স্বাধীন দ্রুত সরে যায় তার কাছ থেকে। সে বছর মাঘোৎসব হয়নি। দেবনারায়ণবাবু কলকাতা চলে যান। তারপর থেকে মাঝে-মাঝে আসতেন। খাজনা আদায়ের চেষ্টা করতেন। এক হৃদয়নাথ শাস্ত্রী আশ্রম চালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতেন। শফি তার মাসিক বেতন নিয়মিত পেত, এটা আশ্চর্য বটে! একদিন সুনয়নী ব্যস্তভাবে এসে শফিকে ডেকে চুপিচুপি বলেন, খুকুর কী হয়েছে, তুমি জানো? শফি বলে, না তো! কী হয়েছে মাসিমা? সুনয়নী কান্নাজড়িত স্বরে বলেন, তুমি এসে দেখে যাও। সুনয়নীর কুটিরে গিয়ে শফি দেখে, স্বাধীন শাদা থান পরে দাঁড়িয়ে আছে। শফী বলে, এ কী খুকু। স্বাধীন নির্লজ্জ মুখে নির্দ্বিধায় বলে, আমি বিধবা হয়েছি। সুনয়নী তার গালে চড় মারেন। তবু বৃক্ষবং ঋজু ও স্থির সেই যুবতী অকপট বলে, আমার স্বামী বানের জলে ভেসে গেছেন। আমি বিধবা হব না কেন? শফি বলে, খুকু। তুমি বলেছিলে তোমার হৃদয়ে– স্বাধীনবালা তাকে বাধা দিয়ে বলে, প্রেম এবং বিবাহ সম্পর্কহীন। সেই রাত্রে সুনয়নী কন্যাকে ত্যাগ করে চলে যান। কথিত আছে, তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদিগের সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। এরপর বৈশাখ মাসের এক দুপুরে হৃদয়নাথ শাস্ত্রী ডাকঘর থেকে ফিরে ভীতমুখে বলেন, কাণ্ড দেখো শফি! দেববাবু দুধ দিয়ে সাপিনী পুষেছিলেন, দেখ। জেলা সমাচার পত্রিকায় বড়ো-বড়ো হরফে খবর : পুনরায় কালেক্টর বাহাদুরের উপর আক্রমণ/ পিস্তলসহ যুবতী ধৃত। শফি তাকিয়ে আছে দেখে শাস্ত্রীজি চাপা স্বরে বলেন, পড়ে দেখো পুরোটা! স্বাধীনবালার কীর্তি দেখো। শফি, প্রত্যাঘাত আসিতেছে। আশ্রমের পবিত্রভূমি কলুষিত হইবে। আমি বৃদ্ধ। কিন্তু তুমি যুবক। শীঘ্র পলাইয়া যাও। শফি সন্দেহবশে দ্রুত ঘরে ঢোকে এবং তার পিস্তলটি খোঁজে। নাই। নির্বোধ খুকু জানে না, পিস্তলটিতে দুইবার ঘোড়া না টানিলে গুলি ছোটে না। শাস্ত্রীজি উত্তেজিতভাবে বলেন, কী করিতেছ? পালাও। নরক আসিতেছে।…
২২. উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র
I will do such things–
What they are yet I know not–
but they shall be
The terror of the earth…..
উন্মাদ হইবার পূর্বে রাজা লিয়র ওই কথা বলিয়াছিলেন। কিন্তু আমি উন্মাদ হই নাই, যদিচ উন্মাদনা থাকিতে পারে।
উহাতে নীটসের দর্শনের বীজ রহিয়াছে।
এবং শোপেনহাওয়ার, বাকুনিন…..
এবং পকুধ কচ্চায়ন, পূরণ কস্সপ…
গঙ্গার দক্ষিণ তীরে ছেদন করিতে, ছেদন করাইতে, অঙ্গহীন করিতে, অঙ্গহীন করাইতে, …
উহা তোমার পরিকল্পনা, মানসিক কর্ম্ম তৎকালে।
পরিকল্পনাহেতু কৃষ্ণপুরে পঁহুছিলাম।
পূৰ্বে তোরণের প্রহরীদ্বয় তোমাকে হাঁকাইয়া দিয়াছিল। কারণ তোমার বেশভূষা মলিন, দরিদ্রবৎ আকৃতি, কোটরগত চক্ষে করুণা-প্রার্থনার কাপট্য ছিল।
উত্তরতোরণে গিয়াছিলাম, যেখানে প্রজাসাধারণকে অবাধ অপমানিত প্রবাহ বোধ হইতেছিল।
খাজাঞ্চিখানা, দরখাস্ত, গোমস্তা, মুহুরি, শবদেহে কীট, থকথকে, কদর্য ক্রেদপুঞ্জ ভাসিতেছিল।
মুন্সি আবদুর রহিম ইঙ্গিতে চলিয়া যাইতে বলেন।
তুমি যাও বাবু গোবিন্দরামের নিকট।
সাদরে গ্রহণ করেন তিনি।
পদ্মতীরে তাঁহার বাসগৃহ ছিল।
গঙ্গাতীরে ক্ষুদ্র একতলা দালানবাটিকা এবং নিরলঙ্কত জীবনযাপন করিতেন।
তুমি চাকুরি চাহিলে। ছবিলাল গোমস্তা হইলে। সাত টাকা মাহিনা।
মহালে যাইতাম। দাড়ি রাখিয়াছিলাম।
তুমি কৃষকদিগের বলিতে, যে-মাটি চষিতেছ, উহা তোমারই।
বলিতাম, কেহ কাহারও প্রজা নহে। রাজা মাড়াইকল! রাষ্ট্র খাঁচাকল। পেয়াদাপাইক বরকন্দাজ পুলিশ সেনাবাহিনী সমুদয় বেতনখোর দুর্বৃত্ত। খাজনা দিও না।
তাহারা বুঝিত না।
ক্রমে বুঝিয়াছিল।
আশ্চৰ্য্য দেখ, কৃষকেরা তোমাকে সাধু ভাবিয়া নত হইত আর গ্রামে পুলিশ আসিলে পূৰ্বে সম্বাদ সংগ্রহ করিত।
চৌকিদারগণ মাংসপুঞ্জ হইত! যেরূপ পকুধ কচ্চায়ন কহিয়াছেন, এক উপাদান অন্য উপাদানে পরিবর্ত্তিত হওয়ার কথা, সেইরূপ।
বাবু গোবিন্দরাম সিংহ বলিতেন, জ্বালাইয়া দাও! ভাঙ্গিয়া ফেল! পূণ্য হইবে।
নিশীথরাত্রে তাঁহার গৃহে যাইতাম। তিনি প্রতীক্ষা করিতেন! পরামর্শ দিতেন।
একদিন তিনি বলেন যে জমিদারবাবু গঙ্গাতীরব্যাপী নিত্য অপরাহ্নে অশ্বরোহণে গমনাগমন করেন, যাহা বহুকালবধি শৌখিনতা।
আমাকে নির্জ্জনে দণ্ডায়মান দেখিয়া অনন্তনারায়ণ বলেন, এই বেটা, ঘোড়ার লাগাম ধর। মুত্র ত্যাগ করিব।
তিনি ঝোপমধ্যে যোধপূরী ব্রিচেশের বোতাম খুলিয়া দণ্ডায়মান অবস্থায়। মূত্রত্যাগে রত হন। কিন্তু কানে পৈতা জড়াইতে ভোলেন না।
ঝোঁপটি পুষ্পবতী সৌন্দর্যময়ী ছিল।
উহা পৃথিবীতে প্রকৃতির চুম্বনের চিহ্ন।
প্রকৃতি অপমানে জর্জ্জরিত হইলেন দেখিয়া অশ্বের লাগাম ছাড়িয়া নিকটে গেলাম এবং মুখ ঘুরাইবার সঙ্গে-সঙ্গে….
কুকরি দ্বারা গর্দানে কোপ মারিলে। অশ্বটিও তুষ্ট হইল। কারণ সে চিত্রার্পিত ছিল।
গঙ্গার উত্তর দেশ হইতে গোর্খারা চাকুরি খুঁজিতে আসিত।
এক ক্ষুধার্ত বৃদ্ধ গোর্খার নিকট চারি আনার কুকরি খরিদ করিয়াছিলে।
উহা চর্ম্মকোষে আবদ্ধ ছিল, কারুকার্য্যখচিত সুন্দর বিভীষিকা!
আর দেখ, তুমি কৃষকদিগের বলিতে, ভাইসকল! তোমরা পৃথিবীকে সাজাইয়াছ। তোমরা রূপকার!
বলিতাম, তোমরা প্রকৃতির মহৎ সন্তানহেতু প্রকৃতির স্বাধীনতাস্রোতে ভাসিতেছ।