বাইরে দুর্যোগ। আর এই বিদ্বান লোকগুলি তত্ত্ব আলোচনা করছেন। ক্রমে ক্ৰমে ছাতি মাথায় আরও আশ্রমিকগণ আসছেন আচার্যের ঘরে। তত্ত্ব আলোচনা আরও জমে উঠছে। কে হেঁড়ে গলায় বলে উঠলেন, শুনেছি সুনয়নী দেবী উৎকৃষ্ট খিচুড়ি রান্না করতে পারেন। খবর দেওয়া হোক ওঁকে। অপর একজন বললেন, খবর নিয়েই আসছি রন্ধনশালা থেকে। হইচই পড়ে গেল। এইসময় শৈশবে শোনা নিরক্ষর চাষাভুষো লোকেদের একটা ছড়া মনে পড়ল :
তিনদিনকার গাজলে
মহিষ মরে হিজলে
টিকটিকিরা বাতায়
উকুন মরে মাথায়
মানুষ মরে খালে
গুধা মায়ের কোলে…
দেবনারায়ণদার গলা শোনা গেল, খনার বচনে কী আছে যেন? মঙ্গলে পাঁচ/ শনিতে সাত/ বুধে তিন/ আর সব দিন-দিন। কী বারে লেগেছে হে ভবেশ? ভবেশ বললেন, বুধবার। দেবনারায়ণদা বললেন, ধুস! আজ তো তিনদিন হল। থামবার লক্ষণ কোথায়? প্রভাসরঞ্জন অট্টহাসি হেসে বললেন, বিভিন্ন শাস্ত্রে আছে, পরমেশ্বর পাপের শাস্তি দিতে নেচারকে লেলিয়ে দেন। ব্রহ্মপুরে স্বামীজী সংঘ এবার দুর্গাপূজার আয়োজন করেছে না? কেউ বললেন, শিবনাথপল্লীর সেই এঁড়ে চক্কোতি শুনলাম বারোয়ারি পূজা দেবে। দেববাবু স্পর্ধা মার্জনা করবেন। স্বহস্তে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছেন। দেবনারাণয়দা বললেন, আমি নিরুপায় মধুবাবু! আশ্রমবাসীদের মধ্যে বিস্তর অ-ব্রাহ্ম আছেন। তাদের পরিবারবর্গ আছে। হজ্জত হোক, পুলিশের। দারোগার বুটজুতো আশ্রমের পবিত্র মাটি কলঙ্কিত করুক, এ আমার অভিপ্রেত নয়। প্রভাসরঞ্জন ঘোষণা করলেন, ওয়েট অ্যানড সি। পরমেশ্বর পাপীদিগের শাস্তি স্বহস্তে দেবেন।
পাহলোয়ানের জন্য আমি অস্থির। ছাতি মাথায় নেমে আশ্রমসীমানা পেরিয়ে যাওয়া মাত্র দমকা বাতাসে ছাতি উলটে গেল। বৃষ্টিও গেল বেড়ে। একটি গাছের দিকে ছুটে গেলাম। কিন্তু প্রচণ্ড শব্দে কোথায় বাজ পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে কুঁজো হয়ে দৌডুনোর চেষ্টা করে আশ্রমে ফিরে এলাম। ওলটানো ছাতি ঠিকঠাক করে ঘরে ঢুকে ভিজে জামাকাপড় বদলে নিলাম। অস্থির মনে লাইব্রেরি ঘরে ঢুকে দেখি, স্বাধীন চুপচাপ একা বসে আছে। আমাকে দেখে কেমন একটু হাসল। বলল, তোমার দুর্দশা আগাগোড়া দেখলাম! কোথায় যাচ্ছিলে? বললাম, পাহলোয়ানের অবস্থা দেখতে। স্বাধীন বলল, সে তো বাঁধের ওপর হরিদার তৈরি আস্তাবলে আছে। সুধন্য আছে। তার জন্য ভাবনা কিসের? যার জন্য ভাবনা হওয়া উচিত, তার কথা তোমার মনে পড়ল না? সঙ্গে-সঙ্গে মনে পড়ে গেল, হরিবাবু নাবাল অঞ্চলে জঙ্গলের ভেতর এখনও কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছেন। বললাম, তাই তো! স্বাধীন মুদুস্বরে বলল, ক্লাবে খবর দেওয়া দরকার। কিছু ছেলে ফিরে এসেছে দেখেছি। তাদের হরিদার খবর নেওয়া উচিত। একটু ভেবে বললাম, হরিবাবু নির্বোধ নন। স্বাধীন স্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে বলল, কে জানে! যদি বাঁধ ভেঙে যায়?
আমি কী মানুষ! স্বাধীনের হরিবাবুর জন্য দুর্ভাবনাকে প্রেম ভেবে ঈর্ষায় জ্বলে উঠলাম। সে বলেছিল, তার হৃদয়ে পুরুষপ্রেম নেই। তাহলে এ কী? পরমুহূর্তে মনে পড়ল, ও! আমার পুল নেই। তাই আমারও হৃদয় এবং প্রেম নেই। তাহলে ঈর্ষা নিরর্থক।
স্বাধীন হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, তোমার ছাতিটা এনে দাও। বললাম, কুটিরে যাবে? সে শক্ত মুখে বলল, না। ক্লাবে। দেখি, যদি ওরা কিছু করে।
আমার আত্মা নেই। তাকে ছাতিটা এনে দিলাম। আত্মা না থাকায় ‘শিভালরিও আমার কাছে নর্থক। শুধু বললাম, দেখো, ছাতি উলটে না যায়। স্বাধীন জাতির আড়ালে আত্মগোপন করে হাঁটতে থাকল। এই সময় দেবনারায়ণদার ঘরের সামনে কে এসে চিৎকার করে বলল, শঙ্খিনীর ধারে নতুন বাঁধ ভেঙে গেছে। আবাদ ভেসে যাচ্ছে।…
‘And now we have come to the place, where,
I toldst thee, thou shouldst : 9e, the wretched
men and women, who have lost the good of their intellect…’
Inferno–Dante.
ও’মালি সায়েবের জেলা গেজেটিয়ারে এই ভয়ংকর প্লাবনের বিবরণ আছে। পদ্মা ভৈরব-জলঙ্গী-ভাগীরথী-ব্রাহ্মণী-দ্বারকা-ময়ূরাক্ষী, জেলার মূল নদীগুলি তাদের অববাহিকার সমস্ত প্রাণ নিশ্চিহ্ন করেছিল। পুরুষানুক্রমে জেলার লোকে ‘বড়বানের বছর’ বলে বিভীষিকাটির স্মৃতি বহন করেছে। আর শা’ ফরিদ মস্তানবাবা বলেছিলেন, দরজা দিয়ে মন্দির পালিয়ে যাবে। পালিয়ে গিয়েছিল বটে। ব্রহ্মপুরে সেই প্রথম রামকৃষ্ণ মিশনের সেবাব্রতীদের আগমন এবং একটি মিশনও স্থাপিত হয়। ব্রাহ্মসমাজ প্রতিক্রিয়া সামলাতে পারেনি। দেবনারায়ণ স্বপ্নদর্শী। বস্তুজগতের এই হঠকারী উপদ্রবের প্রতি সচেতন ছিলেন না। ফলে কোনো সেবাদল ছিল না তাঁর। সারা আবাদ মৃতদেহের দুর্গন্ধে ভরে ওঠে। যারা বাঁচতে পেরেছিল, তারা কেউ ছিঁচকে চোর কেউ দুর্ধর্ষ ডাকাত হয়ে ওঠে। উঁচু এলাকাগুলিতে লুঠপাঠ শুরু করে। বাঁকা সর্দার স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। ব্রহ্মপুরের ফাড়িটি পুরোপুরি থানায় পরিণত হয়। বিদ্যালয়ের দায়িত্ব দেবনারায়ণের হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে এসব পরের কথা। স্বামীজিসংঘের যুবকরা রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুদের সঙ্গে ত্রাণে নেমেছিল! আবাদের বুকে তখন সমুদ্র। একটি নৌকায় উদ্ধারকারী একটি দল জঙ্গলের গাছগুলি থেকে অনেক মানুষকে উদ্ধার করে। সেই নৌকায় স্বাধীনবালা ছিল। সন্ধ্যার মুখে ফেরার সময়। একটি বটগাছ থেকে চিৎকার ভেসে আসে। গাছে শফি ছিল। নৌকায় তাকে ধরাধরি করে নামানো হয়। সে শুধু ‘পাহলোয়ান’ কথাটি উচ্চারণ করে অজ্ঞান হয়ে যায়। স্বাধীন বুঝতে পারে সে তার ঘোড়ার খোঁজে বেরিয়ে ভেসে গিয়েছিল। সেবাশুশ্রূষা আর চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়ে উঠলে একদিন স্বাধীন তাকে হরিনারায়ণের কথা জিগ্যেস করে। শফি একটু হেসে বলে, তিনি একটি কঙ্কাল। স্বাধীন বলে, দেখেছিলে? শফি বলে, বটগাছের ঝুরিতে আটকে ছিলেন। টেনে গাছে তুলতে গিয়ে বুঝলাম তিনি জড়পদার্থমাত্র । খুকু, ওই বটগাছের। তলায় একরাত্রে আমি, হরিবাবু, কালীমোহন, সত্যচরণ–