‘Stand out of my way you are blocking the sun.’
–Diogenes to Alexander, the Great.
একদিন ‘হাজারিলালে’র কুটিরে যাবার সময় বিজয়পল্লীর পাশে বাঁধের কিনারায় একটি প্রকাণ্ড ছাতিমগাছের তলায় ভিড় দেখলাম। ভিড়ের কারণ একজন সাধু কিংবা ফকির। মাথায় জটা আছে। কিন্তু পরনে কালো আলখেল্লা। গলায় মোটা-সোটা লাল পাথরের মালা। হাতে একটি প্রকাণ্ড লোহার চিমটে। চিমটের ডগায় তামার আংটা। সে চিমটেটি বুকে ঠুকছে। ঝুনঝুন শব্দ হচ্ছে। বাঁকা সর্দার এবং আরও কিছু লোক সামনে বসে আছে। বাঁকা গাঁজা ডলছিল। একটু পরে বুঝলাম, সাধু নয়, মুসলমান ফকির। একে লোকে মস্তানবাবা বলে। সে চোখ বুজে বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য কিছু আওয়াচ্ছে। একটু দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেলাম। হাজারিলাল কুটিরে নেই। পাহলোয়ানের চালাঘর খালি। এদিক-ওদিক খুঁজে দেখি, একটু দূরে জলার ধারে পাহলোয়ান ফাঁড়িঘাস চিবুচ্ছে। পেছনের পা-দুটি যথারীতি বাঁধা। সে লাফ দিয়ে চলাফেরা করে এবং পছন্দসই ঘাস বেছে খায়। কিছুক্ষণ বাঁশের মাচানে একা চুপচাপ বসে কাটালাম। সারাক্ষণ অস্বস্তি। পদ্মার চরে চিহ্ন রেখে এসেছিলাম। পরদিন বিকেলে কালবোশেখির ঝড়বৃষ্টিতে সেগুলি ধুয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার আগে যদি ধূর্ত কোনো দারোগার চোখে পড়ে থাকে? একটি কালো ঘোড়া এবং তার সওয়ার কৃষ্ণপুরের অসংখ্য ঘোড়া সওয়ারদের মধ্যে যদি মিশে গিয়ে না থাকে? মাচান থেকে নেমেছি, টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হল। অগত্যা কুটিরের দাওয়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি থামলে জুতো খুলে ধুতি গুটিয়ে ফিরে চললাম। বিজয়পল্লীর সামনে গিয়ে দেখি সেই মস্তানবাবা একা দাঁড়িয়ে ভিজছে। আমাকে দেখামাত্র সে কালো আলখেল্লা দুদিকে সরিয়ে নিজের নগ্ন শরীর দেখাল। থমকে দাঁড়ালাম। লোকটির শরীর ঘন লোমে ঢাকা। কিন্তু চামড়ার রঙ ফ্যাকাসে, শাদা। মুখের রঙের সঙ্গে কোনো মিল নেই। খাড়া নাক। লাল চোখ! পুরু কাঁচাপাকা ভুরু। মুখে শিশুর হাসি। সে খি খি করে হাসছিল। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, কী দেখলি? জবাব না দিয়ে চলে আসছি, বাঁধের উলটোদিকের একটি ঘরের দাওয়া থেকে একটি লোক একগাল হেসে বলল, বড় খারাপ স্বভাব মশাই! কাউকে মানে না। সব্বাইকে ওইরকম! বাঁকার জন্য ওর রক্ষে। নৈলে কবে মেরে তাড়িয়ে দিত। সে কথা বলতে-বলতে আমার সঙ্গ নিল। মাথা থেকে পিঠ ঢেকে পেছনে হাঁটু অব্দি লম্বা তালপাতার একরকম আচ্ছাদন তার। কোটরের মতো দেখতে এই আচ্ছাদনের স্থানীয় নাম ‘টাপোর। বর্ষায় চাষীরা কেউ মাথাল, কেউ তালপাতার এই টাপোর পরে মাঠের কাজ করে। লোকটি বলতে-বলতে চলল, পয়সার ওপর কিন্তু লোভ নেই। খাওয়াদাওয়াতেও তেমনি। কেউ দিল খেল, নয়তো না। তবে সিদ্ধপুরুষ বলে মনে হয়, জানেন? ছেলেপুলেদের খুব ভালোবাসে। সে হাসতে লাগল। ভালোও বাসে, আবার ওই দুষ্টুমিও আছে। বুঝলেন? যদি বলে, ও মস্তানবাবা, হিসি করোদিকিনি, দেখি! অমনি হিসি করে দেখাবে। অবশ্যি সাধুফকির-সিদ্ধপুরুষরা ওইরকমই হয়।– দেবনারাণয়দার স্বর্গরাজ্যের অবস্থা দিনে-দিনে এভাবে বদলে যাচ্ছে তাহলে। সেদিনই ওঁকে মস্তানবাবার কথাটা বললাম। একটু চুপ করে থেকে বললেন, লোকটিকে। দেখেছি। একদিন সন্ধ্যার প্রার্থনাসভা থেকে চোখ পড়ল, একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। ব্ৰহ্মকীর্তনের সময় বুকে চিমটে ঠুকে তাল দিতে দিতে নাচতে লাগল। কীর্তন শেষ হল। তখন ও গান গেয়ে উঠল। গলাটা গাঁজা খেয়ে নষ্ট করেছে। কিন্তু সুরেলা। সত্যি বলতে কী, সমস্ত সভা স্তব্ধ, নিস্পন্দ। তুমি কোথায় ছিলে জানি না। ছিলে কি? বললাম, নিশ্চয় ছিলাম না। তাহলে শুনতে পেতাম। দেবনারায়ণদা বললেন, একখানা মারফতি গান গাইল। মনে হল, জীবাত্মা-পরমাত্মার কথাই বলছে। গানের বাণীটি শোনো। পরে লিখে নিয়েছি। বলে তিনি একটি ডায়রিবই খুলে পড়ে শোনালেন?
সবে বলে আল্লা-আল্লা আমি জানি দুই।
লা-ইলাহা ইল্লাল্লা মিছা জানি মুই।।
একদেশেতে দুজন রাজা
কেউ কারুরো নয়কো প্রজা
আরশে প্রেমের খেলা বুঝলি না গো তুই।।
দেবনারাণয়দা বললেন, ফকিরদের মধ্যে অদ্বৈতবাদী, দ্বৈতবাদী, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী সবরকম আছে দেখেছি? এ একটি গভীর গবেষণা আর চিন্তার বিষয়। বহু বছর আগে আরেকজন মারফতি ফকিরের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সে এমন পাগলাটে প্রকৃতির নয়। গম্ভীর লোক। তার একখানি গান লেখা আছে।
যার আকার নাই তার খুঁজলে কী পাই বল আমারে।
নিরাকার নিরঞ্জন সে ভাই শুনি সর্বশাস্তরে।।
কী দেখে নাম প্রচার হয়
যার নাই কি তাহার পিছু কী হবে দোড়ে-দোড়ে ।।
দেবনারায়ণদাব কাছে যাওয়া ভুল হয়েছিল। হাতে পেলে সহজে নিষ্কৃতি দেন না। এবার তিনি গুনগুন করে ব্রহ্মসঙ্গীতে গাইতে শুরু করলেন। শাস্ত্রীজি এসে উদ্ধার করলেন। ডাকঘরে গিয়েছিলেন। আশ্রমের চিঠি-পত্রিকার বোঝা বয়ে এনেছেন। বাইরে ভিজে ছাতি রেখে বললেন, বছরের লক্ষণ ভালো বোধ হচ্ছে না। দেবনারায়ণদা চিঠি-পত্রিকার বান্ডিলের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। সেই সুযোগ বেরিয়ে গেলাম। লাইব্রেরি-ঘরে স্বাধীন জানালার পাশে বসে খুব মন দিয়ে কী বই পড়ছিল। মুখ তুলে একটু হাসল । বললাম, হাসছ কেন? স্বাধীন বলল, কানে আসছিল দেবুজ্যাঠা তোমাকে গান শেখাচ্ছেন! বললাম, না–না-মস্তানবাবা! স্বাধীন ভুরু কুঁচকে বলল, মস্তানবাবা? তারপর হেসে উঠল। ও, বুঝেছি! লোকটা ভারি অদ্ভুত জান? সেদিন ব্ৰহ্মমন্দিরে গেটের সামনে দেখি, মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বললাম, কী দেখছ অমন করে? বলে কী– বেটি! বাবুকে শিগগির বল গিয়ে, এত বড়ো দরজা করেছে, এক্ষুণি বন্ধ করে দিক। নৈলে এখান দিয়ে মন্দির-টন্দির সব পালিয়ে যাবে। চমকে উঠে বললাম, কী আশ্চর্য! স্বাধীন বলল, আশ্চর্য মানে? বললাম, তোমাকে দেখাচ্ছি। আলমারি থেকে বাঁধানো প্রকাণ্ড একটি বই বের করলাম। ব্যস্তভাবে খুঁজতে থাকলাম। স্বাধীন কয়েকবার প্রশ্ন করে তাকিয়ে রইল। বহুক্ষণ পরে পাতাটি খুঁজে পেলাম। বললাম, সমাচারদর্পণ পত্রিকার এই পাতাটি পড়ে দেখো। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর শনিবারের সংখ্যায় দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় ‘দৈঅজিনিস’ সম্পর্কে কী লেখা আছে দেখো। তুমিও অবাক হয়ে যাবে। স্বাধীন বাঁধানো পত্রিকাবইটি নিয়ে পড়তে থাকল। বললাম, দিও-জেনিস। ইংরেজিতে ‘সিনিসিজম’ প্রসঙ্গে তাঁর কথা পড়েছি। তিনিই নাকি আলেকজান্দারকে বলেছিলেন, ‘সরে দাঁড়াও! রোদ আড়াল কোরো না।’ স্বাধীন বিরক্ত হয়ে বলল, পণ্ডিতি ছাড়ো। পড়তে দাও! একটু পরে সে উত্তেজিতভাবে বলল, শোনো, শোনো!