“গোবরা কিছু বুঝিতে পারিত না। শুধু বলিত, আজ্ঞে, আপুনি ঠাকুর। স্বীকার করি যে, সে রবিনহুড ছিল না? পথিমধ্যে রাজস্ববাহী শকট এবং বণিকদিগের পণ্যসম্ভার-বিক্রয়লব্ধ নগদ অর্থের খবর পাইলে লুণ্ঠন করিত। ইহাও রাষ্ট্রের কাঠামোতে আঘাত বলিয়া তাহার প্রতি সন্তুষ্ট ছিলাম।….
“একদিন গোবরার স্ত্রী হীরার কোলে তাহার কন্যাটিকে দেখিয়া করুণা ওরফে ইকরার কন্যাটির কথা স্মরণ হইল। চাঞ্চল্য বোধ করিলাম। বাদশাহী সড়কের ধারে সেই চটীতে উপস্থিত হইলাম। সঙ্গে স্বয়ং গোবরা ছিল। প্রয়োজনে সে নজর রাখিবে। শিশুটিকে হরণ করিবার অভিসন্ধি ছিল। সন্ধ্যার কিছু পরে চটীর শিয়রে দীঘির পাড়ে অবস্থিত মস্তানবাবার আস্তানাটি একদল পথিকের অধিকৃত দেখিলাম। চটীর মালিককে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলিল, মস্তানবাবা তাঁহার সাধনসঙ্গিনীর দেহান্তের পর ডেরা পরিত্যাগ করিয়া যান। সে প্রায় তিন বৎসর পূর্বের কথা। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হইয়া বলিলাম, তুমি কি অই ঘরটি দখল করিয়া লোকদিগের আশ্রয়স্থল করিয়াছ? সে নির্বিকার মুখে বলিল, ঠিক করিয়াছি। বলিলাম, ভাড়া লও কি? সে পূর্ববৎ ভঙ্গীতে বলিল, লই। আপনারা রাত্রিবাস করিতে চাহিলে এক আনা হারে ভাড়া লাগিবে। এখনও চারিজনের স্থান সংকুলান হইবে। তৎক্ষণাৎ তাহাকে চপেটাঘাত করিলাম। চটীতে ভোজনরত কতিপয় লোক মুখ ঘুরাইয়া রহিল। চটীদার চড় খাইয়া এক লাফে কুঠুরিতে ঢুকিয়া একখানি প্রকাণ্ড খাড়া আনিল এবং আস্ফালন করিয়া তুমুল চীৎকার করিতে থাকিল। একটি খর্বাকৃতি শীর্ণ মনুষ্যকণ্ঠে ওইরূপ তীক্ষ্ণ নাদ বিস্ময়কর। গোবরা তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া মিটিমিটি হাসিতেছিল। সহসা পিছন হইতে তাহাকে জড়াইয়া ধরাশায়ী করিল। খাড়া কাড়িয়া লইলাম। গোবরাও তাহাকে ছাড়িয়া দিল। তাহার পর চিত্রবৎ স্থির এবং ভোজনরত লোকদিগের উদ্দেশে বলিল, আমি গোবরা হাড়ি। ইতোমধ্যে দীঘির পাড়ের আস্তানাঘরের লোকগুলি গণ্ডগোল দেখিতে আসিয়াছিল। কথাটি শুনিবামাত্র তাহারা এবং ভোজনরত ব্যক্তিরা আহার ফেলিয়া অন্ধকারে অদৃশ্য হইল। চটীদার কাঁপিতে-কাঁপিতে গোবরার সম্মুখে নত হইয়া বলিল, বাবা! মার্জনা করিবেন। গোবরা বলিল, তবিল আন। আমি তাহাকে ইঙ্গিতে নিবৃত্ত করিয়া বলিলাম, যথেষ্ট হইয়াছে।….
“ইহার পর কিছুকাল মস্তানবাবার সন্ধানে বিস্তর ছোটাছুটি করিয়াছি। লোকটি যেন পৃথিবী হইতে উবিয়া গিয়াছে। অদ্য অকপটে লিখিতেছি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ওই শিশুকন্যাটি আমার পিতার ঔরসজাত! সুতরাং আমার সহিত উহার রক্তের সম্পর্ক ছিল। যদি প্রমাণের কথা বল, দিতে পারিব না। কিন্তু কন্যাটির গাত্রবর্ণ তাহার জননী অপেক্ষা বহুগুণ সমুজ্জ্বল ছিল, এইটুকু বলিতে পারি। আর একটি কথা লিখিবার আছে। সেই মস্তানবাবা সম্ভবত আ…..”
.
একটি কথোপকথন
কচি ।। এ কী দাদিমা! হঠাৎ এখানেই শেষ কেন? ‘আ’ লিখেই শেষ!
দিলরুখ বেগম ॥ জানি না!
কচি ।। (উত্তেজিতভাবে) কোনো মানে হয়? আ লিখে কলম থেমে গেল। মিস্ট্রিয়াস! কামাল স্যারকে দেখাতে হবে।
দি বেগম ৷। (দৃঢ়স্বরে) না। আমার মরা ধড়ের ওপর দিয়ে তবে ওই খাতা বাইরে নিয়ে যাস!
কচি ॥ (অবাক হয়ে) কী অদ্ভুত। ব্যাপারটা তোমায় পড়ে শোনাচ্ছি। তাহলে বুঝবে—
দি বেগম । আমি বুঝতে চাই না। তুই চুপ কর! রেখে দে সিন্দুকে। আর কক্ষনো সিন্দুকে হাত দিবি নে।
কচি ॥ (একটু পরে দুঃখিতভাবে) একটা ব্যাপার ভাবা যায়। হয়তো ঠিক সেই মোমেনটে সেনট্রিরা এসে ছোটোদাদজিকে ফাঁসি দিতে নিয়ে গিয়েছিল। ফাঁসি শেষরাতে বা ভোরে দেওয়া হয়। হুঁ– তাই হবে। বুট! কাওয়ার্ড! ওরা শেষ কথাটা লিখতে সময় দেয়নি! দাদিমা, আমি ছেলে হলে এর শোধ নিতাম! এখন বুঝতে পারছি, খোকা যা করছে, ঠিক করছে। ওকে আমি সাপোর্ট করি! দুনিয়া জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া দরকার।
দি বেগম ॥ (শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে) তা তো বলবিই। তোদের যে বদ খুন আছে অজুদে!
কচি ॥ (অন্যমনস্কভাবে) সেই মস্তানবাবা সম্ভবত,…(হঠাৎ নড়ে উঠে) দাদিমা! দাদিমা! সেই মস্তানবাবা বড়ো আব্বার ছোটো ভাই ফরিদুজ্জামান নন তো? শা ফরিদ, ও দাদিমা, সেই শা ফরিদ!
দি বেগম ।। (ফুঁপিয়ে উঠে) আমি জানি না! দোহাই কচি, তুই, চুপ কর!
কচি ॥ কান্নাকাটি করছে কেন? হল কী তোমার? ও দাদিমা!
দি বেগম ।। কবর খুঁড়তে নেই। গোনা হবে।
কচি ॥ কী আশ্চর্য! ফ্যামিলির হিট্রি জানলে গোনা হবে? রাখো তোমার গোনা।
দি বেগম ।। আমার বড়ো ডর নাগে! পা ফেললে বাড়ির মাটি টলমল করে। দেয়ালগুলান দেখি, মনে হয়, ধসে যাবে। ঘরের চালের দিকে তাকাই। ভাবি, মচমচ করে ভেঙে পড়বে। সারারাত বাড়ি চারপাশে ফিসফিস করে কারা।
কচি ।। ডিলিরিয়াম!
দি বেগম ॥ হারামজাদি মেয়ে! দেখছিস না চারদিক থেকে জঙ্গল বাড়িটাকে ঘিরে ধরছে? কিলবিলে সাপের মতন লতাপাতা। চাঁদের আলোয় উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখিস। চারদিক থেকে! চাদ্দিক থেকে!
কচি ॥ কী চারদিক থেকে?
দি বেগম ॥ কালা জিনের মুঠোয় আটকে পড়ছে বাড়িটা। চাদ্দিক থেকে মাকড়সার মতন জাল বুনেছে।
কচি ॥ (হাসতে-হাসতে) বোগাস! দারিদ্র্য! খোকা লেখাপড়া শিখল না। পাস করলে চাকরি পেত। আমি পাস করে বেরুব। চাকরি করব। বাড়ি মেরামত করব। বাস!