দি বেগম ।। ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ ওটা কী?
কচি ।। (লাফিয়ে ওঠে) সর্বনাশ! সাপের খোলস কোত্থেকে এল? (ঘরের কোণে গিয়ে) এম্মা! ইঁদুরের গর্ত যে! এখানে সাপের খোলস– উরে ব্বাস! নিশ্চয় সাপ আছে গর্তে। বেদে ডাকতে হবে। দাঁড়াও, খাতাটা রাখি। রসুল বেদেকে এক্ষুণি ডেকে আনছি।…..
‘……স হোবাচ গার্গি মাতি প্ৰাক্ষীমা তে মূর্ধা ব্যপঞ্চৎ–‘
কৃষ্ণপুরে চৈত্রসংক্রান্তিতে গাজনের মেলা বসেছে। বুড়োশিবের মন্দিরের সামনে চটানে ‘ভক্তা’ ‘সন্নেসি’র দল রাঙা কাপড় পরে বেতের ছড়ি হাতে চক্কর মেরে নাচছে, মধ্যিখানে পালাকের সাজপরা একঝাক ঢাক– আকাশ থেকে মেঘের টুকরোগুলি। নেমে এসে মানুষজনের ভিড়ে ডাক ছাড়লে এরকমই ঘটত, তারা দুলত, নাচত, গর্জাত, আর হলুদ ছিপছিপে বেতের ঋজু ও বক্ৰগতি মুহুর্মুহু –ওই মেঘগুলির দেহনিঃসৃত বিদ্যুৎরেখা বলে ভ্রম হয়, আর উপোসি ভক্তরা তালে-তালে নেচে-নেচে হাঁক মারছে, ‘শিবো নামে পুইনন্যা করে বোল শিবো বো-ও-ল!’ বড়োবানের বছর মাগঙ্গা কামড়ে খেয়েছে একগাল মাটি, বুড়ো শিবকে সে বুকে টানতে চেয়েছিল –বুড়ো চির যুবতী বধুর ছলনা বোঝে, তাই পেছনে ওই.শক্ত বটের ঠেকা। মেলায় বড়ো ভিড়। একশো আট পাঁঠা গঙ্গাজলে চুবিয়ে মানুতে লোকেরা হল্লা করছে হাড়িকাঠের কাছে। জনা বিশ কামার রক্তমাখা খাড়া তুলে নাচছে, চক্ষু রাঙা, কপালে রক্তের ফোঁটা। চটানের মাটি ও ঘাস রক্তে থকথকে। শৃঙ্খলাহীন, অসম্বদ্ধ, জোর যার বলি তার নীতি, কার পাঁঠার ধড় কার কাঁধে তোলে, কার পাঁঠার মুণ্ডু কারা কুড়োয় –উঁকি মেরে তাকিয়ে ছিলেন এক মফসরবাবু’ সরে এলেন। মাথায় শোলার টুপি, প্রকাণ্ড গোঁফ, শাদা শার্ট খাকি হাফপ্যান্ট পরনে, পায়ে বুট জুতো। পেছনে হৈ হৈ চিৎকার। সরে যাও! সরে যাও! পাইকের দঙ্গল লাঠি নেড়ে ভিড় দুভাগ করে দিতে দিতে এগিয়ে আসছে। রাজবাড়ির পাঁঠা আসছে, নধর নিখুঁত কালো এক পাঠা প্রকাণ্ড এক কালো জ্যান্ত অসুরের বুকে, ওই সেই লখনা কামার, যে ইচ্ছে করলে একশো আট পাঠার মুণ্ড ক্রমাগত কোপে ধড়ছাড়া করতে পারে; আর লখনা এখন রাজবাড়ির লোক, পেছনে গরদের শাড়ি পরে স্বয়ং রানীদিদি, ‘মালকান্ (মালিকানী) তিনি, আবার রাজবাড়িতে পুজোপার্বণ শুরু তাঁর আমলে, রাজা বাপটি ছিলেন মেলেচ্ছ কেরেস্তান, মোচলমানের বাড়া, আকাশ থেকে দেবতা নেমে সুদর্শন চক্করে ধড়-মুণ্ডু গঙ্গার এপার-ওপার করেছিলেন। আহা! আবার কতকাল পরে রাজবাড়ির পাঁঠা খাচ্ছেন বাবা বুড়ো শিব– ‘শিবো নামে পুইনন্যা করে বোল, শিবো বো-ও-ল! গর্জন হল দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চৌগুণ –ঢাকের ঝাঁক গর্জাল ঢ্যাঙা ঢ্যাঙ ঢাঢং ঢ্যাং, ভক্তবৎ তাবৎ প্রজাসাধারণ, ভুলুণ্ঠিত, কী অদ্ভুত মায়া! রানীদিদির নাকটি খাড়া, কোটরগত চোখে জ্যোতি, গায়ের বরন সোমলতার মতো, এলো চুলের দুধারে দুই জবাফুল গোঁজা, একটু পরেই মধ্যে পরবেন ওই রাজপাঠার রক্ততিলক– আহা, কতকাল পরে কত-কা-ল স্মরণ হয় না! রানীদিদির শীর্ণ শরীরে পিচ্ছিল গরদ, দুই বাহু অনাবৃত এবং পীত, দুহাতে বুকের কাছে রুপোর প্রকাণ্ড রেকাবে নৈবেদ্য, পাশে প্রত্যাবর্তিত রকের পামশাই, গেরুয়া বসন ও উত্তরীয়, কণ্ঠদেশে রুদ্রাক্ষ, কমণ্ডলুতে গঙ্গাজল– ‘হা গো ঠাকুর এতদিন কতি ছিলেন গো এই ব্যাকুল প্রশ্ন চোখে-চোখে দীপামান! ‘অফসরবাবু নির্নিমেষ দর্শন করেন রূপ অথবা মায়া এবং দূরে সরে যান। ঘিনজি দোকানপাট, আড়ত, ঘরবাড়ির ভেতর দিয়ে তিনি হেঁটে চলেছেন। ডাইনে গঙ্গা বা পদ্মা, জেলেবসতি, তারপর বেড়াঘেরা জঙ্গুলে বাগান। মধ্যিখানে একতালা জরাজীর্ণ দালান। বারান্দায় খাঁটিয়া। আসন্ন সন্ধ্যার ছায়ার ভেতর খাঁটিয়াটি শ্মশানের বলে ভুল হয় এবং শায়িত মানুষটিকে মনে হয় মড়া। মড়া জ্যান্ত হয়ে ওঠার চেষ্টা করে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কে?
‘অফসারবাবু’ টুপি বগলদাবা করে বারান্দায় উঠে আস্তে বলল, আমি ছবিলাল।
গোবিন্দরাম তাকে দেখছিলেন। তারপর উঠে বসলেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন। শ্বাস ছেড়ে বললেন, বসো।
আপনি কি অসুস্থ?
হাঁপানি। গোবিন্দরাম একটু পরে ফের বললেন, আসা ঠিক হয়নি। তোমার চেহারা লুকোবার নয়, তুমি জান না!
‘ছবিলাল’ বলল, রত্নময়ীকে দেখলাম –পুজো দিতে যাচ্ছে।
হিন্দুর সংস্কার। এ তুমি বুঝবে না– তোমাকে বলেছিলাম!
আমি ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য এসেছিলাম!
গোবিন্দরাম আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, কেন?
আমার কিছু কথা ছিল।
আমাকে বলতে পার, আমি সে-কথা পৌঁছে দেব। আমি রাজবাড়ির কাজ ছেড়ে দিয়েছি, তাহলেও অসুবিধা হবে না। মুন্সিজির মারফত
সে-কথা মুখোমুখি রত্নময়ীকেই বলার।
গোবিন্দরাম হাসবার চেষ্টা করলেন। গলায় ঘড়ঘড় শব্দ হল। বললেন, শফি! হতভাগিনী, মেয়েটা একটা আশ্রয় পেয়েছে এতদিনে। তাকে আশ্রয়চ্যুত করা উচিত নয় তোমার।।
শফিও হাসল। বলল, সে-কেমন আশ্রয় যে আমাকে দেখলেই তা ধসে যাবে?
তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু সে তোমাকে দেখলে কষ্ট পাবে। কারণ হয়তো সে–
বলুন!
আমার ভুল হতেও পারে, কিন্তু তোমার মধ্যে একটা কী আছে, প্রচণ্ড চুম্বক! তুমি জান, তোমার নামে গ্রামে-গ্রামে অদ্ভুত সব গল্প চালু আছে? হয়তো বীরপূজা মানুষের সহজাতবৃত্তি। এইসব বীরমানুষরা সেই সুযোগ নিয়ে দস্যুতা করেছে, কেউ রাজা, হয়েছে। তোমার সঙ্গে তাদের একটা বড়ো তফাত– তুমি বাসনাহীন, উদ্দেশ্যহীন। অকপট।