তাহলে কি মৌলানার কাছে এতদিনে তার আকর্ষণ ফুরিয়ে গেছে? উনি কি ভেতর-ভেতর নিকাহের (বিয়ে) মতলব করেছেন? মৌলাহাটে আসার পর সাইদা লক্ষ করেছেন এখানকার মেয়েরা পরদানসীনা নয়। এদের মধ্যে স্বৈরিণী ও স্বাস্থ্যবতী সুন্দরীরাও বড়ো কম নেই। তার চেয়ে ভাবনার কথা, এখানকার পুরুষগুলোর হাবভাব কেমন যেন সন্দেহজনক। তারা ওঁকে আমরণ আটকে রাখার জন্য ব্যস্ত। তাহলে কি তারাই ওঁকে কৌশলে প্ররোচিত করছে কারুর সঙ্গে নিকাহ দেওয়ার উদ্দেশ্যে?
ভীষণ গর্জনে বজ্রপাত হল। থরথর করে কেঁপে উঠলেন সাইদা। প্রতিবন্ধী ছেলেকে আঁকড়ে ধরে অন্ধকার ঘরে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। পাশের ঘরে পক্ষাঘাতগ্ৰস্তা শাশুড়ি আছেন। কবে কখন তাঁর মৌলানাপুত্র এসে বউবিবির পাশে রাত্রিযাপন করবেন ভেবেই বরাবর তিনি আলাদা শুয়ে থাকেন। মৌলাহাটে আসার পর কোনো-না-কোনো বয়স্কা মেয়ে, তারা বিধবা অথবা স্বামী পরিত্যক্তা, পিরজননীর পাশে শুয়ে পুণ্য সঞ্চয় করে। এ রাতে আয়মনি এসে শুয়েছে। একটু আগে সে বেরিয়ে এসে সাইদার ঘরের বদ্ধ কপাটের ওধার থেকে জেনে গেছে, বিবিজির ডর লাগছে কি না। মেঘের গর্জন বাড়লে সাইদা আবার তার সাড়া পেয়ে বিরক্ত হলেন। বললেন, তোমার চোখে কি নিদ নাই, আয়মণি? চুপচাপ শুয়ে থাকতে পারছ না?
আর সাইদা যখন ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, তখনই বৃষ্টির শব্দ শোনা গেল বাইরে। প্রথমে দড়বড় করে ঘোড়সওয়ারদলের ছুটে যাওয়ার মতো, তারপর হাওয়ার। শনশনানির মতো ঝরঝর ধ্বনি। মেঘের ডাকে যেন ছন্দ এল । কিন্তু হাওয়া থামল না। তার একটু পরেই আবার আয়মনির ডাক শুনলেন সাইদা। সে কপাটে ধাক্কা দিচ্ছিল। এবার তার কণ্ঠস্বর চাপা। বিবিজি! ও বিবিজি! লম্ফ জেলে শিগগিরি উঠুন দিকিনি! আমার লক্ষ বুতে গেল।
সাইদা দ্রুত চোখ মুছে উঠে বসলেন। শলাইকাঠি ঘষে লক্ষ জাললেন। তাঁর বুক ধড়াস করে উঠেছে। শাশুড়ি-বেগমের কি মউত হতে চলেছে, তা না হলে আয়মনির গলার স্বর অমন কেন?
দরজা খুললেন কাঁপা-কাঁপা হাতে। অন্যহাতে লক্ষ্যের শিখাও প্রবলভাবে কাঁপছে। সামনে আয়মনিকে এক পলকের জন্য দেখলেন। উঠোনে বিদ্যুতের ঝলসানিতে ঘন বৃষ্টিরেখা বাঁকা। আর আয়মনির মাথায় এমন ঘোমটা টানা যে তার চোখ ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সে দ্রুত ছিটকে গেল। আর সামনে যাঁকে দেখলেন সাইদা, তাঁকে স্বপ্নের মূর্তি মনে হল। ভিজে শাদা পোশাকপরা ম্রিয়মাণ মূর্তিটিকে খর্বাকার বিভ্রম হল। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন সাইদা বেগম। আর সেই কুঁকড়েথাকা, বিষঃ ঝড়ের রাতের আগন্তুক জড়ানো গলায় কী উচ্চারণ করে সাইদাকে ঠেলে ঘরে ঢুকলেন। তখন সাইদা আচ্ছন্নতা থেকে জেগে উঠে বুঝলেন, এই কাকতাড়ুয়াবৎ মূর্তিটি তাঁর স্বামীরই।
পরাক্রমশীল এক ‘দেও’ (দৈত্য), এতকাল সাইদা যার সামনে অবচেতন ভয় আর সংস্কারলালিত ভক্তিতে বিনত থেকেছেন, এই ঝড়বৃষ্টির রাতে তাঁর দিকে নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে ছিলেন।
আর বদিউজ্জামান ওই নতুন চাহনি দেখে ঈষৎ বিস্মিতও হয়েছিলেন। কিন্তু যে অতর্কিত আবেগ এমন রাতে তাঁকে ঐশী আবহমণ্ডল থেকে মাটিতে নিক্ষেপ। করে কাদামাটিতে গড়া নিছক আদম-সন্তানে পরিণত করেছে, সেই আবেগই তাঁকে একটু হাসি দান করল। মৃদু হাস্যে তিনি বললেন, কী হল সাইদা? দেখছো না আমি ভিজে গেছি? আমাকে শিগগির শুকনো কিছু ‘লেবাস’ পোশাক) দাও। জাড় মালুম হচ্ছে।
একটিও কথা না বলে সাইদা ছোট্ট কাঠের সিন্দুকটি খুললেন। ভাঁজ করে রাখা শাদা একটি তহবন্দ (লুঙ্গি) আর দড়ির আলনা থেকে একটি তাঁতের নতুন গামছা এনে দিলেন। লস্ফটি সিন্দুকের ওপর রেখে তিনি দরজার কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখার ছলে আয়মনিকে খুঁজলেন। আয়মনি আবার তার শাশুড়ির ঘরে গিয়ে শুয়ে। পড়েছে। দরজা বন্ধ। চাপা স্বরে কথা বলছে কামরুন্নিসার সঙ্গে ও কানে এল সাইদার।
বদিউজ্জামান দ্রুত পোশাক বদলে নিতে-নিতে আড়ষ্টস্বরে বললেন, আমার সেই কামিজটা? তখন সাইদা দরজা থেকে মুখ না ঘুরিয়ে আস্তে বললেন, সিন্দুকে আছে।
অমনি বদিউজ্জামান তাঁর কাছে এসে দরজা বন্ধ করে দুহাতে স্ত্রীর দুই কাঁধ ধরে তাঁকে ঘোরালেন নিজের দিকে। সাইদা একমুহতের জন্য স্বামীর উজ্জ্বল গৌর বুকের কাঁচাপাকা রোমগুলির দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, আঃ! মনি আছে।
মনিরুজ্জামান অবশ্য গাঢ় ঘুমে কাঠ। রাতে জ্বালাতন করে বলে দরিয়াবানুর পরামর্শে পাশের গ্রাম দুনিতলার কবরেজের বড়ি খাওয়ানো হয়। বড়িটিতে আফিম মেশানো। বদিউজ্জামান একথা জানেন না। তাই চকিতভাবে ঘুরে বিছানায় মেজো ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর তার কুঁকড়ে পাশফিরে শুয়ে থাকা দেখে আবার স্ত্রীকে আকর্ষণ করলেন। তখন সাইদা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে একটু তফাতে সরে গেলেন।
বিস্মিত, ব্যথিত বদিউজ্জামান চাপাস্বরে বললেন, তোমার কী হয়েছে সাইদা? তুমি এমন করছ কেন?
সাইদার নাসারন্ধ ফুরিত। লম্ফের আলো তত উজ্জ্বল নয়। আলো অন্ধকারে তাঁর এই অদ্ভুত চেহারা বড়ো অবিশ্বাস্য লাগছিল বদিউজ্জামানের। তিনি স্বভাবে একরোখা, তেজী এবং আবেগপ্রবণ মানুষ। স্থির দৃষ্টে স্ত্রীকে দেখতে-দেখতে ভাবছিলেন, কী কথা এবার বলবেন? তিনি নির্জন মসজিদ থেকে এই দুর্যোগের রাতে এমন করে কেন ছুটে এসেছেন, সেকথা বলার জন্য ব্যাকুল। অথচ সাইদার হাবভাব দেখে তিনি এত অবাক যে মুখে কথা আসছে না। কষ্ট করে আবার একটু হাসলেন শুধু। আর সাইদা হিসহিস করে বলে উঠলেন, আমার কাছে আপনার কী দরকার? তারপরই দুহাতে মুখ ঢেকে ঘুরে দাঁড়ালেন। তাঁর পিঠের দিকটা কাঁপতে থাকল।