দিলরুখ বেগমের মৃতদেহ তার প্রতিবন্ধী স্বামীর কবরের দক্ষিণে, পায়ের দিকে কবর দেওয়া হয়েছিল, কচির ইচ্ছা অনুসারেই। বৃদ্ধ বিশ্বাসী শেষাবধি উপস্থিত ছিলেন। কবর হতে বেলা পড়ে যায়। লোকসকল যখন প্রথা অনুযায়ী কবরের দিকে আর পিছু না ফিরে চলে যাচ্ছে, তখন বৃদ্ধ খোকার কাঁধে হাত রেখে আস্তে বলেন, আমি জালালুদ্দিন। খোক অবাক হয়ে তাঁকে দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ কাতর একটু হেসে পুনঃ বলেন, হুজুর আমার হাতেই তোমার মাকে তালিমের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। তোমার মা জুলেখা বেগম–
খোকা দ্রুত শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলে, শুনেছি।
লোকসকল ততক্ষণে মাজার এলাকা থেকে সড়কে পৌঁছেছে। একদা যেখানে এবাদতখানার ফটক ছিল, সেখানে ধ্বংসস্তূপের কেন্দ্র থেকে একটি প্রকাণ্ড কাঠমল্লিকার ।গাছ মাথা তুলেছে। বৃদ্ধ জালালুদ্দিন সহসা খোকার দুটি হাত চেপে ধরে বলেন, আমাকে মাপ করো। আমি এক গোনাহগার।
তাঁর চোখে জল ছিল। তিনি আত্মসম্বরণের চেষ্টা করছিলেন। বিস্মিত খোকা বলে, একথা কেন?
জালালুদ্দিন বলেন, আমার মনে পাপ ছিল। তোমার ছোটদাদাজি শফিউজ্জামান এক রাত্রে মৌলাহাট এসেছিলেন। এতিমখানায় আমার ঘরে তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলাম। তিনি হুজুরের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু হুজুর তখন এই এবাদতখানায় ইন্তেকাফে’, দেখা হওয়া অসম্ভব ছিল। কিন্তু আমার খুব ভয় হয়েছিল শফিসাহেবকে দেখে। জালালুদ্দিন কান্নাজড়িত স্বরে বলেন, জানতাম উনি এক খুনী মানুষ। তাঁর নামে হুলিয়া ছিল। আমি পুলিশে খবর দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে দিই। ভেবেছিলাম, হুজুরের কোনও ক্ষতি করতেই এসেছেন।
খোকা তাঁকে আঘাতের জন্য হাত তুলেই নামিয়ে নেয়। তারপর দ্রুত চলে যায়। জালালুদ্দিন তাকে ডাকছিলেন, আরও কিছু বলার কথা ছিল, কিন্তু খোকা পিছু ফেরে না। বৃদ্ধ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে পা বাড়াল। সন্ধ্যার বাসে বহরমপুর, তারপর ট্রেনে রানাঘাট হয়ে তিনি কুষ্টিয়া যাবেন। সেখানে তাঁর একটি বড় সংসার আছে। বহু বছর পরে তিনি হুজুরের মাজার দর্শনে এসেছিলেন। হুজুরকে তিনি স্বপ্নে দেখেছিলেন এবং তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়েন। বিশেষ কথা, তাঁর কাছে পাশপোর্ট-ভিসা ছিল না। তাই এই সফরটিও ছিল অত্যন্ত গোপনীয়।