‘ঐ দৈজিনিস এক দিন এক ক্ষুদ্র শহরের উচ্চ প্রাচীর
ও অতি উচ্চ তাহার দ্বার দেখিয়া শহরের
কর্তারদিগকে কহিল যে তোমরা বার বন্ধ কর নতুবা
শহর পলাইয়া যাইবে।’–
এর কিছুদিন পরে স্বাধীনকে জিগ্যেস করলাম, কী খুকু? গোপনে জ্ঞানী মস্তানবাবার দীক্ষা নিলে নাকি? স্বাধীন খাপ্পা হয়ে বলল, লোকটা অসভ্য। পাগল। ছিঃ! হেসে ফেললাম। বুঝলাম ‘বেটিকে’ কী দেখিয়েছে সে।
কাহারও শিরচ্ছেদ করা হত্যা নহে; একটি উপাদানকে
অপর একটি উপাদানে পরিবর্তিত করা মাত্র।
–পকুধ কচ্চায়ন (দীঘনিকায়)
আশ্রমের তন্তুবার সমিতির ম্যানেজার বসন্তবাবুকে পছন্দ করি না, জানেন। তবু গায়েপড়া স্বভাব! এ ধরনের লোকেরা সচরাচর ছিদ্রান্বেষী হন! সবখানে খুঁত খুঁজে পান এবং অপরকে সেটি দেখিয়ে দিতে ছটফট করে বেড়ান। গায়েপড়া স্বভাবের কারণ হয়তো এটাই। জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা খুঁতযুক্ত আমিও মানি। প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্তও হই। কিন্তু আমি বসন্তবাবু নই। কিছুদিন আগে তিনি একটি আশ্চর্য খুঁতের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেটি সুতোকাটুনি করুণা ওরফে ইকরাতনের মধ্যাঙ্গ। সেখানে স্ফীতি ছিল। বসন্তবাবু বহু আগেই ওই ওই স্ত্রীলোকটিকে ‘ব্যাড ক্যারেকটার’ ছাপ সেঁটে দিয়েছিলেন। এবার বলেন, ম্যাথমেটিকস শফিবাবু! ২+২ = ৪ হওয়া অনিবার্য। বর্ষার এক সন্ধ্যায় বসন্তবাবু আমাকে জানান, খুঁতটি মেরামত করা হয়েছে। গর্ভবতী সুতোকাটুনি দেবনারায়ণদার হুকুমে স্বর্গলোক থেকে নির্বাসিত এবং বিজয়পল্লীতে আশ্রয় নিয়েছে। দেবনারায়ণদার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে নামব কি না ভাবছিলাম। কিন্তু তাঁর নীতিবাদ, জেদ আর খেয়ালের কথা জানি। আমিও নিজের স্বভাব সম্পর্কে সচেতন। নানা কারণে এখন আমার এই সুদৃঢ় আশ্রয়। প্রয়োজন। তাই চুপ করে থাকলাম। বসন্তবাবু মাঝে-মাঝে গায়ে পড়ে জানিয়ে যেতেন বাঁকাসর্দার একটি হবু-রক্ষিতা লাভ করেছে। স্ত্রীলোকটিকে সে একটি কুটির গড়ে দিয়েছে। তখনও বিষয়টির গভীরতা আর রহস্য আঁচ করিনি। শ্রাবণ মাসে হঠাৎ বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। আকাশ ভয়ংকর নীল হয়ে উঠল। ওই সময় পাঁচ কোশ দূরে রায়দীঘি গ্রামের পুলিশের থানা আক্রমণের পরিকল্পনা করেন হরিবাবু। দারোগা চন্দ্রনাথ হাটি এবং জমাদার ফারাকত খা এই দুজন ছিল লক্ষ্যবস্তু। স্ট্যানলি হত্যার পর সারা মহকুমায় বহু নির্দোষ লোককে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল। তার সঙ্গে এই দুই বীরপুঙ্গবও জড়িত ছিল। আমরা রাত্রে রওনা হব। বিকেলে ভ্রমণের ছলে কেশবপল্লীতে হরিবাবুর কাছে যাচ্ছিলাম। বিজয়পল্লীর সামনে ছাতিমগাছটির তলায় প্রায়ই মস্তানবাবাকে ঘিরে ভিড় থাকত। এদিন একটি দৃশ্য দেখে থমকে গেলাম। মস্তানবাবা হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। তার সামনে দুহাতে ন্যাকড়ায় জড়ানো। একটি শিশু নিয়ে একটি স্ত্রীলোক বসে আছে, সে করুণা নয়। কারণ করুণা তার পাশে। মস্তানবাবা চোখ বুজে বিড়বিড় করছিল। হঠাৎ বুকে শিশুটির বুকে জোরে ফুঁ দিয়ে বলল, যা। এবার স্ত্রীলোক দুটি উঠে দাঁড়াল। করুণার কোলে শিশুটিকে অপর স্ত্রীলোকটি তুলে দেওয়ামাত্র চিনতে পারলাম। অজিফামামী। ইচ্ছে হল,চিৎকার করে বলি, ভুল! মিথ্যা! অসম্ভব। কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরল না। দ্রুত স্থানত্যাগ করলাম। স্ত্রীলোকদিগের স্বভাব সত্যই বিচিত্র! ‘হাজারিলাল’ আমাকে দেখে বললেন, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? অসুখ করেনি তো? বললাম, না। খবর জানতে এলাম। হরিবাবু চাপাস্বরে বললেন, আমাদের মধ্যে চর ঢুকেছে সন্দেহ হয়। খবর এসেছে, গতকাল রাত্রে রায়দীঘি থানায় একজন গোরা সার্কেল অফিসার পঞ্চাশ-ষাটজন সিপাহি নিয়ে শিবির করছে। কাজেই পরিকল্পনা স্থগিত। সংঘের সদস্যদের আপাতত কয়েকদিন স্থানান্তরে আত্মগোপন করার নির্দেশ দিয়েছি। আমি এইমাত্র স্বাধীনকে দিয়ে তোমার কাছে খবর পাঠিয়েছি। রাস্তায় দেখা হয়নি? বললাম, না তো! হরিবাবু বললেন, তাহলে মাঠের রাস্তায় গেছে। তুমি এখানে থেকো না! আমি কয়েকদিন বিলের জঙ্গলে কাটাব। আর শোনন, তোমার ঘোড়াটির ব্যবস্থা করা দরকার। তুমি আশ্রমে আছ। দেববাবু তোমার পৃষ্ঠরক্ষা করবেন। কিন্তু–ঘোড়াটি তোমার-আমার সংযোগসূত্র। বরং ওকে নিয়ে গিয়ে শিগগির বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা করো। একটু ভেবে বললাম, দেবনারায়ণদার কেন জানি না, ঘোড়া সম্পর্কে কিছু কুসংস্কার আছে বলে ধারণা। হরিবাবু হেসে বললেন, ঋগ্বেদের অশ্বসূক্তের কথা উল্লেখ করবে। বললাম, সুধন্যকে যদি মাহিনা দিই, সে পাহলোয়ানের দেখাশুনা করবে না? হরিবাবু চিন্তিতমুখে বললেন, ছোকরা বড়ো অন্যমনস্ক। তবে দেখি, কী করা যায়। বলে উনি হাঁক দিলেন, সুধনিয়া! হে সুধনিয়া! সুধন্য তার কুটির থেকে সাড়া দিল। তারপর দৌড়ে এল। হাজারিলাল’ বললেন, আরে সুধনিয়া! বাত শুনো। হামি কয় রোজকে নিয়ে আপনা মুল্লুক যাচ্ছে। তু শফিবাবুর ঘোড়ার জিম্মাদারি লে। মাহিনামে তনখা মিলেগা। হামরে দেতে তিন রুপৈয়া। আমার দিকে ইশারা করলে বললাম, পাঁচ টাকা পাবে। হাজারিলাল লাফিয়ে উঠলেন, আরে ব্যাস! পাঁচ বুপৈয়া! শালে, তু বড়া আদমি বন জায়গা। পাঁচ পেয়া! ঢাই মন চাউলকা দাম! জয় বজরঙ্গবলী! সুধনন্যর চোখেমুখে উজ্জ্বলতা ঝলমল করছিল। জীবনে কখনও সে পাঁচ টাকা একসঙ্গে দেখেছে কি না সন্দেহ। তাকে অগ্রিম হিসেবে দুইটি রুপোর টাকা দিলে সে স্বপ্নাচ্ছন্নভাবে দুহাতে গ্রহণ করল। হাজারিলাল চোখ নাচিয়ে বললেন, তব তো শফিবাবু হৈয়ে গেল। এ সুধনিয়া! যা! উও দেখ পাহলোয়ানজি ঘাস খাচ্ছে। দোস্তি-উস্তি করতে হোবে তো, না কী? সুধন্য দেীডে বাঁধের নীচে নেমে গেল। এই আদিম পৃথিবীতে ঘোড়াটি ক্রমশ কিছুটা বন্যস্বভাবগ্রস্ত হয়ে উঠছে দিনেদিনে। কিন্তু কিছু করার নেই। মাঝে-মাঝে এসে তাকে সঙ্গ দিই। বাঁধের পথে বহুদূর যাই। লক্ষ করি, কদম ভুল করছে। কখনও অবাধ্যতার লক্ষণ দেখি। মনে হয়, প্রকৃতি ওকে করতল-গর্ত করে ফেলছে। সে একদা আমার সঙ্গে চমৎকার বাক্যালাপ করত। তাকে দার্শনিক বোধ হত। এখন মনে হয়, সে যেন দিওজিনিসে রূপান্তরিত হচ্ছে। স্বাধীনতাময়, সিনিক, উন্মাগী একটি কালো প্রবাহ। সভ্যতাকে খুরে ভাঙচুর করতে-করতে সে ছুটতে চায়। আমার মতো? হ্যাঁ, ঠিক আমার মতো। উদ্দেশ্যহীনতায় আক্রান্ত দুটি প্রাণী। সেদিন ফেরার পথে বিজয়পল্লীতে দেখলাম, মস্তানবাবা বুকে চিমটে ঠুকে ছাতরানো গান করছে। ভিড় করে লোকেরা শুনছে। বাঁদিকে একটি চালাঘরের উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে অজিফা মামী শিশুটির দেহে তেলহলুদ মাখাচ্ছে। স্বর্গভ্রষ্টা স্ত্রীলোকটি উঠোনের উনুনে পাতা ঠেলে জ্বাল দিতে-দিতে মুখ ঘুরিয়ে শিশুটিকে দেখছে এবং তার মুখে কী এক হাসি। তখনই সিদ্ধান্ত করলাম, শিশুটি বধযোগ্য। হত্যা কী? একটি উপাদানকে ভিন্ন উপাদানে পরিবর্তিত করা মাত্র! প্রকৃতিতে ইহা সতত ঘটিতেছে। সবকিছুই স্বাভাবিক নিয়মের অভিব্যক্তি। স্বভাবতঃ সৰ্ব্বমিদং প্রবৃত্তম। লাইব্রেরিতে ঢুকে বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘দীঘনিকায়’ খুলে বসলাম। স্বাধীন লণ্ঠন জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল। ফিরে এসে আস্তে বলল, হরিদা খবর পাঠিয়েছেন– তাকে থামিয়ে বললাম, জানি। হরিবাবুর কাছ থেকে এখনই আসছি। স্বাধীন বলল, কী বই পড়ছ? বললাম, শোনো!