নাদান আওরত! বদিউজ্জামান ম্লান হেসে এগিয়ে তার কাঁধে হাত রাখলেন। তুমি কি জানো না, কোরান শরিফে আল্লাহ বলেছেন–
কান্নাজড়িত স্ববে সাইদা বললেন, চুপ করুন! ওসব বুলি মসজিদে শোনান গিয়ে। আমার কাছে নয়।
নাউজবিল্লাহ! সাইদা! কী বলছ তুমি! এ যে গোনাহ!
সাইদা বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন। গোনাহ। আর নিজের বিবির ভালোমন্দ না। তাকিয়ে মাস-কাল ধরে মসজিদে পড়ে থাকাটা বুঝি নেকি (পুণ্য)? আবার না তাকিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সাইদা। –আমার বাছাদের দূর-দূরান্তে পাঠিয়ে আমার কোলছাড়া করে দেওয়া নেকি? আর ওই মনি –তার কী হাল, আর বিবিজি –যাঁর পেট থেকে পড়ে দুনিয়ার মুখ দেখেছেন– তিনি হরবখত কাঁদছেন, মউতের আগে বেটার হাতের পানি মুখে পাব না– এও বুঝি নেকির কাজ?
বদিউজ্জামান কাতরস্বরে বললেন, আমাকে ভুল বুঝো না সাইদা! এসো তোমাকে শুয়ে শুয়ে সব বাতলাব। এসো।
সাইদাকে টেনে এনে মেঝেয় পাতা বিছানায় বসালেন। তারপর একটু চমকে উঠে বললেন, এঘরে তত্তাপোশ নেই দেখছি! মহিউদ্দিনকে বলেছিলাম–
বাধা দিয়ে সাইদা বললেন, আমি ছপ্পরখাটে শোব। আর বিবিজি মেঝেয় শোবেন? তক্তাপোশ ওঘরে আছে।
স্ত্রীর মুখচুম্বনের চেষ্টা করতে গিয়ে বাধা পেলেন বদিউজ্জামান। শুকনো হাসলেন। কিন্তু তুমি এমন বেরহম (নিষ্ঠুর) কেন হলে সাইদা? আমি তো হরবখত এত্তেকাফ নিয়ে মসজিদে হপ্তাভর থেকেছি। কখনও তো তুমি এমন করোনি।
হঠাৎ সাইদা মুখ নিচু করে বললেন আপনি নিকাহ করবেন– আমি বুঝতে পেরেছি।
বদিউজ্জামান আবার হাসলেন– আড়ষ্ট শুকনো হাসি।…আমার হুজুর পয়গম্বরসাহেব কতগুলো নিকাহ করেছিলেন তুমি তো জানো। কিন্তু আমি নাদান আদমি সাইদা! এই দেখো না, তোমার ওপরই কত অবিচার করি– আবার নিকাহের কথা কি আমার ভাবা সাজে? তবে তোমার ভাবা উচিত ছিল, এমনকরে ঝড়পানির মধ্যে কেন ছুটে এলাম তোমার কাছে।
অস্ফুটস্বরে সাইদা বললেন, কেন?
একটু চুপ করে থাকার পর শ্বাস ছেড়ে বদিউজ্জামান বললেন, তুমি শফির কথা বলছিলে। হঠাৎ কেন কে জানে ঝড়টা ওঠার সঙ্গে-সঙ্গে শফির কথা মনে এসে গেল। আমার বুকটা কেমন করতে লাগল । সাইদা, অমনি মনে হল শফিকে তুমি নজর-ছাড়া করতে পারো না। তাহলে কী অবস্থায় তোমার দিন কাটছে। কত কষ্ট তোমাকে সইতে হচ্ছে!
সাইদা কান্না চেপে বললেন, খোদার মেহেরবানি যে আপনি কথাটা ভেবেছেন।
ভেবেছি। ভেবেই মনে হয়েছে, আমি গোনার ভাগী হচ্ছি। তোমাকে বঞ্চনা করছি।
আপনি বুজুর্গ মানুষ। সাইদার বাঁকা ঠোঁট থেকে কথাটা ব্যঙ্গমিশ্রিত হয়ে বেরিয়ে এল।
ছিঃ! তামাশা কোরো না সাইদা।
সাইদা একটু চুপ করে থাকলেন। বাইরে অঝোর বৃষ্টির শব্দ এখন। মাঝে মাঝে মেঘ ডাকছে। পিঠে স্বামীর হাতের আদর অনুভব করছিলেন সাইদা। তবু আজ তার দেহ যেন নিঃসাড়। অবিশ্বাস তাঁকে ঘিরে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরে বললেন, তামাশা করছি না। আমি জানি জিনেরা এসে আপনার সঙ্গে কথা বলে। আপনি বজুর্গ না তো কী?
ওসব কথা থাক, সাইদা! রাত হয়েছে। শুয়ে পড়া যাক। ফজরের আগেই আমাকে মসজিদে যেতে হবে।
মসজিদে তো অনেকদিন থাকলেন। এবার বাড়ি ফিরবেন না?
বদিউজ্জামান কথাটা বলেই শুয়ে পড়েছিলেন। সাইদা শুলেন না! তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে লক্ষ্যটা আনার জন্য উঠতে গেলেন। কিন্তু বদিউজ্জামান তাঁকে উঠতে দিলেন না। বললেন, আজ তোমাকে একটু দেখি। কতদিন তোমাকে দেখিনি, সাইদা!
আপনি কবে বাড়ি ফিরবেন, আগে বলুন?
সাইদা, সত্যি বলছি– হয়তো আমার এক্তিয়ারে আর কিছু নেই।
ভীষণ চমক খেয়ে সাইদা বললেন, কেন?
জানি না। বদিউজ্জামান আচ্ছন্ন কণ্ঠস্বরে বললেন। কী একটা ঘটছে, তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। খালি মনে হচ্ছে, এই মসজিদে আমার জিন্দেগির একটা পরদা খুলে যাচ্ছে। যা কখনও বুঝিনি, তা সব বুঝতে পারছি!….নাঃ! আমার খামোশ থাকা উচিত।
এ ধরনের কথাবার্তা সাইদা কখনও স্বামীর মুখে শোনেননি। তাঁর বুগুর্জপনা বা কেরামতির কথা সবই শাশুড়ির কথায় কিংবা অন্য লোকের কাছে পরোক্ষে আঁচ করেছেন মাত্র। তাই তীক্ষ্ণদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন সাইদা। তারপর কী এক হঠকারিতাবশে তিনি বলে উঠলেন, আমাকে নাদান আওরত ভেবে আপনি যা বললেন, আমি তা মানব না। আমি জানি আপনি কেন আমার কাছ-ছাড়া হয়ে আছেন এতদিন।
ছিঃ সাইদা! আবার ওই কথা! বলে বদিউজ্জামান নিজেই উঠে গিয়ে লম্ফটা নিবিয়ে দিয়ে এলেন। তারপর স্ত্রীকে আকর্ষণ করলেন। নিজের জৈবসত্তার তীব্রতা তাঁকে অস্থির করে ফেলছিল ক্রমশ।
কিন্তু সাইদা বাধা দিয়ে বললেন, আপনি যাই বলুন, নিকাহ করার মতলব হয়েছে, আমি জানি।
সাইদা! আল্লার দোহাই, তুমি চুপ করো!
সাইদা ক্রমশ প্রগলভা আর আর সাহসী হয়ে উঠছিলেন বদিউজ্জামানের পরিবর্তিত আচরণ আর ভাবভঙ্গি দেখে। অন্ধকারে শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, মেয়েটি বুঝি কুঠো আবদুলের বউ?
কী বললে? বদিউজ্জামান মুহূর্তে নিঃসাড় হয়ে গেলেন। বাইরের আকাশের বজ্ৰ যেন তাঁরই মাথায় পড়ল।
হ্যাঁ, ওই মেয়েটার পেছনে যেভাবে লেগেছেন শুনতে পাই–
বদিউজ্জামান সরোষে অন্ধকারে স্ত্রীর গালে থাপ্পড় মারলেন। থাপ্পড়টা সাইদার মাথায় লাগল। তারপর বদিউজ্জামান শয্যা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। সশব্দে দরজা খুলে বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়ে গেলেন। খালি পায়েই ছুটে এসেছিলেন মসজিদ থেকে। এখন তাঁর পরনে শুধু তহবন্দ, খালি গা, খালি পা।