তাহলে রত্নময়ীর সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতে ভয় কিসের, গোবিন্দবাবু?
ভয় তোমার জন্য নয়, তার জন্য। সে সত্যিই মানসিক বিকারগ্রস্তা। সেজন্য মনে হয়, একমাত্র ধর্মের আশ্রয় ছাড়া তার বিকার ঘুচবে না। কিন্তু সবে সে মন্দিরের সোপানে পা রেখেছে, তাকে কিন্তু ডেকো না, শফি!
শফি চুপ করে থাকল। গোবিন্দরাম খাঁটিয়ার তলা থেকে লণ্ঠন বের করলে সে বলল, থাক। আমি যাই।
কিছু খাও। একটু বিশ্রাম করো। রাত হলে যেও। বলে গোবিন্দলাল শলাইকাঠি হুকে লণ্ঠন জ্বেলে ঘরে ঢুকলেন। একটু পরে পাথরের থালায় ভিজে চিঁড়ে, গুড়, দুটি পাকা কলা নিয়ে এলেন। বলেন, রাতে আমি কিছু খাই না। তাই এগুলোই খাও!
শফির খিদে পেয়েছিল। দ্রুত খেয়ে ফেলল। ঘটি মুখের ওপর তুলে জল ঢেলে দিল গলায়, যা মুসলমানরা অনভ্যাসে পারে না। কিন্তু সে হিন্দু জীবনে অভ্যস্ত। আঁচিয়ে এল উঠোনের কোণে। কিন্তু গোবিন্দরাম তাকে থালাটি ধুতে দিলেন না। শফি মৃদু হেসে বলল, ব্রহ্মপুর আশ্রমে আমরা যে যার থালা ধুয়ে রাখতাম!
গোবিন্দলাল বললেন, তোমার পক্ষে দরখাস্তে হৃদয়লাল শাস্ত্রী স্বাক্ষর দেননি। জান? দেববাবু তো কলকাতায় থাকেন। শুধু মাঘোৎসবে আসেন! তবে উদ্দেশ্য খাজনা আদায়।
শফি বলল, কিসের দরখাস্ত?
তুমি জান না? বারি চৌধুরি উকিল, জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান গাজিসাহেব, হরিণমারার জমিদার বিজয়েন্দুবাবু, আরও অনেক লোক তোমার নির্বাসনদণ্ড প্রত্যাহারের জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। রত্নময়ীও সই দিয়েছিল। শুধু তোমার
উঁ? শফি ভুরু কুঁচকে তাকাল!
গোবিন্দবাবু আস্তে বললেন, পিরসাহেব সই দেননি। আমি গিয়েছিলাম, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। উকিলসাহেবকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, শফি হিন্দু। তাই মুর্দা (মৃত)। কিন্তু আমরা জানি, তুমি কী।
শফি বলল, উঠি। একটু পরে বেরিও।
না। এখনই যেতে হবে। বলে শফি একমুহূর্ত ইতস্তত করল। বলল, আমি বহু বছর থেকে কারুর সামনে নত হই না। প্রণাম করি না। কিন্তু আপনাকে প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে।
গোবিন্দরাম দ্রুত তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আমি তোমার প্রণামযোগ্য নই। তুমি বয়সে বড়ো হলে আমিই তোমাকে প্রণাম করতাম।
শফি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বারান্দা থেকে বেগে নেমে গেল। বেড়া পেরিয়ে গিয়ে শোলার টুপিটি ফের পড়ল। সে গাজনতলায় গেল। তখনও বলিদান চলেছে। কিন্তু রত্নময়ী নেই। তার পাইকরা নেই। খুঁটিতে-খুঁটিতে মশাল জ্বলছে, আর সেই দপকে-ওঠা আলোয় মাতাল বিশৃঙ্খল ভিড়, হাজার-হাজার বছরের পুরনো মন্দির দেয়ালের টেরাকোটা খণ্ডগুলি থেকে ছিটকে-পড়া মূর্তিগুলির নড়াচড়া –রাত নিশুতি হলে যারা ফিরে যাবে দেয়ালের গায়ে চতুষ্কোণ, স্তরবদ্ধ, পৌরাণিক চরিত্রসমূহের জোটে, অতীতে। আশ্চর্য এদের মধ্যে কিছুক্ষণ আগে রত্নময়ীও ছিল! বিমূর্ত, ধূসর, অথচ একটি চোখেপড়ার মতো গঠন, দেশজ শৈলী-বহির্ভূত বর্ণিকাভঙ্গে ধৃত সেমিতীয় আদল কীভাবে যেন অনুপ্রবিষ্ট অথবা আরোপিত হয়েছিল ওই হিন্দু টেরাকোটায় এবং ক্রমশ সময়ের প্রহারে জর্জবিত হতে-হতে বেরিয়ে পড়ল আদি রূপ এবং সেও যুথের অনুগামী হল, নেমে এল প্রাচীন দেয়াল থেকে জীবন্ত হয়ে– ভাবলে বিস্ময়কর! মুন্সি আবদুর রহিম! আপনারই কারচুপি সবই –সেমিতীয় আদল আরোপকাবী ওহে বুড়ো ক্রান্তদশী, এবার দাডি ছিড়ন, নিজের গালের থাপ্পড। মারুন, আপনার সেমিতী নমস্যকে বলুন, ‘এ কী হৈলা বাপা?’ শফি নিঃশব্দে হাসতে-হাসতে ভিড় ঠেলে হাঁটছিল। Love begins in shadow, ends in light?
রাজবাড়িব উত্তরের ফটক খোলা ছিল। দুধারে দুটি কাঠের খুঁটির মাথায় চৌকো কাঠের ভেতর বাতি জ্বলছিল। দারোয়ানটিকে চেনে শফি। তার নাম মুঙ্গেশ্বর সিং, দ্বারভাঙ্গার লোক, ভাংখোর। গাজনের দিনে ফটকের লাগোয়া ঘুপচি ঘরে খাঁটিয়ায় বসে প্রচুর ভাঙের শরবত খেয়ে পেট ঢোল করেছে, ঢুলছে, শফির মনে পড়ল, গোবরা হাড়ি কতবার কৃষ্ণপুর রাজবাড়িতে যখন-তখন ডাকাতি কত ‘তুচ্ছ কম্ম’ বলে বর্ণনা করেছে, ‘তমে কথা কী জানেন ঠাকুর? মৌলাহাটের পিরছায়েরের পোয্য চ্যাড়াগুলিন আজবাড়ি পাহরা দ্যায়, উদের সঙ্গেতে আঁটা কঠিন– ক্যানে কী, উয়ারা তো হেঁয়া ঠাকুরমশাই! ছেঁয়ার শরীলে কোপ মারা যায় না গো! নৈলে পরে অ্যাদ্দিন কবে –হুঁ হুঁ……’ অদ্ভুত হাসে গোবরা ডাকাত।
ডাকাত! ডাকাতরাও ঘর বাঁধে স্ত্রীলোক নিয়ে। প্রেমিক হয়। পিতা হয়। সন্তানের মুখে চুমু খায় স্নেহে। এ মুহূর্তে বড়ো অবাক লাগে ভাবতে। Oh! faciles nimium qui tristia crimina caedis/Flumina tolli posse putatis aqua!
ম্যানেজারবাবু নাকি?
অন্ধকার থেকে চেনা কণ্ঠস্বর ভেসে এল শুকনো ফোয়ারার কাছে। শফি বলল, মুন্সিজি!
কে? কে আপনি?
ছবিলাল।
কিছুক্ষণ পরে মুন্সি আবদুর রহিম কাছে এলেন! রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বললেন, কী চাই?
আপনার জহরত-আরাকে।
বেশরম!
তাকে খবর দিন, আমি এসেছি।
চলে যাও। নৈলে দারোয়ান ডাকব।
খবর দিন রত্নময়ীকে, আমি এসেছি।
কণ্ঠস্বর শুনে মুন্সিজি একটু ভয় পেলেন। আস্তে বললেন, কেন–কী দরকার?
প্রশ্ন করবেন না, খবর দিন।
কেন, আগে বলো!
জানতে চাইবেন না। সবকিছু জানতে নেই। বেশি জানতে চাইলে মাথা খসে যায়! মুধা ব্যপপ্ত! মুন্সি আবদুর রহিম খাসক্লিষ্ট স্বরে গর্জন করলেন, বলতে হবে! কেন এসেছ তুমি? কিসের জন্য?…. তারপর সত্যিই তাঁর মুঙুটি খসে পড়ল ফোয়ারার বেদীর নীচে। শুকনো ঘাসে রক্ত উপচে পড়ল। চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে ধাবিত হওয়ার দরুন ১৯১৩ খ্রীস্টাব্দের ১৩ এপ্রিল রাত ৮-১০ মিনিটে এক সেমিতীয় বৃদ্ধ দার্শনিক শহীদ হন।…..
২৩. রফিকুজ্জামানের সহিত জুলেখার শাদির দিন
‘O Satan, prends pitie de ma longue misere!’