‘মহারাজ! যে করে এবং করায়, যে ছেদন করে এবং ছেদন করায়, যে অঙ্গহীন করে এবং অঙ্গহীন করায়, যে শোক ও নির্যাতনের কারণ হয়, যে কম্পিত হয় এবং কম্পিত করায়, যে প্রাণনাশ করে, যে সন্ধি ছিন্ন করে, যে অদত্ত গ্রহণ করে, যে লুণ্ঠন করে, যে চৌর্য্যে প্রবৃত্ত হয়, গুপ্ত স্থান হইতে যে হঠাৎ পথচারীকে আক্রমণ করে, যে পরদারগমন করে, মিথ্যাভাষণ করে, তাহার এইসকল কর্মছাড়া পাপ হয় না। যদি কেহ ক্ষুরধার চক্রের দ্বারা পৃথিবীর প্রাণীগণকে এক মাংসখণ্ডে, এক মাংস-পুঞ্জে পরিণত করে, তজ্জন্য কোন পাপ হয় না, পাপের আগম হয় না। যদি ওই ব্যক্তি আঘাত করিতে ছেদন করিতে হত্যা করিতে২ ছেদন করাইতে২ অঙ্গহীন করাইতে গঙ্গার দক্ষিণ তীরবর্তী হইয়া গমন করে, তজ্জন্য কোন পাপ হইবে না, পাপের আগম হইবে না।’–
স্বাধীন শ্বাসরুদ্ধ স্বরে বলল, এসব কার উক্তি? বললাম, অক্রিয়াবাদী দার্শনিক পূরণ কসপের। তিনি বুদ্ধ ও মহাবীরের সমকালের লোক। স্বাধীন বলল, কী ভয়ানক কথা! বললাম, খুকু! তুমি একদিন স্ট্যানলিকে হত্যার জন্য আমাকে পিস্তল দিয়েছিলে। অবশ্য সে তোমার পিতৃঘাতী ছিল। কিন্তু হরিবাবু এবং আমি তাকে হত্যা করেছিলাম। স্ট্যানলির স্ত্রীপুত্রকন্যার দিক থেকে চিন্তা করো। তাদের মর্মযাতনার কথা ভাবো। পাতঞ্জল দর্শনে বলা হয়েছে, ‘অস্মিতা’ অর্থাৎ আমি ভাব যাবতীয় ক্লেশের অন্যতম প্রধান কারণ। বৌদ্ধ মিলিন্দপহ গ্রন্থে সে-জন্যই হয়তো বলা হয়েছে, ‘পুদ্গলো নূপলবভতি।’ পুদ্গল অর্থাৎ আত্মা নেই। স্বাধীন রুক্ষ স্বরে বলল, চুপ করো! পণ্ডিতি অসহ্য লাগে। বুঝলাম, স্বাধীন এই মুহূর্তে আমাকে চিনতে পারল। তার চোখে ভীতি এবং মুখে পাণ্ডুরতা ছিল। সে সশব্দে শ্বাস ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বইটি বন্ধ করে বসে রইলাম। ব্রহ্মমন্দিরে উপাসনা শুরু হয়েছে। দেবনারায়ণদার গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। কানে এল, ‘আত্মানং বিদ্ধি।’ মনে পড়ল পিতার শাস্ত্রীয় ভাষণে মুসলমানদের পয়গম্বরের উক্তির বজ্র-প্রতিধ্বনি, ‘যে নিজেকে চিনেছে, সে আল্লাহকে চিনেছে।’ আর গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসও বলেছিলেন, ‘নিজেকে জানো!’ কিন্তু কে আমি? কিছু আকস্মিক ঘটনার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া স্বরূপ একটি চেতনামাত্র। আমার পুদ্গল নেই। পদ্মার চরে পাহলোয়ান বলেছিল, ‘আমি নিমিত্ত মাত্র।’ মধ্যরাত্রে বেরিয়ে পড়লাম। বিজয়পল্লীতে একটি একদিখোলা চালাঘরে বধ্য ক্ষুদ্র মাংসপুঞ্জ অপর একটি বৃহৎ মাংসপুঞ্জের সংলগ্ন হয়ে জৈবিক এবং প্রাকৃতিক নিয়মে যথাক্রমে নিদ্রিত এবং ভূতলস্থিত। এবার আর একটি জৈবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রিয়াশীল হতে চলেছে। কিন্তু চালাঘরটির কাছে যেতেই আরও একটি জৈবিক ও প্রাকৃতিক নিয়ম ক্রিয়াশীল হল। একটি অস্পষ্ট হুংকার, পায়ের শব্দ, অন্ধকারের কালো একটি জীব, ঝুনঝুন কোমল ধ্বনিপুঞ্জ, আবার হুংকার। ঘুরে দেখি, মস্তানবাবা! ঝোঁপঝাড় ভেঙে নেমে গেলাম। ধানখেতে জলকাদা এবং সকল আদিম ব্যাপকতার আঠালো পিচ্ছিল স্তরগুলি থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে-নিতে পিছনে আবার হুংকার। তৎক্ষণাৎ জানিলাম, ক্ষুদ্র ওই মাংসপুঞ্জ আমার বধ্য নহে।…
Then the sluices of the sky opened
and
everything human was transformed
into mud…
–Epic of Gilgamesh.
এক বৃষ্টির দিনে বারান্দায় শাস্ত্রীজির কণ্ঠস্বর শোনা গেল, দেববাবু! এ কী শুরু হল? যেন আকাশ ছ্যাঁদা হয়ে গেছে। অন্য কেউ বললেন, ছ্যাঁদা কী বলছেন শাস্ত্রীজি? বলুন, আকাশের দরজা খুলে দিয়েছেন ঈশ্বর। ঘরের দরজা থেকে উঁকি মেরে দেখি, প্রভাসরঞ্জনবাবু। দুজনে ছাতি রেখে বৃষ্টি দেখছেন। প্রভাসরঞ্জন একজন আশ্রমিক। শুনেছি প্রচুর জমি দেবনারায়ণদাকে দেওয়া ঋণবাবদ শুধু সুদের হিসেব দেখিয়ে হাতাতে পেরেছেন। ওঁকে দেখলেই মস্তানবাবা অথবা দিওজেনিসের উক্তি মনে পড়ে যায়, ব্রহ্মমন্দিরের দরজা দিয়ে একদা ঠিকই মন্দির পালিয়ে যাবে। অথচ দেবনারায়ণদার পেয়ারের লোক। আরও শুনেছি প্রভাসরঞ্জনের বড়ো ছেলে নরেশরঞ্জন-এর সঙ্গে স্বাধীনবালার বিয়ের একটা প্রস্তাব উঠেছে। স্বাধীনের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার বলার কথা থাকতে পারে না। কিন্তু বৃষ্টির দিনে প্রভাসরঞ্জনকে দেখে মনে হল, স্বাধীনকে আমার কিছু বলা উচিত। নরেশূকে আমি বাঁকাসর্দারের সঙ্গে গাঁজার ছিলিম টানতে দেখেছিলাম।
সারা ভাদ্র মাস শুকনো গেছে। আশ্বিনের মাঝামাঝি এই বৃষ্টি শুরু। শুধু বৃষ্টি নয়, ঝড়ও। ঘরে চুপচাপ বসে ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, পাহলোয়ান কী অবস্থায় আছে? ছাতি নিয়ে এই দুর্যোগে আধক্রোশ দূরত্ব পেরুনো কতখানি কষ্টসাধ্য হবে, হিসেব করতে থাকলাম। সেই সময় দেবনারায়ণদার ঘরে তর্কাতর্কি বেধেছে কানে এল। শাস্ত্রীজির মতে, আকাশ মহাশূন্য নিরবয়ব, পদার্থহীন সত্তা। অতএব আকাশ। ছাদা হওয়া বা দরজা খুলে দেওয়া নিছক আলঙ্কারিক প্রয়োগ । প্রভাসরঞ্জন বলেছেন, আমরা আধুনিক যুগে এরূপ ব্যাখ্যা করছি মোশমুলর মহোদয়ও বৈদিক ঋকগুলিনের এরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু আমার মনে হয়, তকালে লোকদিগের ওইরূপ বিশ্বাস ছিল। দেবনারায়ণদা বললেন, মহাভারতে মহাপ্লাবনের বৃত্তান্ত মনে পড়ে কি? ‘প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসি বেদম্…’ কেশব মীনশরীর ধারণ করে বেদ রক্ষা করেন। প্রভাসরঞ্জন বললেন, এরূপ মহাপ্লাবনের গল্প গ্রিস, সুমের সর্বত্র গ্রন্থাদিতে আছে। শাস্ত্রীজি বললেন, বাইবেল এবং কোরান গ্রন্থেও আছে। এগুলির রূপক। গীতার উক্তি স্মরণ করুন, ‘যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানিঃ…’