“পবিত্র কেতাবে বর্ণিত আছে জে, এইপ্রকার গোনাহে সাদ ও গোমরাহ নামক দুইটি শহর খোদা জ্বালাইয়া দেন। আমি সেই গোনাহ করিয়াছি সন্দেহ হয়। নাকি নিতান্ত মানসিক ভ্ৰম?…..
“পরদিবস হইতে এবাদতখানায় ইত্তেকাফ হইলাম। সাইদা বিস্মিত হইয়াছিল কি? জানিতে পারি নাই। কালো মশারির ভিতর আত্মগোপন করিয়া রহিলাম। পার্শ্বে সাইদা বা অন্য কেহ আসিয়া খাবার রাখিয়া যাইত। খাইতে পারিতাম না। দুনিয়া আঁধারে ঢাকিয়া যাইতেছিল।……
“কালো মশারির ভিতরে গোপনে ক্রন্দন করিতাম। আমার জন্য এক্ষণে মউত বরাদ্দ হউক। কারণ জিন্দেগীতে খোকা সৃষ্টি হইলে উহা নিদারুণ ক্ষতস্বরুপ। এক্ষেত্রে মউতই নিষ্কৃতি…
.
জেলা সমাচার পত্রিকার সম্পাদকীয়
“এ হে হরিষে বিষাদ হইল দেখিতেছি! পূর্বসংখ্যায় আমরা আহ্লাদিত হইয়া পাঠকদিগের জানাইয়াছিলাম যে, কুখ্যাত নরঘাতক দস্যু ছফিজামান ওরফে ছবিলালের ফাঁসির দণ্ড মহামান্য হাইকোর্টে বহাল করিয়াছেন এবং নির্লজ্জ কতিপয় চক্রান্তকারীর সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হইয়াছে। গতকল্য নরাধমের ফাঁসিরূপ পুণ্যকর্ম ঘটিলে আমরা আনন্দসম্বাদ দিবার নিমিত্ত লেখনী ধারণ করি। কিন্তু ভয়ানক পরিতাপের বিষয়, নগরীর রাজপথে এ কী অদ্ভুত দৃশ্য আমাদিগের দেখিতে বাধ্য করা হইল? দেশে শাসনের নামে দুঃশাসন চলিতেছে; অথবা শাসকবৃন্দের কুম্ভকর্ণদশা ঘটিয়াছে; নতুবা ইহা সম্ভব হইত না। আমরা বিলক্ষণ অবগত আছি যে ওই ছবিলাল বিস্তর কিংবদন্তীর নায়করূপে নিজেকে গ্রাম্য নিরক্ষরদিগের আদিম মানসে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল। ইহাও সত্য হওয়া সম্ভব যে, সে জাদুবিদ্যায় পারদর্শী ছিল। তাই বলিয়া ছবিলালের ঘৃণ্য শবদেহে পুষ্পসজ্জা, শোভাযাত্রা, বিবিধ ধ্বনি নির্ঘোষ প্রভৃতি ঘটনা কল্পনাও কবি নাই। বহুদূর গ্রামাঞ্চল হইতে চাষাভুষা বন্যপ্রকৃতির লোকসকল আসিয়া এই নগরীতে সমবেত হইল। তাহাদিগের সঙ্গে বহু তথা কথিত শিক্ষিত (?) ভদ্রলোকবেশী কতিপয় ব্যক্তিকেও দেখা গিয়াছে। আরও দুঃখ ও ঘৃণার কথা, শবদেহের উপর পুষ্প এবং খৈ নিক্ষিপ্ত হইতেছিল। আমরা উলুধ্বনি ও শঙ্খনাদও শুনিয়াছি বলিয়া ভ্রম হয়। অবলা নির্বোধ স্ত্রীলোকেরা কাহাদের প্ররোচনায় কুখ্যাত নবঘাতককে বীর বলিয়া গণ্য করিল, ইহা বুঝা কঠিন। ইহার মধ্যে মীরজাফর-জয়চাঁদদিগের তৎপরতা অনুমান কৰা যায়। আশ্চৰ্য্য এমন কথাও কেহ-কেহ রটাইতেছে যে, ছবিলালের শবদেহ জীবিত ব্যক্তির ন্যায় কোনও কোনও স্থলে উঠিয়া দাঁড়ায় এবং মৃদুহাস্যে অভ্যর্থনাগুলিন গ্রহণ করে। দেশে গাঁজাখোরদের সংখ্যাধিক্য ঘটিয়াছে বটে! তবে আরও মর্মান্তিক দৃশ্য অবলোকন করিয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়াছি। পুলিশবৃন্দ চিত্রার্পিত বৃক্ষবৎ দণ্ডায়মান ছিল। মাননীয় কালেক্টর বাহাদুরকে আমরা জিজ্ঞাসা করি, এইরূপ মতিচ্ছন্ন দশার কারণ কী? আমরা শুনিয়াছি, দস্যু ছবিলালের পিতা নাকি মৌলাহাট গ্রামের একজন মুসলমান ধর্মগুরু পীর ব্যক্তি ছিলেন এবং তিনিও নাকি বিস্তর কেরামতি দেখাইতে সমর্থ ছিলেন। সেইহেতু অনুমান করা চলে, তাঁহারই প্রভাবে প্রভাবিত শিষ্যগণ এই দুষ্কর্মের আয়োজন করিয়া থাকিবে। ইহা ছাড়া ঘটনার ভিন্ন ব্যাখ্যা হয় না। ধর্মগুরু পীর এক্ষণে জীবিত নহেন শুনিয়াছি। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ে তাঁহার প্রভাব ছিল। তবে তাঁহাকে ধন্যবাদ দেওয়া চলে যে, তিনি তাঁহার দস পুত্রকে মৃত গণ্য করিয়াছিলেন। এমন অবস্থায় আমরা ধন্দে পড়িয়াছি। যে দৃশ্য দেখিলাম, উহার প্রকৃতি হেতুগুলিন কী? পরবর্তী সম্বাদে এই রহস্য ফাঁস করিবার আশা রাখি। পাঠকবৃন্দকে অনুরোধ, তাঁহারা ধৈৰ্য্য ধরুন। শীঘ্রই দ ছবিলালের শবদেহ লইয়া পৈশাচিক শোভাযাত্রা এবং বিলাপের রহস্য-যবনিকা উন্মোচিত করিব বলিয়া আমরা প্রতিশ্রুতি বদ্ধ রহিলাম।……’
In strange and hidden places thou dost move
Where women cry for torture in their love.
Satan! at last take pity on our pain.
-Baudelaire
বৃদ্ধা দিলরুখ বেগমের আজকাল হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। নাতনি কচির বকাঝকায় পাতাকুড়ুনি স্বভাবটি ছাড়তে হয়েছে। অথচ শশুর-হজরতের এবাদতখানার ধ্বংসস্তূপ ও জঙ্গলটিতে তিনি প্রতিদিনই দুপুরবেলা চুপিচুপি যান। নির্জনে বসে থাকেন একটুকরো লাইমকংক্রিটের চাঙড়ের ওপর। পুকুরের বাঁধানো ঘাটটি ভেঙেচুরে জঙ্গল গজিয়েছে। সেদিকে তাকাতে তাঁর ভয় করে। জলের ভেতর একটা উলটো দুনিয়া আছে। সেই উলটো দুনিয়ার দিকে তাকালে হয়তো সেই উলটো মানুষটিকে দেখে ফেলবেন।
দিলরুখ বেগম জঙ্গলে ঢাকা ধ্বংসস্তূপটির দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর সামনে তার শ্বশুর-হজরতের কবর, যেটিকে মাজার’ বলে লোকেরা। মাজারের উত্তর শিয়রে সেই অজানা দীর্ঘ গাছটির দিকে তাকিয়ে তাঁর গা ছমছম করে। কচি বলেছিল, গাছটির গায়ে হাত রাখলে জ্যান্ত মনে হয়। হয়তো সত্যি। বৃদ্ধা মুখ নামিয়ে নিঃশব্দে কাঁদেন। এ কান্না অপরাধবোধে। ল্যাংড়া-ভ্যাংড়া এক মানুষ, ওই এবাদতখানায় একা পড়ে থাকতেন। এক সকালে তাকে মৃত দেখা গিয়েছিল। সেই মৃত্যু নিয়ে কত গুজব রটেছিল। হজরত পিরসাহেবকেও কালো মশারির ভেতরে একইভাবে মৃত দেখা গিয়েছিল এবং একইভাবে গুজব রটেছিল। কালো জিনের হাতে মৃত্যু। সত্যিই কি কালা জিনের মানুষকে বাগে পেলে মেরে ফেলে? তাহলে তাঁকে তারা মেরে ফেলছে না কেন? এভাবে তিনি একা এসে বসে থাকেন, সেই কালা জিনেরা তাঁকে মেরে ফেলুক এই ইচ্ছা নিয়ে। সহসা পূর্বের জঙ্গল থেকে এক দমক হাওয়া আসে। ঝরঝর করে পাতা খসে পড়ে শেষ শীতের গাছপালা থেকে। চমকে ওঠেন, ওরা কি আসছে তাহলে? হাওয়া থেমে যায়। আবার হঠাৎ শুকনো পাতায় খসখস শব্দ। ঘুরে দেখেন একটা কাঠবেড়ালি। অথচ কোনও-কোনও সময় এই জনহীন পারিপার্শ্বিকে ফিসফিস কথা শুনতে পান, কারা কিছু বলতে চায়, যে-ভাষা তিনি বোঝেন না সেই ভাষায়।