“রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন একটি আশ্চর্য্য ঘটনা ঘটিয়াছিল, এই স্থলে তাহার বিবরণ পেশ করিতেছি। কারণ আমার মনে সেই ঘটনাটি খোকা সৃষ্টি করিয়াছে। আর শয়তান সর্বত্র ওত পাতিয়া বেড়ায়। বনু আদমের জীবনের সমুদয় ক্ষেত্রে সে ফাঁদ পাতে।…..
“জোহরের নমাজের সময় শাদির মজলিশ বসিয়াছিল। মসজেদের ভিতর এবং বাহিরে কাতারে ইলাকার মোছলেমগণ দাওয়াত এবং বিনা-দাওয়াতেই হাজের ছিলেন। হরিণমারার হোটগাজি মইদুর রহমান সকল আয়োজনের তদারক করিতেছিলেন! বড়গাজি সইদুর রহমান তালে কলিকাতায় ছিলেন। খত লিখিয়া জানান জে, পরে আসিয়া দুলহা-দুলহিনের নজরানা পেশ করিবেন। প্রকৃত কথা। কী, এতিমখানার ওই খুবছুরত লড়কিকে যাঁহারা দেখিয়াছিলেন, তাঁহারাই তাহার প্রতি খোশ ছিলেন।…..
“শাদির সময় দুলহিন আনিসুর রহমানের বাড়িতে ছিল। তিনিই তাহার মুরুব্বিপদে বহাল, ফলে দুলহিনের এজিন (সম্মতি) লইবার নিমিত্ত উকিল ও দুইজন গাওয়াহ, (সাফ) তাঁহার বাড়ি রওনা হইয়াছেন। এমত সময়ে বাহিরে হল্লা শুনিতে পাইলাম। লোকসকল ধর ধর! মার মার।’–লিয়া চিৎকার করিতেছিল। কী হইয়াছে জানিতে চাহিলে ছোটগাজি বাহিরে গেলেন এবং কিয়ৎক্ষণ পরে ফিরিয়ে আসিয়া কহিলেন, এক বেশরা মস্তান জোর করিয়া মসজেদে ঢুকিতে চেষ্টা করে। লোকে তাহাকে ধাক্কা মারিতে মারিতে ভাগাইয়া দেয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, মস্তানটি রুণ ছিল বলিয়াই বোধ করি মারা পড়িয়াছে।….
“শুনিবামাত্র চমকিয়া উঠিলাম। দেলে আচানক ধাক্কা বাজিল। আমার মুখের চমক ছোটগাজিছাহেবের নজরে পড়িয়া থাকিবে। তিনি আমার পার্শ্বে বসিয়া অনুচ্চ স্বরে কহিলেন, কোনও প্রকার ঝামেলার ডর নাই। বাদশাহী শড়কে এইরূপ দৃশ্য অভাবিত নহে জে, কখনও-কখনও ফকিরমস্তান-হিন্দুসাধুদিগেরও লাস দেখা যায়। বিমার, পেরেন বিবিধ কারণে উহারা পথিমধ্যেই ইন্তেকাল করে। এই কথা বলিয়া ছোটগাজিছাহেব উচ্চহাস্য করিলেন। মজলিসের উদ্দেশে ফের কহিলেন, বেশরা মস্তান দেখিলেই হজরত তাহাদের ভাগাইয়া দিবার ফতোয়া জারি করেন নাই কি? মোছলেমবৃন্দ সমস্বরে সায় দিলেন।……
“শাদি চুকিয়া গেলে লোকসকল খানায় বসিল। সেই সময় ছোটগাজিছাহেবকে নিরাশায় ডাকিয়া পুছ করিলাম, মস্তানের লাস কোথায় পড়িয়া আছে, একবার দেখিতে ইচ্ছা করি। তিনি ঈষৎ বিস্মিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সম্ভবত মোজেজাদর্শনের ইচ্ছায় কহিলেন, হজরতের ইচ্ছা হইলে আপত্তি করি, সাধ্য কী? তবে মস্তানটি অর্ধ-নাঙ্গা! একটু অপেক্ষা করুন। লাসটি ঢাকা দিতে একটুকরা কাপড় সংগ্রহ করি। পশ্চাতে উহার নিকট যাইবেন।….
“হা খোদা! কাকে দেখিয়াছিলাম? কাপড় তুলিতে মুখখানি দেখামাত্র আমার মাথায় যেন বাজ পড়িল। সারা অজুদ শিহরিয়া উঠিল। অতি কষ্টে মনোভাব দমন করিলাম। ছোটগাজিছাহেব হয়ত ভাবিয়াছিলেন, লাসটিকে আমি জিন্দা করিব। তাঁহাকে হতাশ দেখাইতেছিল। মুখ ফিরাইয়া দাঁড়াইয়া আছি, আত্মসম্বরণ করিতেছি, ছোটগাজিছাহেব কহিলেন, বেশরা মস্তান রাত্রে এখানে পড়িয়া থাকিলে শৃগাল-কুকুরে ছিঁড়িয়া খাইবে। জবাবে কহিলাম, জন্মকালে উহার কানে নিশ্চিত আজান শোনানো হইয়াছিল। সেকারণে বেশরা হইলেও এ-ব্যক্তি মোছলেম গণ্য হইবেক। উহার দাফন কাফন করা কর্তব্য। ঘোটগাজিছাহেব ঘন মাথা নাড়িয়া আমার ফতোয়ায় সায়। দিলেন।…..।
“সেইদিন সন্ধ্যার মধ্যে শরা-ভ্ৰষ্ট বেচারা ফরিদ-উদ-জামান-এর লাসের দাফন কাফন হইল। শাদি-মহফিলের তাবৎ লোক লাসের জানাজায় সমবেত হইয়াছিল। তাহারা নিশ্চয়ই আমার এই ফতোয়ায় বিস্মিত হইয়াছে ভাবিয়া এশার নমাজে কৈফিয়ত দিব ভাবিলাম। কিন্তু মুখে কথা সরিতেছিল না। বেরাদানে এছলাম। সম্বোধন করিয়াই কান্না আসিল। তাহা দেখিয়া সকলেই ক্রন্দন করিতে লাগিল।
“রাত্রে চাঁদনী ছিল। এবাদতখানায় দাঁড়াইয়া আছি, সেইসময় দেখিলাম পুষ্করিণীর পানির উপর দিয়া একটি ছায়া হাঁটিয়া আসিতেছে! ঘাটের সোপানে উঠিয়া ছায়াটি হাওয়ার স্বরে কহিল, এইবার তুমি সত্যই বদি-উজ-জামান হইলে!…..
“কহিলাম, কেন একথা কহিতেছ?……
“সে কহিল, তুমি আলেম লোক। বদি কথার অর্থ জান না? বদি হইল পাপ। তুমি এতদিনে জমানার পাপ হইলে।
“কুদ্ধভাবে কহিলাম, আমার নাম ওয়াদি-উজ-জামান। জমানার (কালের) নদী। বাঙ্গালায় ওয়াদি বদিতে পরিণত হইয়াছে। ওয়াদি অর্থ নদী। আমার নামের অর্থ…..
“সে বাধা দিয়া পূর্ববৎ হাওয়ার স্বরে কহিল, খামোশ। তুমি কী করিয়াছ, জান না।….
“কী করিয়াছি, তুমিই বলল….
“ওই লড়কির দিকে তাকাইলেই বুঝিতে পারিবে। উহার চুল, উহার চক্ষু, উহার চাহনি…..
“এ কী বলিতেছ?….
“বদি-উজ-জামান! তুমি আজ হইতে জমানার বদি। তোমার জন্য সুনিশ্চিত দোজখ।
“আমি চিৎকার করিয়া উঠিলাম, ফরিদুজ্জামান! তুমি কি সেই কথা বলিবার নিমিত্ত শাদির মজলিশে ঢুকিতে গিয়েছিলে?….
“ছায়া হাওয়ার আওযাজে হাসিতে২ মিলাইয়া গেল। দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া বসিয়া পড়িলাম।…..
“ভাবিয়াছিলাম, সাইদাকে এই গোপন তত্ত্ব জানাই এবং রফিকুজ্জামানকে নির্দেশ জারি করিব জে, জুলেখাকে তালাক দিতে হইবে। কিন্তু ইহার জন্য কী কৈফিয়ত দিব খুঁজিয়া পাই নাই। রফিকুজ্জামান আমার হুকুম তামিল করিবে কি? যদি সে তাহা করে, সাইদা বাধা দিবে। সাইদা ওই লড়কিকে জান দিয়া রক্ষা করিবে। সাইদা আর সে-সাইদা নহে। অধিকন্তু এই গোপনীয় তত্ত্ব শুনিয়া সে আরও হিংস্র হইয়া কলঙ্ক বাধাইতে পারে।…..