মেয়েটি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেছিল, মানত দিচ্ছি।
তুমি কোথায় থাকো? কী নাম?
ক্যানে? নামে আপনার কী দরকার?
তুমি মুসলমান, না হিন্দু?
মেয়েটি বেজায় তেজী। বলেছিল, যাই হই, তাতে আপনার কী?
বদিউজ্জামান তার স্পর্ধায় অবাক। দেখলেন, সে স্তম্ভের গোড়ায় একটা পিদিম জ্বেলে দিল। কয়েকটা খুদে মাটির ঘোড়া রাখল। তারপর মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করল। তার প্রণামের ভঙ্গি দেখে বদিউজ্জামানের মনে হল, মেয়েটি নিশ্চয় হিন্দু। তাই আর তার সঙ্গে কথা বললেন না। অন্যদিকে ঘুরে দাঁড়ালেন।
প্রণাম শেষ করে মেয়েটি আবার নদীর দিকে গেল। নদীতে তত জল নেই। বালির চড়ার মধ্যে একহাঁটু জল বয়ে যাচ্ছে। সেই জলে সে পা ছড়িয়ে বসে আপন মনে জল নিয়ে খেলতে থাকল। মেয়েটির বয়স কুড়ি-বাইশের মধ্যে। তার সিঁথিতে সিঁদুর নেই দেখে মৌলনা বদিউজ্জামান তাকে অবিবাহিতা ভাবলেন। একটু পরে সে তার পাশ দিয়ে চলে গেলে তিনি লক্ষ্য করলেন, মৌলাহাটের দিকেই চলেছে। মৌলাহাটে কি হিন্দু আছে?
সে বাদশাহি সড়কে পৌছুঁলে বদিউজ্জামান সেই স্তম্ভটার কাছে গেলেন। চটিজুতোর ডগা দিয়ে জ্বলন্ত পিদিমটা উলটে দিলেন। মাটির ঘোড়াগুলোকে যথেচ্ছ লাথি মারলেন। তারপর স্তম্ভের গায়ে সিঁদুরের ছোপ চোখে পড়ল। সেখানে জুতো ঘষে তবে তাঁর রাগ পড়ল। স্তম্ভটা ভেঙে ফেলার কথা ভাবতে ভাবতে গ্রামের দিকে পা বাড়ালেন বদিউজ্জামান।
তখন তিনি মৌলাহাটে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্তে স্থির। মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছলে অসিমুদ্দিন এবং আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে তাঁকে অভ্যর্থনা করল। বদিউজ্জামান মৃদুস্বরে মৌলাহাটের একজনকে জিগ্যেস করলেন, ওই সাঁকোর থামে হিন্দুরা পুজো করে নাকি?
জি, মোছলমানেরাও মানত-টানত করে।
একটু আগে একজন জেনানকে দেখলাম পুজো করছে। এ গায়ে হিন্দু আছে নাকি?
জি হুজুর, কয়েকঘর বাউরি আছে। বাদবাকি সব মোছলমান।
অন্য একজন একটু হেসে বলল, একটু আগে ভিজে কাপড়ে গেল তো? হুজুর, ও হল আবদুলের বউ।
স্তম্ভিত বদিউজ্জামান বললেন, কী?
জি হুজুর। খুব হারামজাদি মেয়ে। বড়-ছোটো মানে না। এমন ওর তেজ।
আবদুল কোথায়? ডাকো তাকে।
অপর একজন বলল, আবদুল হুজুর চলাফেরা করতে পারে না। কুবরাগী।
কাজিবাড়ির বড় কাজিসায়েব সন্ধ্যার নামাজে আসছিলেন। তাঁকে দেখে এগিয়ে গেলেন বদিউজ্জামান। মৌলাহাটের প্রধান মুরুব্বি বলতে তিনিই। পিরের সাঁকোর ব্যাপারটা তাঁর কাছেই তুলবেন মৌলানা।….
.
আকস্মিক বার্তা
সে রাতে রোজি-রুকুদের বাড়ি শফি যখন খেতে এসেছে, সাইদা বেগম বললেন, কোথায় ছিলি রে তুই? কতবার কতজনকে খবর পাঠালাম।
জবাব রুকু দিল।….ও তো আয়মনি খালার বাড়িতে ছিল। আমরা আবার গিয়ে ডেকে নিয়ে এলাম।
আয়মনি? সে কে?
কাসেমের বেটি। জানেন আম্মা? আয়মনি খালা স্বামীর বাড়ি–
রোজির চিমটি খেয়ে চুপ করে গেল বুকু। রোজি ফিসফিস করে বলল, এসেছে। আম্মার কাছে গল্প করছে।
দরিয়াবানু ওরফে দরিবিবি ডাকছিলেন মেয়েদের। দুজনে চলে গেলে সাইদা ছেলের পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জিগ্যেস করলেন, দুপুরে খেলি কোথায়?
আয়মনিখালার বাড়িতে।
হাসলেন সাইদা।…খালা পাতিয়ে ফেলেছিস এরি মধ্যে?
শফি আস্তে বলল, আব্বা কী ঠিক করলেন জানেন আম্মা?
মুখ নামিয়ে আঙুল খুঁটতে-খুঁটতে সাইদা বললেন, সেকেচ্ছা যাওয়া হবে না। দরি-আপা বলছিল, মসজিদে মগরেবের নমাজের সময় কথা হয়েছে। একটা খালি বাড়ি আছে নাকি।
দুইবোন তাপোশে খাওয়ার জন্য দস্তরখান নিয়ে এল। বিছিয়ে দিয়ে চলে গেলে সাইদা চাপা স্বরে বললেন, নুরুর বাড়ি আসার কথা ছিল। খয়রাডাঙায় গেলে দেখবে আমরা চলে এসেছি। ও যদি সেকেড্ডা চলে যায়, হয়রান হবে!
শফি বলল,বড় ভাই আসবে নাকি?
আসবে। তুই জানিস না?
আমাকে বলেছ? বলো কোনো কথা?
সাইদা ছেলেকে একটু টেনে আদর দিতে-দিতে বললেন, ওদিন নকি মৌলবি এলেন দেওবন্দ শরিফ থেকে। ওনার হাতে খত ভেজেছিল নুরু। দেওবন্দ কি। এখানে? রেলগাড়ি, স্টিমার, তারপর ঘোড়ার গাড়ি। দশটা দিনের রাস্তা। তবে এবার নুরু এলে আর ওকে যেতে দেব না। তোর আব্বা যা করেন, করবেন।
আয়মনি এল। মুখ টিপে হেসে বলল, বিবিজি, সালাম! আপনার ছেলে বড় লক্ষি । কতকথা হল সারাবেলা। মনে হয় যেন কতকালের মায়ের পেটের ভাই। তো বলে কী, আম্মাও রোজি-রুকুর মতো তোমাকে খালা (মাসি) বলব। বেশ, তাই বলল– মন যদি চায়।
সাইদা আয়মনিকে দেখছিলেন। একটু পরে বললেন, খোকা-খুকু কটা গো মেয়ে?
জি? খোকাখুকু? আয়মনি মুখে আঁচল চাপা দিল হাসির চোটে।
রোজি-রুকু খাঞ্চা বোঝাই করে পোলাওয়ের থালা, কোর্মার বাটি এনে রাখল। রুকুর কানে কথাটা গিয়েছিল। বলল, আয়মনিখালার খোকা-খুকু কিছু নেই জানেন আম্মা? কেন নেই ওকে জিগ্যেস করুন না।
সাইদা জিগ্যেস করলেন, কেন গো মেয়ে?
আয়মনির মুখটা লাল হয়ে উঠেছিল। মুখে হাসি এনে বলল, সেসব দুঃখের কথা একদিন বলব বিবিজি। ছেলের সামনে ওসব কথা থাক। রোজি-রুকু, বড্ড বেশরম পু তোমরা।
দুই বোন ওকে ভেংচি কেটে চলে গেল। শফি উজ্জ্বল মুখে বলল, খালা! আমরা সত্যি তোমাদের গায়ে থেকে গেলাম, জানো?
থাকবে বৈকি! তুমি এত ভালো ছেলে! তোমাকে কি যেতে দিতাম ভাবছ? সাইদা একটু হেসে বললেন, কে ভালো ছেলে? শফি? চেনো না তো৷ দেখবে।