আপনি হাতি চেপে আসেননি কেন চাচাজি?
এখন যে আমি ছুটিতে।
আমাকে হাতিতে চাপাবেন?
নিশ্চয় চাপাবো।–
চৌধুরি আবদুল বারি ছিলেন এক আশ্চর্য মানুষ। জাফরাগঞ্জে নবাববাহাদুরের দেওয়ানখানায় একটা ঘরে থাকতেন। একেবারে একা মানুষ। মাঝে-মাঝে হঠাৎ কী খেয়ালে চলে আসতেন দূরসম্পর্কের আত্মীয়বাড়ি। দরিয়াবানুর স্বামী ছিলেন তাঁর কী সম্পর্কে ভাই। কয়েকটা দিন হুল্লোড় করে কাটিয়ে যেতেন মৌলাহাটে। সেবার এসে শফিকে তিনি পেয়ে বসেছিলেন। আর শফিও তাঁর প্রতি মনেপ্রাণে আকৃষ্ট হয়ে উঠেছিল।
পরদিন সকালেই মসজিদ থেকে শফিকে ডাকতে এল একটা লোক। শফি গিয়ে দেখেছিল, মসজিদের বারান্দায় গালিচা পেতে বসে আছেন তার আব্বা। একটু তফাতে মেঝেয় গ্রামের মুরুব্বিরা সসম্ভ্রমে বসে আছে। আর গালিচার একধারে বসে আছেন বারুমিয়াঁ।
শফি গিয়ে আসোলামু আলাইকুম বললে বদিউজ্জামান ইশারায় ছেলেকে বসতে বলেছিলেন। বারুমিয়াঁ মিটিমিটি হেসে বলেছিলেন, তোমার স্কুলের বন্দোবস্ত হয়ে গেছো শফি! আজই তোমাকে হরিণমারা নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিয়েছেন পিরসাহেব।
শফি তার আব্বার দিকে তাকাল। বদিউজ্জামানের হাতে জপমালা তসবিহ। ঠোঁট কাঁপছিল। তসবিহ জপা থামিয়ে মৃদুস্বরে বসেছিলেন, দেওয়ানসাহেব ঠিকই। বলছেন। আমার আপত্তি নেই। ইংরেজের খ্রীস্টানি এলেম কিছু জানা দরকার। তা না হলে ওদের জব্দ করা যাবে না। আমাদের সঙ্গে ইংরেজের জেহাদ এখনও খতম হয়নি।
শফি দেখল, বারমিয়াঁর ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটেছে। বারমিয়াঁ পরমুহূর্তে সেই ভাব লুকিয়ে বললেন, হুজুর পিরসাহেব! আপনি তো জানেন, নবিসাহেব স্বয়ং বলেছেন, এলেম বা বিদ্যাসংগ্রহের জন্য দরকার হলে চীন মুলুকেও যাও।
জি হাঁ। বদিউজ্জামান সমর্থন করলেন। তবে তার চেয়ে বড়ো কথা আমরা ওহাবি। ইংরেজ আমাদের দুশমন।
জানি হুজুর! বিনয় করে বললেন বারমিয়াঁ। সেজন্যই তো ইংরেজের বিদ্যা। শিখেও ইংরেজের চাকরি নিইনি। মুসলমানের খিদমত করছি।
বদিউজ্জামান বললেন, তবে আপনাদের নবাববাহাদুরটি ইংরেজের নফর। সেবার আমাকে তলব দিয়েছিলেন। আমি যাইনি। তাছাড়া ওঁরা হলেন-শিয়া। ওঁরা শয়তানখেদানো দোওয়া পড়েন। তা শোনো গো ছেলে, পড়তে চাও হরিণমারা হাইস্কুলে?
শফি বলেছিল, হুঁউ।
ঠিক আছে। আমিই কথা তুলব পিরসাহেবের কাছে।
বারুমিয়াঁ নদীর চড়ায় হাঁটতে-হাঁটতে কিছুদূর গিয়ে বলেছিলেন, ওই দেখো সূর্যাস্ত হচ্ছে! বড়ো সুন্দর, তাই না?
সূর্যাস্তের ব্যাপারটা সেই প্রথম সচেতনভাবে লক্ষ্য করেছিল শফি। তার মনে হয়েছিল, সত্যি তো! এমন একটা ব্যাপার রোজই ঘটছে; অথচ কেন তার চোখ পড়েনি? নদীর মাঝখানে একটা টিপি ছিল। টিপিটা ঘাসে ভরতি। সেখানে দুজনে উঠে গিয়েছিল। তারপর বারুমিয়াঁ তার হাত ধরে টেনে বলেছিলেন, এখন আর কথা নয়। চুপচাপ বসো। নাকি তুমি মগরেবের নমাজ পড়তে চাও?
বারুমিয়াঁর মুখে বাঁকা হাসি লক্ষ্য করেছিল শফি। কিন্তু আজ কে জানে কেন তার নমাজ পড়তে ইচ্ছে করছিল না। সে একটা আশ্চর্য অনুভূতিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। বিশাল মাঠের ওপর সূর্যাস্তের হালকা আলো নরম কুয়াশার মধ্যে মুছে যাচ্ছিল ক্রমশ। নদীর বুক বালির চড়ায় ভরা। একপাশে ঝিরঝিরে জলের একটা ফালি। বালির ওপর পাখিরা ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে। জনহীন মাঠের মাঝখানে সেই সময়টা তাকে পেয়ে বসছিল। তার মাথায় কোনো কথা আসছিল না। মগরেবের নমাজ পড়লে এই আচ্ছন্নতাটা সে কাটিয়ে উঠতে পারত হয়তো। অথচ সে-মুহূর্তে তার বারুমিয়াঁ হয়ে যেতেই ইচ্ছা। সূর্য যখন দিগন্তরেখা থেকে একেবারে মুছে গেল, তখন সে একটা চাপা শ্বাস ফেলেছিল।
বারুমিয়াঁ বলেছিলেন, কী গো? কথা বলছ না কেন?
শফি মৃদু হেসে বলেছিল, আপনিই তো কথা বলতে বারণ করলেন।
আচ্ছা! তার পিঠে সস্নেহে থাপ্পড় মেরেছিলেন বারুমিয়াঁ। …ননচারের কথা বলছিলাম তোমাকে। নেচার হল বাংলায় প্রকৃতি। এই প্রকৃতি জিনিসটা কী, এসব জায়গায় এসে বোঝা যায় না আমি নবাববাহাদুরের দেওয়ানি করি। হাতির পিঠে চেপে কাঁহা-কাঁহা মুল্লুক আমাকে ঘুরতে হয়। তো–
হাতির পিঠে?
হ্যাঁ। হাতির পিঠে। তো আগে কথাটা বলি। তো একবার মৌরিখোলার মাঠে যেতে-যেতে হাতিটা হঠাৎ খেপে গেল। মাহুত কিছুতেই সামলাতে পারে না। রাস্তা ছেড়ে হাতি আমাকে নিয়ে চলল মাঠের ওপর দিয়ে। বেগতিক দেখে হাওদা থেকে লাফ দিয়ে পড়লাম। হাতি তো চলে গেল মাহুতকে নিয়ে। আমি হাঁটতে-হাঁটতে গিয়ে দেখি এমনি এক নদী। কী ভালো যে লাগল!
তারপর?
বারুমিয়াঁ হাসলেন। –হাতিটা সামনের গায়ে গিয়ে ততক্ষণে হুলুস্থুল বাধিয়েছে। আমি পরে সেখানে গিয়ে সব শুনলাম। মাহুতকে পিঠ থেকে ফেলে। দিয়েছে। তার অবস্থা আধমরা। ভাগ্যিস, সেই গাঁয়ে ছিল এক জমিদারবাড়ি। তাঁদের বন্দুক ছিল। বন্দুকের আওয়াজ করে হাতিটাকে গ্রামছাড়া করা হল। সেখানেই রাতে থাকলাম। খবর পাঠালাম সদরে। দুদিন পরে একটা মাদি হাতি এল নবাবের বলেন, হজরত আলিরই নাকি পয়গম্বরী পাওনা ছিল। ফেরেশতা জিব্রাইল ভুল করে– তওবা, তওবা! ওসব কথা মুখে আনাও পাপ।
কিছুক্ষণ পরে বাইরে বেরিয়ে বারুমিয়াঁ শফির কাঁধে হাত রেখে চাপা হেসে বললেন, যাক গে। আমার সবিশেষ পরিচয় পিরসাহেব পাননি। পাওয়ার আগেই তোমাকে নিয়ে ভরতি কবে তো দিয়ে আসি। চলো, আজ রোজিদের বাড়ি দুমুঠো খেয়ে নেবে। যাবার সময় আম্মাকে বলে আসবে।