আমি পালকি নিইনি। পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছিলাম। তুমুল বৃষ্টি সে রাত্রে। সে এক অবিশ্বাস্য যাত্রা। একটা কালো জিন অশ্বরূপে আমাকে বহন করিয়াছিল।…..
‘জেলা সমাচার’ পত্রিকার সম্পাদকীয় (আংশিক উদ্ধৃতি)
“…..বিগত ১৭ই জুন জেলার কুখ্যাত দুর্বত্ত ছফিজামান ওরফে ছবিলালকে দয়রা জজ শ্রীযুক্ত জৰ্জ নীল মহোদয় বেকসুর খালাস দিয়াছেন জানিয়া স্তম্ভিত হইয়াছিলাম। ইংরাজ বিচারব্যবস্থার বিষয়ে আমাদিগের উচ্চ ধারণার কোনও হেতু নাই, উহা পুনরায় প্রমাণিত হইল। বিগত বৎসরে বঙ্গভঙ্গরূপ ঘটনায় মুসলমানদিগের সহিত ইংরাজ শাসনকৰ্ত্তাদিগের কিরূপ ষড়যন্ত্র চলিতেছে, তাহার প্রতি আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করিয়াছিলাম। এক্ষণে এই দুর্বত্ত দ ও হন্তারকের নিস্কৃতিলাভ তাহার আরও একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত হইল। অতএব সাধু সাবধান। এই মুসলমানঅধ্যুষিত জেলায় ইহার পর হিন্দুদিগের মানসম্ভ্রম নিরাপদ নহে বিবেচনায় অবশেষে বিভিন্ন স্থানের রাজাবাহাদুর ও জমিদারবৃন্দ কালেকটরবাহাদুর শ্ৰীযুত ম্যাকফার্সন সাহেবের নিকট প্রতিকার প্রার্থনা না করিলে কী ঘটিত ভাবিতেও হৃৎকম্প হয়। অতি আনন্দের কথা যে ওই দরখাস্তে নবাববাহাদুর মুসলমান হইয়াও সহি দেন। ইহার ফলস্বরূপ সুবিজ্ঞ কালেকটরবাহাদুর উক্ত দস্যুর প্রতি ৭ বৎসরের জন্য জেলা হইতে নির্বাসনদণ্ড জারি করিয়াছেন। এই ৭ বৎসর মধ্যে ছফি ওরফে ছবিলাল জেলার মাটিতে পদার্পণ করিলেই দৃষ্টি হওয়ামাত্র উহাকে যে কেহ হত্যা করিতে পারিবে এবং তজ্জন্য দুই হাজার টাকা পারিতোষিক লাভ করিবে। ইহা মন্দের ভাল হইল। জেলাবাসী সজ্জন গৃহস্থ বিত্তবান সকলেই কালেকটরবাহাদুরের প্রশংসা গাহিতেছেন। কিন্তু বিশ্বস্তসূত্রে আমরা অবগত হইয়াছি যে, কতিপয় নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তি এবং অতিশয় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, তাহাদিগের সহিত কতিপয় বিশ্বাসঘাতক স্বজাতিদ্রোহী জয়চাঁদ এবং কালাপাহাড় ওই নির্বাসনদণ্ড প্রত্যাহারের কারণে ষড়যন্ত্র করিতেছে। পুনরায় কহি যে, সাধু সাবধান!…..”
‘And behold! a Messiah cometh unto them.’
কথিত আছে, একদা পশ্চিমের লোকসকল পূর্বদিশ্বলয়ে একটি কৃষ্ণবিন্দু দেখিতে পায়। বিন্দু শূন্যে ভাসমান এবং কম্পমান ছিল। ক্রমেই উহা স্ফীত লাভ করতঃ ভূমিসংলগ্ন হয়। তিনি এক কৃষ্ণবর্ণ অশ্বের আরোহী। লোকসকল প্রণত হইলে ‘তিনি ভর্ৎসনা করিয়া বলেন, অই বৃক্ষ দেখ, যাহা ঋজু, যাহা ছেদিত বা দন্ধ হয়; কিন্তু স্বেচ্ছায় নত হয় না, যাহা ভূমির জন্য কাহাকেও রাজস্ব দেয় না। তোমরা বৃক্ষের নিকট শিখ। আর তোমরা নদীর নিকট শিখ, যাহা গতিশীল। আর তোমরা মেঘের নিকট শিখ, যাহা নিজেকে নিঃশেষিত করিয়া ভূমিকে জীবন দেয়; কিন্তু বক্ষে বজ্র বহন করে এবং গর্জন করে ।
কথিত আছে, ‘তিনি’ কঠিন শিলার ন্যায় দুর্ভেদ্য ছিলেন। আর ‘তিনি’ অগ্নিবর্ণ ছিলেন। লোকসকলকে উত্তপ্ত করিতেন। তাহারা অনুসরণ করিলে তিনি বলিতেন, যাহা বলিয়াছি, পালন কর। আর একদিবস একটি গোরাবন্টন সেই অশ্বের ভয়ঙ্কর মূত্রস্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল। দারোগাবাবুদিগের দেখিলে ‘তিনি বলিতেন, উর্দি খুলিয়া ফেল। উহা শৃঙ্খল। উহা আনুগত্যের হেতু। উহা বিদ্রোহ আগুলিয়া রাখে! কিন্তু বিদ্রোহ স্বাধীনতার পথ এবং স্বাধীনতাই জীবন।
কথিত আছে, এইরূপে ‘তিনি’ অসংখ্য গ্রামপরিক্রমা করেন। সেই গ্রামসকল স্বাধীনতাময় হইয়াছিল। সেইসকল গ্রামের মাটি ও নিসর্গ হইতে ‘স্বাধীনতা। স্বাধীনতা!’ এই ধ্বনি স্পন্দিত হইত ।
এবং কথিত আছে, লোকসকলকে স্বপ্নে দেখা দিয়া ‘তিনি’ বলিয়াছিলেন, “আমি সেই ছবিলাল’। পরবর্তীকালে প্রাজ্ঞ গ্রামীণেরা ব্যাখ্যা করিত, তিনি ছবির ন্যায় রাঙা ছিলেন, সেই হেতু ছবিলাল ॥….
‘I will go no more to Apollo’s inviolate shrine…. The old
prophecies about Laius are losing their power; already
men are dismissing them from mind, and Apollo is
nowhere glorified with honours. Religion is dying….’
Oedipus the Kind–Sophocles.
“বীরভূম জেলার নলহাটি অঞ্চলের দস্যুসর্দার গোবর্ধন ওরফে গোবরা ছিল হাড়িসম্প্রদায়ভুক্ত। লোকে তাহাকে গোবরা হাড়ি বলিয়া জানিত। সে আমাকে ‘ঠাকুর’ বলিয়া মান্য করিত! সে ভাবিত, আমার কিছু অতিলৌকিক ক্ষমতা আছে। কারণ আমি লাঠি ও তলোয়ার চালনায় দশজন গোবরা হাড়ির অপেক্ষা পারদর্শী ছিলাম। ত্রিশ-চল্লিশ বিঘৎ দূর হইতে বল্লম ছুড়িয়া লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত ছিলাম। তাহার একটি গাদা বন্দুক ছিল। উড়ন্ত পাখি মারিয়া তাহাকে তাক লাগাইয়া দিয়াছিলাম। কিন্তু সে প্রণাম করিতে নত হইলে তাহার বাবরি চুল ধরিয়া তাহাকে সিধা দাঁড় করাইয়া বলিতাম, খর্বদার! নিজেকে অপমানিত করিবি না। সে বলিত, আপনি ঠাকুর! বলিতাম, ওরে নির্বোধ! ঠাকুর মুসলমানেরও পদবী হয়। তুই গোমূর্খ, তাই জানিস না, উহা মুসলমানী কথা। তুর্কী বাদশাহদের আমলে আমদানি। তুর্কী ভাষায় ‘টাগরি’ অর্থ ঈশ্বর এবং ঈশ্বরবাহাদুরের মর্ত্যের প্রতিনিধি দ্বিপদ প্রাণীবিশেষ, যাহারা বাদশাহ এবং প্রজাসাধারণের মধ্যবর্তী স্থানে থাকিয়া চক্ষু রাঙ্গায়। উহারা বৃক্ষের পরগাছা। উহারা সহজে উৎপাটনযোগ্য …..