বৃক্ষলতা রৌদ্র বৃষ্টি নদী শস্য মেঘ যেরূপ স্বাধীনতাময়।
বাবু গোবিন্দরাম পলাইতে পরামর্শ দেন, যেহেতু মুন্সি আবদুর রহিম আমাকে চিনিতেন!
তুমি রত্নময়ীর সহিত সাক্ষাত করিতে চাহিয়াছিলে!
সাময়িক মোহ মাত্র। অথবা তাহাকে জানাইবার ইচ্ছা ছিল যে, তাহার বাঞ্ছা। পূরণ করিয়াছি।–
দক্ষিণে যাইতে বাদশাহী সড়কে একটি চটীতে উপস্থিত হইলে।
তখন রাত্রিকাল।
চটীর পিছনে উচ্চ দীঘির পাড়ে আলো জ্বলিতেছিল। চটীর মালিক বলেন, ‘মুসলমান সাধুর ওই ডেরায় যাইলে আশ্রয় পাইবেন।’
সেখানে অজিফামামী এবং মস্তানবাবাকে আবিষ্কার করিয়াছিলাম।
স্ত্রীলোকটির ক্রোড়ে একটি সুন্দর শিশু ছিল, যে বালিকা।
একদা এই ক্ষুদ্র বর্ণাঢ্য মাংসপুঞ্জরূপী উপাদানকে ভিন্ন উপাদানে পরিণত করিতে গিয়াছিলাম ভাবিয়া অনুশোচনা জাগিল।
তোমার চক্ষু সেই প্রথম অশ্রুসিক্ত হয়, জীবনে একবার।
মস্তানবাবাকে সজাগ প্রহরী জানিয়াছিলাম বলিয়া সভয়ে চলিয়া আসিলাম।
বাদশাহী সড়কে চলিতে স্মরণ হইল, এই পথ মৌলাহাটে পৌঁছিয়াছে। তখন পূর্বমুখী হইলে।
তখন উষাকাল। বিহঙ্গসকল প্রকৃতির জয়গান গাহিতেছিল। উহাদের কণ্ঠরোধ করিবার সাধ্য নাই, অথচ মনুষ্যদিগের নিয়ত কণ্ঠরোধ করা হয়।
রাষ্ট্র মাড়াইকল। শাসকবৃন্দ পাদুকাবাহী। পুলিশ সেনাবাহিনী ভাড়াটিয়া গুণ্ডা।
উহাদিগের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা কর্ত্তব্য।
যতদিন না ওইগুলিন ধ্বংস হইতেছে ততদিন নির্বাণ দুঃসম্ভব।
উহাই নির্বাণ, উহাই মোক্ষ, যাহা ব্যক্তিকে স্বরাট করে, সার্বভৌম সত্তাকে পরিণত করে।
যুদ্ধ চলিতেছে যুগযুগান্ত কাল হইতে–
মুক্তির জন্য যুদ্ধ, নির্বাণের জন্য যুদ্ধ, পদযুগলকে শূন্যতা হইতে ফিরাইয়া আনিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ।
যথেষ্ট হইয়াছে। এইবার আরও পূর্বমুখী হও, উহাও গঙ্গার দক্ষিণ তীর।
ছেদন করিতে ছেদন করাইতে, অঙ্গহীন করিতে অঙ্গহীন করাইতে–
গ্রাম হইতে নগরে, গঞ্জে,….
.
আভি মুহরিবাবু নেহি হ্যায়। আমার চেহারায় নিশ্চয় হিন্দুস্থানী আদল ছিল। একমুখ গোঁফদাড়ি। অবশিষ্ট শার্ট আর ধুতিটি পরনে ছিল। রক্তমাখা কাপড়চোপড় এবং ভোজালিটি ভাগীরথীতে ডুবিয়ে রেখে এসেছি। অমলকান্তির কাছে শুনেছিলাম, বারিচাচাজি বহরমপুরের গোরাবাজারে থাকেন এবং ওকালতি করেন। আমি এবার বারান্দায় উঠে গিয়ে আস্তে বললাম, আমি শফি-শফি-উজ্জামান। বারি চৌধুরি নিষ্পলক চোখে একটু তাকিয়ে থাকার পর বললেন, কোর্টে সারেনডার করতে এসেছ? বুকের ভেতর ধাক্কা লাগার ফলে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, হ্যাঁ। কয়েক মুহূর্ত তেমনি তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার একটা হাত ধরে টেনে ভেতরে ঢোকালেন! দরজা বন্ধ করে দিলেন। সামনে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বললেন, কেন তুমি এমন হয়ে গেলে, শফি? কিসের অভিমান তোমার? চুপ করে রইলাম। এ কী অদ্ভুত প্রশ্ন বারিচাচাজির? হঠাৎ প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন, উই লিভ বাট এ ফ্র্যাকশন অব আওয়ার লাইফ! পরমুহূর্তে আবেগ দমন করে পানজাবির হাতায় চোখ মুছলেন। আমার পাশে এসে বসলেন। আস্তে বললেন সারেনডার করতে আসার আগে মাকে দেখা করে এসেছ? বললাম, না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, তোমার বিরুদ্ধে বাঢ়ের জমিদারদের অসংখ্য নালিশ কালেকটরসায়েবের কাছে জমা আছে। কৃষ্ণপুরের জমিদারকে খুনের নালিশ আছে। আরও কিছু খুন খারাপির নালিশও আছে শুনেছি। জানি না তোমাকে বাঁচাতে পারব কি না। সবকিছু জেনে-বুঝে তবে সারেনডার করতে বলব। আপাতত তুমি গোপনে মৌলাহাটে গিয়ে অন্তত মাকে একবার দেখা করে এসো। বললাম, গতরাত্রে লালবাগে কাল্লু সিপাহীকে খুন করে এসেছি। সেই সাতমার কান্নু খাকে। বারিচাচাজি চমকে উঠে বললেন, কেন? সে কী দোষ করেছিল তোমার? বললাম, জানি না। তবে মনে হয়েছিল ওকে খুন করা দরকার। বারি চৌধুরি শাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বললেন, দেন ইউ আর এ হোমিসাইডাল ম্যানিয়াক। তোমাকে বাঁচানোর একমাত্র উপায়, তোমাকে মানসিক রোগগ্রস্ত প্রমাণ করা। এবং তুমি মানসিক-রোগগ্রস্ত তো বটেই। ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর বারি চৌধুরি ফের বললেন, তুমি জান কি, হরিণমারার বড়োগাজি জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন? উনি এই মহল্লায় থাকেন। সবকারি কর্তাদের সঙ্গে খুব দহরম-মহরম আছে। ওঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার। কিন্তু তুমি আগে মাকে দেখা করে এসো। বললাম, যাব। বলছেন যখন। বারিচাচাজি দুঃখিত মুখে বললেন, যে জীবন তুমি পেয়েছ, যে-জীবনের জোরে দুনিয়ায় বাহাদুরি দেখিয়ে বেড়াচ্ছ, তা কীভাবে পেলে ভেবে দেখছ না? মুখ নামিয়ে বললাম, আমি কি দুনিয়ায় আসার জন্য দায়ী? আমার জীবনের জন্য আমি দায়ী নই। বারি চৌধুরি কষ্টে হাসলেন। বললেন, জীবন তোমাকে কি কিছুই দেয়নি? আগে এ প্রশ্নের জবাব দাও। বললাম, পৃথিবী দুঃখময়। বাসযোগ্য নয়। বাবিচাচাজি বললেন, বেশ তো! তাকে বাসযোগ্য করার জন্য লড়াই করো। বললাম, সেটাই তো করছিলাম। বারিচাচাজি বললেন, নিৎসে নামে একজন ইউরোপীয় দার্শনিক সুপারম্যানের প্রকল্প খাড়া করে গেছেন। বছর পাঁচেক আগে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তুমি কি নিজেকে সুপারম্যান ভাব নাকি? কোনো জবাব দিলাম না। দার্শনিক বিষয়ে তর্ক করার প্রবৃত্তি ছিল না। বারিচাচাজি জানেন না, আমি এসব বিষয়ে তাঁর চেয়ে অনেক বেশি জানি আর বুঝি! চুপ করে আছি দেখে তিনি আর কথা বাড়ালেন না। ডাকলেন, করিম। করিম বখশ। অবাক হয়ে দেখি, কেল্লাবাড়ির সেই বুড়ো করিম বখশ এসে দরজায় দাঁড়াল। কিন্তু সে আমাকে চিনতে পারল না। বারিচাচাজি বললেন, নাশতার যোগাড় করো। আগে দু পেয়ালা চা পেলে ভালো হয়! করিম বখশ চলে গেল। এই সময় বৃষ্টি শুরু হল। আশ্বিন মাস। উলুশরার বিলের রাস্তায় গেলে মৌলাহাট দশ ক্রোশ, কিন্তু এখন ওদিকটা দুর্গম। জিগ্যেস করলাম, আপনার ঘোড়াটা কি আছে? বারিচাচাজি অন্যমনস্কভাবে বললেন, আছে। কেন? বললাম, মৌলাহাট– কথা কেড়ে বারিচাচাজি মাথা নেড়ে বলবেন, না। প্রকাশ্যে ঘোড়ার পিঠে ওই এলাকায় যাওয়া ঠিক নয়। তোমাকে বরং পালকি ভাড়া করে দেব। সেটাই তোমার পক্ষে নিরাপদ হবে।…..