রোজি বলল, তোমার কথা বলেছি চাচাজিকে। রুকু, খবর দিয়ে আয় না রে শফি এসেছে।
রুকু চলে গেল খবর দিতে। দরিয়াবানু অন্যঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটা রোগাটে চেহারার লোককে তম্বি করছিলেন। শফির দিকে ঘুরে বললেন, কী গো ছেলে! আজকাল আসাই যে ছেড়ে দিয়েছ। বিবিজি বলছিলেন, খালি টো-টো করে কোথা-কোথা ঘুরে বেড়াচ্ছ। পিরসাহেব ঘরসংসারে মন দিচ্ছেন না বলে তুমি পর মেলে দিয়েছ!
দরিয়াবানু হাসতে লাগলেন। রোগাটে লোকটি এই সুযোগে তার কোনো কথাটা আবার তোলার চেষ্টা করল। অমনি দরিয়াবানু চোখ কটমটিয়ে বললেন, বেরো মুখপোড়া বাড়ি থেকে। দুবিঘে মাটিতে দুবিশ ধান ফলাতে পারিস না। আবার বড়ো বড়ো কথা! এবার ও জমি চষবে কাজিডাঙার মধু। তাকে কথা দিয়েছি।
সেই বয়সে সবকিছুতে শফির কৌতূহল ছিল তীব্র। কিন্তু ব্যাপারটা তলিয়ে বোঝবার আগেই চটির শব্দ তুলে বাইরে থেকে রোজি-রুকুর সেই বারুচাচাজি এসে বললেন, কই গো? কোথায় তোমাদের পিরসাহেবের ছেলে?
দুই বোন ইশারায় শফিকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল কপালে হাত ঠেকিয়ে আদাব দিতে হবে। কিন্তু শফির পিতার শিক্ষা, আল্লাহ ছাড়া কারুর উদ্দেশে কপালে হাত ঠেকানো বারণ। সে আস্তে বলল, আসোলামু আলাইকুম!
বারুমিয়াঁ হো হো করে হেসে উঠলে। একেবারে খুদে মৌলানা যে গো? কী নাম তোমার?
রুকু বলে দিল, শফিউজ্জামান।
রোজি বলল, আমরা শফি বলি।
বারমিয়াঁ বললেন, এসো এসো। তোমার সঙ্গে গল্প করি। বারান্দায় এসো।
শফি সংকোচ করছে দেখে নিচে নেমে এলেন বারুমিয়াঁ। হাসতে-হাসতে বললেন, আমার নাম চৌধুরি আবদুল বারি। খুব নাছোড়বান্দা লোক, বাবাজীবন! এসো, তোমার সঙ্গে বাতচিত করে দেখি তুমি কতটা লায়েক হয়েছ।
দরিয়াবানু ঘোমটা টেনেছিলেন মাথায়। জিভ কেটে বললেন, হল তো? এবার পিরসাহেবের ছেলের মাথায় বোত-পরস্তি ঢুকিয়ে দেবেন ভাইজান।
বারুমিয়াঁ বললেন, তোমরা আমাকে কী ভাবো বলো তোদরিয়া খাতুন? ওগো ছেলে, মেয়েদের কথায় কান দিয়ো না। এসো।
বারুমিয়াঁর বগলে ছড়ি, হাতে কী একটা বই। দলিজঘরের ভেতর দিয়ে শফিকে বাইরে নিয়ে গেলেন। বাইরের বারান্দায় একটা তত্তাপোশ ছিল। শফিকে টেনে সেখানে বসিয়ে নিজে পাশে বসলেন। তারপর বললেন, তারপর শফিউজ্জামান। লেখাপড়া কদুর হল?
শফি মৃদুস্বরে বলল, ফোর্থ ক্লাসে পড়ছিলাম।
কোন স্কুলে?
খয়রাডাঙায়।
হুঁ। তারপর এখানে এসে সময় নষ্ট করছ? আব্বাসাহেবকে বলোনি পড়ার কথা?
শফি চুপ করে রইল। তার ভবিষ্যৎ তার পিতার হাতে এটাই সে জেনে এসেছে এতদিন।
বারুমিয়াঁ বললেন, পিরমৌলানারা বুজুর্গ সাধকপুরুষ। তাঁদের লাইন আলাদা। অথচ তোমাকে ইংরেজি পড়তে দিয়েছিলেন। দিয়েও খেয়াল নেই যে বছর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন গো? মাত্র দুক্রোশ দূরে হরিণমারায় হাইস্কুল আছে। রোজ যাতায়াত
করতে পার, ওখানে কারুর বাড়ি থাকার ব্যবস্থা করা শক্ত না। আজই পিরসাহেবের কাছে কথাটা তুলব।
বলেই ফিক করে হাসলেন বারুমিয়াঁ।–তবে খোলাখুলি বলছি বাপু, আমার ওসব পিরবুজুর্গে বিশ্বাস নেই। তুমি নাস্তিক মানে বোঝো?
শফি তাকাল।
নাস্তিক মানে যার আল্লাখখাদায় বিশ্বাস নেই। আমি তোমাদের ওসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি না। আল্লাখোদা বলে কোথাও কিছু নেই। মানুষ হল নেচারের সৃষ্টি। নেচার বোবো তো?
শফি এমন উদ্ভট কথা কখনও শোনেনি। সে বিব্রতভাবে এদিকে-ওদিকে তাকাচ্ছিল। দরজায় দুই বোন উঁকি দিচ্ছিল। তাদের মুখ যেন শাদা হয়ে গেছে। জেনেশুনে শফিকে বারুচাচাজির কাছে ঠেলে দিয়ে তারা বড়ো অপরাধী যেন।
বারুমিয়াঁ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো ছেলে! দুজনে একচকর নদী অব্দি ঘুরে আসি। তোমার মুখে বাপু কী যেন জাদু মাখানো আছে। দেখে বড়ো আপন মনে হয়।
শফি হয়তো তর্ক করবার জন্যই সেদিন বারুমিয়াঁর বৈকালিক ভ্রমণের সঙ্গী হয়েছিল। অথচ লোকটিকে তার হঠাৎ খুব ভালো লেগে গিয়েছিল। অনেক পরে শফির মনে হত, পৃথিবীতে কোনো-কোনো লোক আছে– তাকে কেন যেন ভীষণ চেনা মনে হয়। মনে হয় তার সবকিছুই লোকটির জানা। অসহায়ভাবে ধরা পড়ে যেতে হয় তার কাছে। অথবা আত্মসমর্পণ করতে হয় অগাধ বিশ্বাসে।
বাদশাহি সড়কে যেতে-যেতে বারুমিয়াঁ অনর্গল তাকে যা সব বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন, তা শফি তার স্কুলের বইতে পড়েছে। পড়তে হয় বলেই পড়েছে। কিন্তু মন দিয়ে গ্রহণ করেনি। সে দিন মাস ঋতুর চক্র, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, নক্ষত্রমণ্ডলীকে জানে আল্লার রাজ্যের হুকুমদারিতে গাঁথা। এক ফেরেশতা সূর্যকে টানতে-টানতে পৃথিবীর আকাশ পার করে নিয়ে যান। আরেক ফেরেশতা চাঁদকে এমনি করে টেনে নিয়ে চলেন। সে জানে, মৃত্যুর সময় সাংঘাতিক ফেরেশতা আজরাইল এসে মানুষের প্রাণ ‘কবজা করেন। অথচ বারুমিয়াঁ বলছিলেন এমন সব কথা, যা এসবের একেবারে উলটো।
পিরের সাঁকোর কাছে গিয়ে বারুমিয়াঁ হাসতে-হাসতে বলেছিলেন, তোমার আব্বাকে এসব আবার বোলো না। পিরমৌলানারা এ বার চৌধুরিকে দেখলেই হাতিশালা থেকে। তখন মত্ত হাতিটা মাঠের পুকুরে গিয়ে পড়েছে। এদিকে গ্রাম একেবারে জনশূন্য।
তারপর কী হল চাচাজি?
মাদি হাতিটাকে দেখে বাহাদুর খাঁ– মানে আমার হাতিটার রাগ পড়ে গেল।
কেন চাচাজি?
বড়ো হও আরও, তখন বুঝবে। প্রকৃতিরই সে আরেক খেলা।