শফি বলত, যাচ্ছি।
কিন্তু তখন আয়মনি চাপা স্বরে আগের রা5ে মসজিদের মাথায় আলোর ছটা দেখার গল্প শুরু করেছে। মসজিদে বদুপিরের রাত্রিযাপনের পর গ্রামে এই ঘটনাটা রটে গিয়েছিল। রাত্রে নাকি জিনেরা আসে তাঁর সঙ্গে ধর্মালোচনা করতে। জিনেদের শরীরের সেই ছটা স্বচক্ষে দেখার মতো লোকের অভাব ঘটছিল না। ক্রমশ বদিউজ্জামানের বুজুর্গ সাধকখ্যাতি আরও মজবুত হয়ে উঠছিল জনমনে। হাটবারে লোকের মুখেমুখে এইসব কথা দূরে ছড়িয়ে যাচ্ছিল দিনেদিনে।
ইকরা বাঁশবনে বা খোঁড়াপিরের মাজারে কেন ঘুরে বেড়ায়, তার একটা ব্যাখ্যা ছিল। সে আসলে জড়িবুটি সংগ্রহ করে ওই জঙ্গল থেকে। সে ভিনগয়ে গিয়ে বউঝিদের কাছে ওইসব আজব জিনিস বেচে আসে। তার বদলে চালডাল হাঁসমুরগির ডিম পায়। কখনও পায় আনাজপাতি, একটা কুমড়ো বা দুটো বেগুন। তার কুঠো স্বামী আবদুল সারাদিন দাওয়ায় পড়ে থাকে আর খোনাস্বরে আপনমনে গান গায়।
একদিন শফি খোঁড়াপিরের মাজারে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রোজি-রুকুর প্রতি শাসন বেড়েছে বলে তারা আগের মতো হুট করে যেখানে-সেখানে বেরতে পারে না। শফি আসলে ডাইনি মেয়েটাকেই দেখতে গিয়েছিল।
কিন্তু কতক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও তাকে দেখতে পায়নি সে। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে বাঁশবনের শেষ দিকটায় চলে গিয়েছিল। সেই সময় কেয়াঝোঁপের আড়ালে একটা কুঁড়েঘর চোখে পড়েছিল তার।
ঘরটার অবস্থা জরাজীর্ণ। চাল ঝাঁঝরা। খড়ের ফাঁকে কোঙাপাতা গোঁজা। উঠোন ঘিরে পাঁচিল নেই। ঘন শেয়াকুলকাঁটার বেড়া। শফির কানে এল, থোনাস্বরে কেউ গোঁ-গোঁ করে গান গাইছে। তার বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল। সে ঝটপট একটা দোওয়াও আওড়ে ফেলল মনে-মনে। তারপর সাহস করে উঁকি মেরে দেখল দাওয়ায় নোংরা বিছানায় একটা কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্ত লোক চিত হয়ে শুয়ে আছে। তার চেহারাটি বীভৎস। হাত-পা কুঁকড়ে রয়েছে। ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে সে গান গাইছে দেখে শফি আবাক। এই তাহলে ইকরার স্বামী আবদুল।
একটু পরে আবদুল তাকে দেখতে পেয়ে গান থামাল। সেও কয়েক মুহূর্ত ভীষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল শফির দিকে। তারপর ভুতুড়ে গলায় বলে উঠল, কে বাপ তুমি?
শফি বলল, আমি পিরসায়েবের ছেলে।
আবদুল নড়বড় করে উঠে দেয়ালে হেলান দিল। তার কুৎসিত মুখে হাসি। সালাম বাপ, সালাম! আসেন, মেহেরবানি করে ভেতরে আসেন। আপনাকে একটুকুন দেখি।
বেড়াটা সরিয়ে শফি উঠোনে গেল। ছোট্ট পেয়ারাগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলল, তুমি আবদুল?
জি বাপ। আমিই সে। আবদুল তাকে দেখে প্রশংসা করতে থাকল। আহা হা! শুনেছিলাম বটে পিরসায়েবের বেটার কথা। কী নাক, কী মুখ, কী ছুরত বাপের আমার! দেখে মনে হয় কী, এ দুনিয়ার কেউ লয়কো। ও বাপ, আপনাকে দেখেই আমার শরীরের যন্তনা ঘুচে গেল গো!
সে হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। শফি বলল, তুমি কাঁদছ কেন আবদুল?
আবদুল বলল, মোনের সুখে বাপজি গো! কেউ তো আমাকে দেখতে আসে না। তাতে আপনি হলেন পিরসায়েবের বেটা! ও বাপ! আজ আবদুলের ঘরে আসমানের তারা ছিটকে এসেছে দিনদুপুরে। হায় হায়! এ মানুষকে আমি কোথা ঠাই দিই?
আবদুল বদুপিরের দোয়া চেয়ে ব্যর্থ। পিরসাহেব বলেছেন, আগে তার আউরতকে বোত-পরস্তি (পৌত্তলিকতা) ছাড়তে হবে। তাঁর কাছে তওবা করতে হবে। পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পড়তে হবে। তবেই তার মরদের ওপর তাঁর করুণা হবে। আবদুল সেইসব কথা বলতে থাকল দুঃখের সঙ্গে। শোনার পর শফি খুব গম্ভীর হয়ে বলল, আব্বাকে সে বলবে। অথচ শফি জানে, সে-ক্ষমতা তার আদতে নেই। তার মায়েরও নেই। আব্বার সঙ্গে কথাবার্তা বলাই তার পক্ষে একটা অসম্ভব ঘটনা। বদিউজ্জামানের সঙ্গে তার সে-সম্পর্ক এখনও স্থাপিত হয়নি। বড়ভাই নুরুজ্জামানের কথা অবশ্য আলাদা।
কিছুক্ষণ পরে শফি আবদুলের একটা কথা শুনে চমকে উঠেছিল। আবদুল নিজের হাতদুটো দেখতে-দেখতে বারবার বলছিল, বড়ো গোনা করেছিলাম এই হাতে। তারই ফল, বাপ!
কী গোনা, আবদুল? শফি জানতে চেয়েছিল।
জবাব আবদুল তাকে দেয়নি। শফি আর পীড়াপীড়ি করেনি। সে সারাক্ষণ শুধু ডাইনি মেয়েটাকে খুঁজছিল এদিক-ওদিক তাকিয়ে। কিন্তু মুখে জিগ্যেস করতে বাধছিল। একসময় সে আবদুলের একঘেয়ে বিরক্তিকর কাঁদুনি আর ভুতুড়ে কণ্ঠস্বরে অতিষ্ঠ হয়ে চলে এসেছিল।
এর কয়েকদিন পরে শফি রোজিদের বাড়ি গেছে, দলিজঘরের বারান্দায় একটা লোককে দেখতে পেল। লোকটি আরামকেদারায় বসে খয়রাডাঙার জমিদারসাহেবের মতো বই পড়ছিল। তার চেহারা দেখে শফির সন্দেহ হয়েছিল লোকটি কি হিন্দু? মুখে দাড়ি ছিল না। পরনে ধোপদুরস্ত পোশাক। পাশে একটা ছড়িও দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা। তার দিকে একবার তাকিয়েই লোকটি আবার বইয়ের পাতায় চোখ রাখল।
রোজিদের বাড়িতে শফির গতিবিধি ছিল অবাধ। সে আড়চোখে লোকটিকে দেখতে-দেখতে সদরদরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বারান্দায় দু-বোন দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। শফিকে দেখতে পেয়ে তারা পরস্পর অভ্যস্ত ভঙ্গিতে চোখ টেপাটিপি করল। তারপর রোজি একটু হেসে চাপা গলায় বলল, শফি, দলিজে কাউকে দেখতে পেলে না?
শফি মাথা নাড়ল। তখন রুকু বলল, বারুচাচাজি এসেছে। জানো? খুব শিক্ষিত লোক। ইংরেজি পাস। নবাববাহাদুরের কাছারির দেওয়ানসাহেব।