢ়াও।
বললাম, ও বাঙলায় কথা বলতে পারে না?
জবাবটা দিল কাল্লু পাঠানই। বুঝলাম তার কান তীক্ষ্ণ। সে সহাস্যে বলল, কুছু-কুছু পারে হজৌর!
ঢালু হয়ে ধাপে-ধাপে নেমে গেছে উত্তর-পশ্চিম রাঢ়ের বিস্তীর্ণ মাঠ। একটা সংকীর্ণ রাস্তা নেমে গেছে নিচের দিকে। দূরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম নীল-ধূসর সেই উলুকাশের বন। একদিন যার মধ্যিখান দিয়ে আমরা মৌলাহাটে এসে পৌঁছেছিলাম। আমার ইচ্ছে করছিল, বারুচাচাজিকে সেই কালোজিন-শাদাজিনের গল্পটা বলি। কিন্তু সেই মুহূর্তে উনি মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, তুমি জিগ্যেস করছ না শফি, হঠাৎ আমি কোথা থেকে এসে তোমাকে কেন আচমকা তুলে নিলাম!
ওঁর দিকে ঘোরার চেষ্টা করে বললাম, হাতির পিঠে বসে থাকতে ভালো লাগছে না! এত দুলছে!
আমাদের দুজনের প্রশ্নোত্তর সেদিন এমনি অসংলগ্ন ছিল যেন। কিংবা আমরা পরস্পর ঠিক প্রশ্নের ঠিক উত্তরই দিচ্ছিলাম– বুঝি না। বারুচাচাজি বললেন, হুঁ। তুমি কি শুনেছ তোমার বড়ো ভাই বাড়ি এসেছে?
চাচাজি, ফেরার সময় মৌলাহাট হয়ে এলে–
শফি, তোমার–মানে তোমাদের দুভাইয়ের, নুরুজ্জামান আর শফিউজ্জামানের শাদির ইন্তেজাম হয়েছে, জানো?
চাচাজি, বড়ো ভাই মুখে লম্বা-লম্বা দাড়ি রেখেছে নিশ্চয়?
শফি, হেসো না। বারু চৌধুরির কণ্ঠস্বর ক্রমশ ভরাট হয়ে উঠেছিল। আমি দরিয়াবানুকে খুব বোঝালাম। ওকে তো জানো, বড় গোধরা মেয়ে। তোমার বড়ো ভাইয়ের সঙ্গে রোজির আর তোমার সঙ্গে রুকুর শাদির কথা পাকা হয়ে গেছে। আগামী সাতুই অঘ্রাণ শুক্রবার তোমাদের শাদি।…।
হাতি একটা সংকীর্ণ সোতা পেরুচ্ছিল। সাতমার কাল্লু পাঠান জোব্বা গুটিয়ে পায়ের নাগরাজুতো খুলে হাস্যকর ভঙ্গিতে জল পেরুচ্ছিল। ওপারে কয়েকটুকরো ধানখেতের ভেতর হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে থাকা দুটি লোক মাথা কাত করে হাতি দেখামাত্র উঠে দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিল। একঝাঁক বুনো হাঁস সোঁতার জল থেকে শনশন করে উড়ে ফুলন্ত কাশবনের ওপর দিকে ঘননীল আকাশে মিশে যাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছিল। কোথায় ডাকছিল একলা কোনও হট্টিটি পাখি ট্টি ট্টি ট্টি…ট্টি ট্টি ট্টি। আর আমি দেখছিলাম এইসব নানারঙের নানা ঘটনার টানাপোড়েনে গাঁথা বারু চৌধুরির ‘নেচার’কে কেউ বা কিছু এক অগাধ বিষাদে আচ্ছন্ন করে আছে। কুয়াশার মতো বিস্তৃত সেই বিষাদ, হরিণমারার জমিদারবাড়ির চত্বরে শোনা বেহুলা লখিন্দর যাত্রাপালার আসরে চারুমাস্টারের বেহালার বাজনার মতো গম্ভীর-করুণ এক সুর। ওই ধারাবাহিক ট্টি ডি ডি…টি টি ট্রি হট্টিটি পাখির ডাকে কি নীল আকাশজোড়া শূন্যতারই কণ্ঠস্বর? যেকারণে কাল্লু পাঠানের সোঁতাপেরুন এবং দুই আধন্যাংটো চাষার ভঙ্গিও আমাকে শেষ পর্যন্ত হাসাতে ব্যর্থ হল?
আর বারুচাচাজি কথা বলছিলেন ষড়যন্ত্রসংকুল কণ্ঠস্বরে….এ হতে পারে না শফি! তোমাকে লেখাপড়া শিখতে হবে। হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে মুসলমানকে। তুমি নিশ্চয়ই স্যার সৈয়দ আহমদের কথা পাঠ্য বইতে পড়েছ। দেওবন্দ যেখানে তৈরি করছে ছদ্মবেশী ভিখিরির দল, সেখানে আলিগড় তৈরি করছে নয়া জামানার প্রতিনিধিদের। কেন ছদ্মবেশী ভিখিরি বলছি, বুঝতে পারছিস তো শফি? তুই মৌলানাবাড়ির ছেলে। তুই বুদ্ধিমান। তোর বোঝা উচিত, এভাবে অন্যের দান হাত পেতে নিয়ে বেঁচে থাকাটা মনুষ্যত্বের অবমাননা। নুরুজ্জামানকে আমি বুঝিয়েছি। তাকে বলেছি, এটা ইসলামের প্রকৃত পন্থা নয়। নুরুজ্জামান মহা তর্কবাগীশ হয়ে ফিরেছে। কথায়-কথায় সে কোরানহাদিশ কোট করে। কিন্তু এটুকু বোঝ না, মুরিদ(শিষ্য)দের ওটা ভক্তি নয়, আসলে দয়া। শফি, তোর আব্বাও এটা হয়তো টের পান। তাই তোকে ইংরেজি স্কুলে পড়তে দিয়েছেন। তোর আব্বার মধ্যে বড্ড বেশি পরস্পর-বিরোধিতা। তিনিই বলেন, হিন্দুস্থান মুসলমানের দারুল হারাব’, আবার তিনিই পয়গম্বরের কথা আওড়ান; উতলুবুলইমা আলাওকানা বি সিন’। এলেম বা শিক্ষার জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন মুলুকে যেতে হলেও চলে যাও। না শফি, নুরুজ্জামানকে নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তোকে আমি আবিষ্কার করেছি –তোকে আমি হারাতে চাই না। তোকে আমি নিয়ে পালিয়ে যাব লালবাগ শহরে। নবাববাহাদুরকে বলে তোকে ওঁদের ‘নবাববাহাদুর ইনসটিটিউশনে ভরতি করে দেব। ওটা ওঁদের পারিবারিক স্কুল। বাইরের ছাত্রদের নেওয়া হয় না। তবু আমি ওঁকে রাজি করাব। শফি, তুই এখনও নাবালক। শাদি দিলে তোর লেখাপড়া কিছুতেই হবে না, বাবা!