ভেতরে কী করছেন আব্বা? ওখানে কোনো জিনও ঢুকে পড়েনি তো? কিংবা ভেতরে আব্বা আছেন তো? মূহুর্মূহু এইসব প্রশ্ন জাগত মনে। কখনও অজানা ভয়ে তার গা ছমছম করে উঠত। সেইসব মুহূর্তে তার ইচ্ছে করত, প্রচন্ড চেঁচামেচি করে উঠবে। অনেক কষ্টে এই ইচ্ছেকে দমন করত শফি। তারপর কোন মুসল্লি এসে পড়লে তাকে দেখে সে ভুরু কুঁচকে জিভ বের করে মাথা নাড়তে নাড়তে তার একটা হাত ভরে টানত এবং বাইরে নিয়ে যেত। ফিসফিসিয়ে তাকে ভর্ৎসনা করত। শফি বলত, এঁটো থালা নিয়ে যেতে হবে না? সেজন্যেই তো বসে আছি। মুসল্লি বলত, সে ভার আমার। যানদিকিনি আপনি। ঘর যানদিকিনি।
ধর্মগুরুর বাড়ির ছেলে বলে কাচ্চাবাচ্চাদেরও লোকে আপনি-টাপনি করত। কিন্তু শুধুই মুখের ভক্তি নয়। বালক শফি দেখেছে, সারাবছরই কত জায়গার লোক দেখা করতে আসছে হজুরের সঙ্গে। টাকাকড়ি ভেট দিচ্ছে পায়ের কাছে। কেউ আসছে গোরুরগাড়ি বোঝাই খন্দ ফলমূল নিয়ে। দলিজঘরের বারান্দায় জমে উঠছে শস্যের বস্তা। শাক-সবজির স্তূপ। পুকুরের মাছ। মুরগি-মোরগ। আস্ত খাসি। আর কোরবানির পরবে তো দলিজঘরের একপাশে খেজুরতালাই বিছানো থাকত। আর তাতে জমে উঠত মাংসের পাহাড়। সত্যি পাহাড়। শফির চেয়ে উঁচু।
দয়ালু মৌলানা কিন্তু অনেকটাই বিলি করে দিতেন গরিব-গুরবোদের। রোজই ভিখিরির ভিড়, ফকিরফাঁকরার ভিড়, মুসাফির লোকের ভিড় দলিজের সামনের চত্বরে। ওরা সবাই মুসলিম ছিল না। হিন্দুসমাজের নিচুতলার নিরন্নরাও এসে দাঁড়াত। কুনাইপাড়ার একচোখ কানা সরলাবুড়ি, যাকে মায়ের হুকুমে সল্লাপিসি বলতে বাধ্য হয়েছিল শফি, ইদ বা কোরবানির দিন সে খুব ভোরবেলাতেই এসে বসে থাকত ওই চত্বরে। একটা প্রকাণ্ড নিমগাছ ছিল সেখানে। তখনও পাখ-পাখালি ডেকে ওঠেনি। বদিউজ্জামান দলিজঘরেই রাত কাটাতেন। সবে উঠে চাপাগলায় ঈশ্বরের প্রশস্তি উচ্চারণ করছেন। তামাচিনির বৃহৎ বদনা আর ময়ুরমুখো ছড়িটি হাতে নিয়ে মসজিদে ফজরের নমাজে যাবেন বলে দরজা খুলতেই ‘আঁই বাবা!’
ওই ছিল সল্লাকানির সাড়া দেওয়া। এসেছে জানাতে আচমকা বেড়ালের মাও করে চেঁচিয়ে ওঠার মতো ওই দুটি শব্দ। নিঝুম দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর সাইদা মেঝেয় বসে সুরে ধরে বাংলা পুঁথি পড়ছেন। শাশুড়ি কামরুন্নিসা চোখ বুজে শুয়ে কান করে শুনছেন। চৌকাঠের কাছে একদঙ্গল পাড়ার মেয়ে জুটেছে। শুনতে শুনতে কেউ ঢুলছে। ভাদুর মা তো বারান্দায় গড়িয়েই পড়ত। ওদিকে ভাদু মাঠ থেকে ফিরে সাৰা পাড়া মা মা করে গর্জে বেড়াচ্ছে। এদিকে বাদশাহ নমরুদ খাঁটিয়ার শীর্ষে মাংসখণ্ড ঝুলিয়ে তিনটে শকুনকে লোভ দেখিয়ে আসমানে উঠেছেন, হাতে তীরধনুক, খোদার বুকে তীর মারবেন। আর খোদা মুচকি হেসে ফেরেশতাকে বলছেন, বেচারা নমরুদকে খুশি করো। ওর ছুঁড়ে মারা তীরের ডগায় রত মাখিয়ে ফেরত পাঠাও। তখন ফেরেশতারা রক্ত চেয়ে বেড়াচ্ছেন হন্যে হয়ে। শেষে মাছ দিল রক্ত। আর খোদা বললেন, হে মাছ, এরপর থেকে মরা অবস্থাতেও তুমি হারাম বলে গণ্য হবে না। সেই সময় আচমকা ‘আঁই মা!’
ভাদুর মা তড়াক করে উঠে বসে চুল বাঁধতে লাগল। সদুর বউয়ের দুলুনি কেটে লালা মুছতে থাকল। বাকি মেয়েরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। কামরুন্নিসাও ফোকলা দাঁতে হাসতে মুখ তুলে বললেন, কৈ, সরো সরো। দেখি সল্লাকানিকে। সাইদা চাপাগলায় হুঁশিয়ারি দিলেন, চুপ চুপ। গলাবাজি কোরো না তো তোমরা শুনতে পেয়ে নসিহত (ভর্ৎসনা) করবেন।
বদিউজ্জামান দলিজে। তাই এই হুঁশিয়ারি । শফি মায়ের আঁচল টেনে বলে, আম্মা! বলুন না, তারপর কী হল? তীরে মাছের রক্ত মাখিয়ে কী করল?
সাইদা চোখ পাকিয়ে বলেন, রক্ত না, খুন।
কেন আম্মা?
হিঁদুরা রক্ত বলে।
এসব ঘটনা কুতুবপুরে থাকার সময়। গ্রামটা ছিল বড়ো। হিন্দু-মুসলমান প্রায় সমান-সমান। মাঝখানটাতে নোম্যানস ল্যান্ডের মতো একটা চটান। নিমগাছের। জঙ্গল। কী খেয়ালে বদিউজ্জামান কনিষ্ঠ পুত্রকে সেখানে নিসিং পণ্ডিতের পাঠশালায় ভর্তি করিয়েছিলেন। নিমের জঙ্গলের ভেতরে পায়েচলা পথ। চৈত্র মাসে নিমফুল ফুটে মিষ্টি গন্ধে মউমউ করত। গন্ধট। যখনই কোথাও পেয়েছে, শফির নাকে এসে সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপটা মেরেছে নিসিং পণ্ডিতের তামাকের গন্ধ। এক গন্ধ আরেক গন্ধের পেছনে ওত পেতে আছে। একটা কালো মানুষের পেছনে যেমন একটা শাদা-মানুষ।
চটানটাকে বলা হত মানকের চটান। মানিক নামে কোনো লোক ছিল হয়তো। মানকের চটান পেরুলেই ছোট্ট ঘরে পাঠশালা। তালপাতার ছোট-ছোট চাটাই যার যার তার-তারটা। সাইদা নিজের হাতে যত্ন করে শফির চাটাই বুনে দিয়েছিলেন। সফি সেই চাটাই ছিঁড়ে চিবুত। তার চেয়েও ধেড়ে পড়ুয়াদের ভিড়ে সে সবসময় সিঁটিয়ে থাকত।
শফির বৃত্তি পরীক্ষার আগেই বদিজ্জামান তল্পি গুটোলেন কুতুবপুর থেকে খয়রাডাঙ্গার মুসলমান জমিদার ইটের বাড়ি দিচ্ছেন হুজুরকে। সেখানে মিনার আর গম্বুজওয়ালা বিশাল মসজিদ। পাশে মাদ্রাসা, সারবন্দি তালেবুল আলিমদের থাকার ঘর। চত্বরে ফোয়ারা। ফুলবাগিচা। দুনিয়ায় যেন বেহেশতের একচিলতে প্রতিবিম্ব।
দেউড়িতে রোজ সন্ধ্যায় নমাজের পর নহ’ত বাজে। জমিদার আশরাফ খানচৌধুরি হুজুরের কথায় নহবত বন্ধ করে দিয়েছেন। ফরাজিমতে দীক্ষা নিয়েছেন। গান-বাজনা হারাম ঘোষিত হয়েছে। কড়া পরদার হুকুম জারি হয়েছে। খোঁড়াপিরের আস্তানায় হত্যে দেওয়া, মানত, আগরবাতি, পিদিম, কবরে মাথা ঠেকানো, জ্যৈষ্ঠের শেষ রবিবারে বৈকালিক মেলা–সবকিছু বন্ধ। পিরের খাদিম বা সেবক, যার মাথায় জটা ছিল, গেরুয়া কাপড় পরতেন, ঝাড়ফুক করতেন, মাদুলি দিতেন, বেগতিক দেখে সদর শহরে পালিয়ে গেছেন। গুজব রটেছিল, বদুমৌলানা একশো লোক নিয়ে থান ভাঙতে আসছেন। সদরে আবুতোরাব উকিলের মেয়ের কাঁধ থেকে হারামজাদা এক জিনকে ধরে জটাধারী খাদিম শিশিতে ভরেন এবং গঙ্গায় ফেলে দেন। কৃতজ্ঞ উকিল আদালতে তাঁর পক্ষ থেকে দরখাস্ত ঠুকেছেন নাকি। তা কুন। বদুমৌলনা গঙ্গা থেকে শিশিবন্দি জিনটাকে উদ্ধার করবেন। তারপর কী হবে বোঝাই যায়।