শফি ঘাড় গোঁজ করে খেতে থাকল। সাইদা আয়মনিকে তার দুষ্টুমির কথা বলতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে মসজিদ থেকে খবর এল, মৌলানা বদিউজ্জামান আজ রাতে মসজিদেই থাকবেন।
খবরটা শুনেই সাইদা চমকে উঠলেন।…
০৪. দেওয়ান সাহেবের আবির্ভাব
বদিউজ্জামান মাঝে-মাঝে মসজিদেই রাত্রিযাপন করতেন। সেইসব সময় তাঁকে দূরের মানুষ বলে মনে হত। এমনিতেই তাঁর চেহারায় সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বের ঝলমলানি ছিল। কিন্তু গাম্ভীর্য তাঁকে দিত এক অপার্থিব ব্যঞ্জনা। লোকেরা ভাবত, এ মানুষ এই ধুলোমাটির পৃথিবীর নয়। আর শফিও দূর থেকে মুগ্ধ চোখে তার পিতাকে লক্ষ করত। বদিউজ্জামান মৌলাহাটের প্রথম রাত্রিটি মসজিদে কাটানোর পর মায়ের হুকুমে সকালে তাঁকে দেখতে গিয়েছিল শফি। কিন্তু তিনি তাকে দেখেও যেন দেখলেন না। শিষ্যপরিবৃত মৌলানা মৃদুগম্ভীর স্বরে তাদের সঙ্গে কী আলোচনা করছিলেন। শফি একটু দাঁড়িয়ে থেকে মনমরা হয়ে চলে এসেছিল।
ওমরের বাড়িতে যখন শফিদের ঘরকন্না পাতা হল, তখনও বদিউজ্জামান মসজিদবাসী। সেখানেই আহার নিদ্রা, সেখানেই বাস। তবে ঘরকন্না গুছিয়ে তুলতে সাইদা পটু ছিলেন। দরিয়াবানুও ছিলেন তাঁর পাশে। কয়েকটি দিনেই গ্রামের প্রান্তে পোড়ো বাড়িটির চেহারা ফিরে গেল। বাড়ির খিড়কিতে ছিল একটি হাঁসচরা পুকুর। তার তিনপাড়ে বাঁশের বন। বাঁশের বনের শীর্ষে দেখা যেত খোঁড়া পিরের মাজারের প্রকাণ্ড বটগাছটির মাথা। এক দুপুরে চুপিচুপি রুকু ও রোজির প্ররোচনায় শফি সেই মাজারে গিয়েছিল।
রোজি তখন সেই তর্কটা তুলেছিল। কী শফি? থান থেকে ওই আধপয়সাটা তুলতে পারবে তো?
উঁচু ইটের জীর্ণ মাজার। আগাছা আর ঘাসে ঢাকা। তার নিচে একটা কালো পাথরের ওপর সেদিন মোটে একটা তামার আধপয়সা ছিল। শফি হাত বাড়াতে গেলে রুকু ভয় পেয়ে তার হাত চেপে ধরেছিল। রুকুর মুখে অদ্ভুত একটা যন্ত্রণার ছাপ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল শফি। তারপরই রোজির কুঞ্চিত চাহনির সামনে রুকু অপ্রস্তুত হয়েছিল শফির হাত ধরেছে বলে। হাত ছেড়ে দিয়েছিল সে।
মেয়েদের হাতের ছোঁয়া শফিকেও চমকে দিয়েছিল। বিশেষ করে রুকুর হাতের ছোঁয়া! তার মনে হয়েছিল, আরও কিছুক্ষণ হাতটা ধরে থাকল না কেন রুকু? সেই লোভেই আবার হাত বাড়াতে গিয়েছিল। কিন্তু তখন রোজি বোনকে একপাশে টেনে সরিয়ে নিয়ে গেছে। রোজির নাসারন্ধ্র স্ফীত। শফির এই সাহস দেখে সে মনে-মনে ক্ষুব্ধ। যদিও তর্কটা সেই তুলেছে।
শফি বুঝতে পেরেছিল, সে তামার আধপয়সাটায় সত্যি-সত্যি হাত দিক, রোজি এটা চায় না। কিন্তু যে ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে, তাকে একটা চরম পরিণতি দেওয়ার জন্য জেদ তাকে পেয়ে বসলেও সেই মুহূর্তে বাইরে থেকে বাধা এল।
মাজারের অন্যদিকে থেকে বেরিয়ে এল একটা যুবতী। তার হাতে একটা কাটারি। সে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। দুই বোনই তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়েছিল। তারা হাসবার চেষ্টা করছিল। মেয়েটি ভুরু কুঁচকে শফিকে দেখে বলল, এ বুঝি তোমাদের পিরসায়েবের ছেলে?
রোজি-রুকু মাথাটা নেড়েই শফিকে অবাক করে দৌড়ে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে পালিয়ে গেল। শফি ক্ষুব্ধভাবে তাদের দেখেছিল। মেয়েটি বলল, কী ভাই? নাম কী তোমার?
শফি মৃদুস্বরে বলল, শফিউজ্জামান।
বড্ড খটোমটো নাম! মেয়েটি হাসতে লাগল। এখানে কী করছিলে তোমরা?
শফি বলল, পিরের থানের পয়সা নিলে নাকি হাত পুড়ে যায়, তাই দেখতে এসেছিলাম।
মেয়েটি দ্রুত চোখ ফেরাল সেই কালো পাথরটার দিকে। তারপর পয়সাটা দেখামাত্র ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে আঁচলের খুঁটে বেঁধে ফেলল। তার মুখে দুষ্টুমির হাসি। চাপা গলায় বলল, কাউকে বোলো না যেন পিরসায়েবের ছেলে। কিরে দিলাম।
এই মেয়েটি যে কুষ্ঠরোগী আবদুলের বউ, সেটা পরে জেনেছিল শফি। আবদুলের বউ-এর নাম ইকরা। কেউ-কেউ তাকে ইকরাতন বলেও ডাকত। যেদিন মজলিশে তার বিচারের জন্য ডাক পড়েছিল, সেদিন শফি শুনেছিল, তাকে ইকরাতন বিবি বলে ডাকা হচ্ছে। তবে সেকথা অনেক পরের। সেদিন খোঁড়াপরের মাজারে ইকরাকে খুব ভাল লেগেছিল শফির। ফিরে গিয়ে রোজি-রুকুর কাছে তার থান থেকে পয়সা নেওয়ার ঘটনাটা দিয়ে বর্ণনা করেছিল। ইকরার হাত তো পুড়ে যায়নি।
রোজি বলেছিল ইকরা যে ডাইনি। আয়মনিখালার কাছে শুনো। ইকরা রাতদুপুরে গাছ চালিয়ে নিয়ে কোন্ দেশে চলে যায়। আবার ফিরে আসে ভোরবেলা আজানের আগে।
কোন্ গাছটা চালিয়ে নিয়ে যায়, সেটাও দূর থেকে দেখিয়ে দিয়েছিল রোজি। ইকরাদের বাড়ির পেছনে ঘরের চাল ঘেঁষে একটা লম্বাটে শ্যাওড়াগাছ আছে। নিশুতি রাতে ইকরা উলঙ্গ হয়ে চুল এলিয়ে সেই গাছটাতে চড়ে বসে। মন্তর পড়ে। আর গাছটা মূলছাড়া হয়ে আসমানে উঠে যায়। তারপর শুন্যে ভাসতে ভাসতে চলে কোন্ অজানা দেশে।
শফি প্রথম-প্রথম হেসে উড়িয়ে দিত। পরে তার আবছা মনে হত, হয়তো ব্যাপারটা সত্যি। জিন যখন আছে, তখন ডাইনিও থাকতে পারে। এক অভূত রোমাঞ্চ অনুভব করত সে। ইকরার দিকে তার মন পড়ে থাকত।
খিড়কির ঘাটের মাথায় বসে দুই বোন শফিকে ডাইনির গল্প শোনাত। ঘাটে সাইদা আপনমনে কাপড় কাঁচতেন। পুকুরটা গ্রামের শেষে বলে একেবারে খা-খাঁ। পুরুষেরা পিরপরিবারের খাতিরে পুকুরের কাছাকাছি কেউ পারতপক্ষে আসত না। বাঁশ কাটার দরকার হলে আগাম জানিয়ে রাখত। দৈবাৎ কেউ এসে পড়লে জোরে কেশে বা গলা ঝেড়ে সাড়া দিত। আর ঘাটের আসরে কোনো-কোনোদিন এসে যোগ দিত আয়মনিও। তখন আয়মনিই কথক। এরা তিনজন শ্রোতা। কাপড় কাঁচতে-কাঁচতে মুখ ঘুরিয়ে সাইদা বলতেন, অ শফি! তুই এখনও বসে আছিস? তোকে বললাম না কাজেমের দোকানে বলে আয়?