আর সাইদা তেমনি বসে আছেন। মাথা দুহাঁটুর ফাঁকে। খোলা দরজা। উঠোনে ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে। ঝড়ের ভীষণতা শান্ত হয়ে গেছে। শুধু মাঝে-মাঝে একদমক করে বিভ্রান্ত হওয়ার ঝাঁপটা নিতে গাছপালা দুলে উঠছে। সাইদার মনে হচ্ছিল বিশাল খোলামেলা প্রান্তরে বসে বৃষ্টিতে অসহায় ভিজছেন।
ভোরে যখন বৃষ্টি থেমেছে, আয়মনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে সাইদাবেগমের ঘরের দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়াল। দরজা খোলা। আর নগ্ন মাটির মেঝেয় চুল এলিয়ে উপুড় হয়ে মাথা কোটার ভঙ্গিতে পড়ে আছেন বিবিসাহেবা।…
০৬. খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পর
Man’s like the earth, his hair like grasse is grown
His veins the rivers are, his heart the stone! .
…খানবাহাদুর দবিরউদ্দিন চলে যাওয়ার পরই পিছু ফিরে দাঁড়িয়েছিলাম। কারণ পৃথিবীর ঘৃণ্যতম পদার্থগুলোর অন্তর্ভুক্ত বলে জানতাম এই লোকটিকে। আর বারু চৌধুরির মুখে শুনতে-শুনতে মুখস্থ হয়ে-যাওয়া ওই সতেরো-শতকী ইংরেজি পদ্যটি প্রতিধ্বনিত হত তাঁর কথা মনে এলেই। স্বীকার করতে বাধ্য, কোনও এক প্রস্তরীভূত মুহূর্তকে এই পদবন্ধ বুঝি ছুঁয়ে আছে, কিংবা ধরা আছে এর মধ্যে আমার মতোই মানুষের চেরাগলার আর্তনাদ, যা শুনে কাল মধ্যরাতের রোগা শাস্ত্রীটি তার লম্বা নাক সেলের গরাদের ফাঁকে ঢুকিয়ে কুতকুতে চোখের মমতা দিয়ে আমাকে দেখছিল!
খানবাহাদুর চলে গেলে পিছু ফিরে দাঁড়িয়ে আব্বার আরবি শ্লোকপাঠের মতো পদ্যটি মনে-মনে আওড়ানোর পরই একটি ‘মোজেজা’ ঘটল। হঠাৎ দেখলাম, নিরেট স্তব্ধ ফ্যাকাশে দেয়াল কুয়াশার মতো নীলচে হতে-হতে অবিশ্বাস্য রোদের তীব্রতায় মিলিয়ে গেল। ভেসে উঠল হলুদ কল্কেফুলের জঙ্গল, নবারি মসজিদের গম্বুজ, হরিণমারা প্রসন্নময়ী হাই ইংলিশ স্কুলের সামনেকার ত্রিকোণ শীর্ষভাগ, যাকে হেডমাস্টার বিষ্ণুচরণ রায়-স্যার বলতেন ইতালীয় স্থাপত্যের অনুকরণ—’তুমি হাজারদুয়ারি প্যালেস যদি দেখো থাকো লালবাগ শহরে, দেখবে নবাববাহাদুর হুমায়ুন জাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তি।’ আসলে আমি তখন ষোলো বছর বয়সের সেই শরীরকে দেখতে পাচ্ছি। আমার সেই মায়া-শরীরকে দেখে বুঝতে পারছি, তার দণ্ডিত ভবিষ্যৎ, তার জঘন্যতম কীর্তিকলাপ, হত্যাকাণ্ড, তার নারীকে ভালোবাসার এবং অবাধ রমণে লিপ্ত হওয়ার সেই সময়টিকে, তার রাজনৈতিক বিদ্রোহ, তার ধর্মকে লাথি-মারা নাস্তিক্য– সবকিছুই ওই পরাবাস্তবতাময় কুয়াশার মধ্যে মুছে গেছে। ঘণ্টা বাজছে। স্কুলের ছুটির ঘণ্টা। ঘণ্টা বাজছে। দেওয়ান বারু চৌধুরির হাতির গলার ঘন্টা। ন্যাংটো, আধন্যাংটো ছেলেপুলে আর তাদের গতরজীবী বাবা-মায়েরা ভিড় করে চলেছে হাতির পেছনে। তারা সুর ধরে ছড়া গাইছে; ‘হাতি তোর গোদা গোদা পা/হাতি তুই নেদে দিয়ে যা। আর আমার অবোধ গ্রামীণ সারল্যভরা ষোলো বছর বয়সের হৃদয়টুকু নতুন এক আবেগে মুহুর্মুহু শিউরে উঠছে। তারপর হাতিটি হাঁটু ভাঁজ করে বসল আর বারুমিয়াঁ দেওয়ান মিটিমিটি হেসে বললেন, আয় শফি! দুরুদুরু বুকে আমি হাতির হাওদায় উঠলে বারুমিয়াঁ আমাকে সামনে বসিয়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরলেন। হাতির মাহুত কী সব আওয়াজ দিতে থাকল। আর বিশাল কালো জটি উঠে দাঁড়াল। পৃথিবী দুলতে লাগল। আমার চোখে সেই দুলন্ত পৃথিবী, ইতালীয় স্থাপত্যের অনুকরণ, ভিড়, হইহল্লা, নবারি মসজিদের গম্বুজ, জমিদার বিজয়েন্দ্রনারায়ণের কনিষ্ঠ পুত্র সৌম্যেন্দ্রনারায়ণ– যাকে ক্লাসে সবাই হাবুল বলে ডাকত, তার দুচোখের তাচ্ছিল্য পর্যন্ত দুলছিল, কাঁপছিল, দূরে সরে যাচ্ছিল। আর বারুচাচাজি যখন জিগ্যেস করলেন, তোের কি ভয় করছে শফি, আমি জোর গলায়। বললাম, না। তখন বারুচাচাজি বললেন, ভয় পাস নে। এ হাতি সেই হাতি নয়। হরিণমারা গ্রাম ক্ৰমে পিছনে চালচিত্র হতে-হতে ঘন নীল-ধূসর পোঁচে পরিণত হলে একবার জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাচ্ছেন চাচাজি? বারু চৌধুরি বললেন, নেচারের ভেতর।।
বারুচাচাজি হাসছিলেন। শফি, এটা কী দেখতে পাচ্ছিস? বলে হাওদার পাশ থেকে যে লম্বাটে জিনিসটা বের করলেন, শিউরে উঠে দেখলাম সেটা একটা বন্দুক। সঙ্গে-সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, বারুচাচাজির পরনে হাফ প্যান্ট, গায়ে ছাইরঙা হাফ শার্ট, মাথায় শোলার টুপি। অমনি আমার গা ছমছম করল। মনে পড়ছিল, নবাবগঞ্জে থাকার সময় ঠিক এই পোশাকপরা একটি লোককে দেখে গ্রামের সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে মাঠে-বনে-বাদাড়ে গিয়ে গা ঢাকা দিয়েছিল। ইংরেজ সরকারের প্রতিনিধিদেব কী ভয় না করত লোকেরা!
বন্দুকের নলে আঙুল ছোঁয়াতেই টের পেলাম অসাধারণ ঠাণ্ডাহিম, যদিও সেটা শীতঋতু নয়। তারপর বললাম, আপনি কেন এ পোশাক পরেছেন চাচাজি?
বারুমিয়াঁ একটু হেসে বললেন, উলুশরার মাঠে বাঘ আছে শুনেছি। তবে বাঘের চেয়ে সাংঘাতিক জানোয়ার কী জানিস? মানুষ!
অবাক হয়ে বললাম, কেন?
আসলে তখনও মানুষ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। বদুপিরের সন্তান হিসেবে যত মানুষ দেখেছি, তারা বিনত, নম্র, মৃদুভাষী। তারা হিন্দু হলে কপালে হাত ঠেকিয়ে ‘আদাব’ বলেছে, মুসলিম হলে ‘সালাম’ অথবা ‘আসোলামু আলাইকুম’ সম্ভাষণ করেছে। আমি লালপাগড়ি মাথায়, খাকিপোশাক পরা পুলিশ দেখেছি, দারোগা দেখেছি। তারা লোকের কাছে যত ভয়াবহ হোক, আমি তাদের কখনও ভয় পাইনি। কারণ তারা কেউ-কেউ আব্বাকে সম্মান জানিয়েছে এবং তাঁর দোয়া-ফোঁকা জলও পান করেছে। এইসব কারণেই আমি বারুচাচাজির কথায় চমকে উঠেছিলাম। আর জবাবে বারুচাচাজি আস্তে আস্তে বললেন, আমি নবাববাহাদুরের। দেওয়ান জানিস তো? মহলে-মহলে গিয়ে নায়েবদের খাজনার তহবিল জমা নিই। এই হাওদার তলায় সেইসব টাকাকড়ি আছে। তাই কয়েকবার ডাকাতরা হামলা করেছিল।